২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বন্যা পরিস্থিতি ও পুনর্বাসন

বন্যা পরিস্থিতি ও পুনর্বাসন