সংস্কারের আবশ্যকতা : রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার চাই
- সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন
- ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:২১
চার দিকে আলাপ চলছে কেবল সংস্কার নিয়ে। সংস্কারের অর্থ মেরামত, শোধরানো। আরেক অর্থ- ভালো করা বা ভালো হয়ে যাওয়া। বাংলা প্রবাদে বলা হয়ে থাকে- ভালো হতে পয়সা লাগে না। তাহলে কি লাগে? লাগে সদিচ্ছা। সদিচ্ছা থাকলেই হয়ে যায়। না, কখনো কখনো সদিচ্ছা থাকলেও ভালো হওয়া যায় না। সময় ফুরিয়ে গেলে সদিচ্ছার সাথে চেষ্টা থাকলেও ভালো হওয়ার আর সুযোগ থাকে না। বহু বছর পর সেই সময় ও সুযোগটা হাতের নাগালে।
গত কয়েক দিন যা ঘটেছে, তা ধারণা করাও কারো কারো জন্য কঠিন। কী থেকে কী হয়ে গেল! কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি শুরুতে ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ও শান্তিপূর্ণ। তাদের দাবিগুলো ছিল এক দিকে যৌক্তিক, আরেক দিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে। তারা ক্ষমতার প্রার্থী ছিল না। সরকারের বিদায়ও চায়নি। চেয়েছিল শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার। কোটার বিলুপ্তি নয়। সরকারের পক্ষে ওই দাবি মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সরকার তা কেবল অগ্রাহ্যই করেনি। মারমুখী হয়ে হত্যা-দমন-পীড়নে ছাত্রদেরকে প্রতিপক্ষ করে দিয়েছে। আর গোটা সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণ-আন্দোলন ও গণবিক্ষোভ অনেক হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো বলপ্রয়োগ ও মৃত্যু আগে কখনো ঘটেনি। এর বিপরীতে এবার কেবল আন্দোলন সফলই হয়নি, পুলিশ-সিভিল-আইন ও প্রশাসনের দলবাজিসহ করুণ দুর্গতিও ধরা পড়েছে। তা লুকানো, আড়াল করা বা কোনো দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই; বরং সুযোগ আছে শোধরানোর বা ভালো হয়ে যাওয়ার। সেই ওছিলা বা মাধ্যমটা আমাদের সামনে একজন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। ছাত্ররা নিরপেক্ষ লোক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছে। তার সামনে এখন অনেক দায়িত্ব। নানান সংস্কারের দায়িত্ব তার কাঁধে।
১৫ বছর সাত মাসের তুলনায় ৩০-৩১ দিন কোনো সময়ই নয়। কিন্তু মানুষের চাহিদা-আকাক্সক্ষা অফুরান। দাবিও বিস্তর। বন্যা-দুর্যোগসহ আরো নানান দুর্গতির মধ্যেও দাবিতে কোনো ছাড় নেই। সবার সব দাবি এখনই নগদে পূরণ করতে হবে। নইলে আদায় করে ছাড়া হবে। এ অবস্থা কারা করেছে, তা সবারই জানা। অবস্থাটা এমন, খুন-খারাবি, চুরি-পাচার করে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পারিষদ, এখন সে সবের দায় শোধের ভার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তার সরকারের। সেই দায়িত্ব তিনি পালন করে চলেছেনও। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে। করা হচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থাও। গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করা হয়েছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সইও করেছে বাংলাদেশ। হবে-হচ্ছে করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে টাইপের কথা টানা ১৫ বছর শুনতে শুনতে মানুষের বমি করার দশা হয়েছে। কিন্তু পেটের বমি মুখে আনার সুযোগও ছিল না। সেই অতিষ্ঠ মানুষ এখন নগদে কাজ দেখতে চায়।
রাষ্ট্র মেরামতসহ নানা দাবি ও মানুষের উচ্চ প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জিততেই হবে সরকারকে। ষড়যন্ত্র, প্রতিবিপ্লবের অপচেষ্টা বা সময়ের ওপর দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের পথচলার মধ্যে সেই তেজ স্পষ্ট। হাল ছাড়া বা নেতিয়ে পড়ার আভাস নেই। মাত্র এক মাস সময়ে সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ মানুষকে কেবল আশাবাদী করেনি, অবাকও করেছে। আর্থিক খাতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ যে কারো জন্যই বোধগম্য। বিচারিক ক্যু, আনসার বিদ্রোহের মতো অঘটন প্রতিহতের পাশাপাশি প্রশাসনে সংস্কার চলছে পুরোদমে। আর সংস্কার স্থায়ী করতে চাই শাসন পদ্ধতি। এই পদ্ধতির ত্রæটির কারণে জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে শাসনের নামে অপশাসনের দৈত্য।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংসদীয় শাসন পদ্ধতি কখনো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়নি। শাসনের নামে কায়েম হয়েছে অপশাসন। গণতন্ত্রের নামে বারবার দেয়া হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন, স্বৈরতন্ত্রের গাঁথুনি। সেই সাথে তৈরি হয়েছে বৈষম্যের চর্চা। গণতন্ত্র হয়ে থেকেছে কেবল কথার কথা। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই পাকিস্তান ভাঙা হয়েছে। বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। বাস্তবে দেশ স্বাধীনের পর গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে সর্বময় ক্ষমতায় দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়েছে। এর মধ্যে আর রাখঢাকও রাখা হয়নি। সিনা টান করে বীরবিক্রমে একদলীয়-একনায়কীয় বাকশালই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরপর ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। দফায় দফায় শাসক বদলেছে কিন্তু, একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী অপশাসন ঠিকই চলেছে। নতুন প্রজন্ম তা হাড়ে হাড়ে মালুম। রোগটা তারা ধরতে পেরেছে। যার প্রমাণ বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট দাবি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি সেনাবাহিনী দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার না করা। তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এখন রোগদৃষ্টে ওষুধ দেয়ার দায়িত্ব ড. ইউনূস সরকারের।
অপ্রিয় হলেও সত্য, মুসলিম সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা দুর্বল। তার ওপর কপটতা, ষড়যন্ত্র, হত্যার রাজনীতিতেও যেন অনেকে অভ্যস্ত। ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজ বিরোধিতা ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত¡ যখন তুঙ্গে, তখনো মুসলিম লীগের কিছু বড় নেতাও এর বিপরীতে কাজ করেছেন। ব্যক্তি স্বার্থে কংগ্রেসের প্ররোচনায় মেতেছেন এবং অখণ্ড ভারত চেয়েছেন। জিন্নাহ এতে বিরক্ত হয়ে রাজনীতি ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হয়ে যান। কবি আল্লামা ইকবাল মুসলিমদের দুরবস্থা বুঝতে পেরে ছুটে যান লন্ডনে- বুঝিয়ে শুনিয়ে জিন্নাহকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। গোটা ভারতে তখন মুসলিম জনগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশই ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে। এর ফাঁকেও বহু মুসলিম নেতা এর বিরোধিতায় লিপ্ত হন। জামায়াতে ইসলামীও পাকিস্তান সৃষ্টির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ব্রিটিশ সরকার এতে দোটানায় পড়ে যায়। তবে তারা জানত, ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে। তখন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা প্রচুর। শিখ সৈন্যও ছিল হিন্দুদের চেয়ে বেশি। শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, মনোহর গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, বল্লব ভাই প্যাটেলসহ কতক নেতার ষড়যন্ত্র দেখে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দেন। এতে কলকাতা, বিহার ও পাঞ্জাবে রায়ট বাধে। ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীতে অসহযোগ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার অ্যাটলি দিল্লির ভাইসরয়কে যত দ্রুত সম্ভব ভারত ছাড়ার হুকুম দেন।
প্রসঙ্গক্রমেই আসছে সেই ইতিহাস। ওইসব ঘটনা ও বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনায় স্পষ্ট শান্তিকামী জনগণের আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতিতে। তা দুই কক্ষের হলে পদ্ধতিটি বরং আরো টেকসই হবে। তা করতে নির্বাচন বা সংসদের ওপর ভরসা করা লাগে না; বরং এমন ভরসা করলে জটিলতা আরো পাকবে। উদ্যোগ ভণ্ডুলও হতে পারে। সেই অপেক্ষা না করে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমেই তা এখনই করা যায়। ড. ইউনূসের বিপ্লবী সরকার এই বিপ্লবী কাজটি করলে বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে। সব চেয়ে বড় কথা, স্বৈরশাসন-কর্তৃত্ববাদের রাস্তা বন্ধ হবে। দেশীয় জনপ্রিয়তার সমান্তরালে ড. ইউনূস উচ্চমার্গের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। তার ধারে-কাছে কেউ নেই। বিগত ২০-২২ বছরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তার বিস্ময়কর কীর্তি। শাসন পদ্ধতির একটি কীর্তি তিনি গড়লে তা দেশ-বিদেশে সমাদৃত হবে। ইতিহাসে কেবল সংস্কারক নন, ত্রাতা হিসেবেও লেখা থাকবে তার নাম।
গত এক মাসেই তার নানান সংস্কার কাজের কোনো কোনোটি বিস্ময়কর। সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দাখিল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কারের নির্দেশনার কাজ হচ্ছে ম্যাজিকের গতিতে। এরই মধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাধ্যমিকে আবারো ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। উচ্চশিক্ষা স্তরের স্থবিরতা কাটাতে ঢাকাসহ বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বদল করা হয়েছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান বদলও করা হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনের স্থবিরতাও সরকারের চোখ এড়ায়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। আরো কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনেও সংস্কারের ছোঁয়া পড়েছে। মাত্র এক মাসে এত কাজ, কল্পনাশক্তিকে হার মানানোর মতো। অবশ্যই আরো অনেক কাজ এখনো বাকির খাতায়। সংসদীয় পদ্ধতির কোনো সরকার চাইলেও এ কাজগুলো এক মাস কেন, কয়েক যুগেও পারত না। ড. ইউনূস তা এক মাসে এক হাতে পেরেছেন তার পারিষদকে একাট্টা করে। সংসদীয় পদ্ধতিতে অন্তত বাংলাদেশে তা কখনো সম্ভব হতো না। শাসনতান্ত্রিক এ পদ্ধতিকে স্থায়ী রূপ দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। সময়টা এখনই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা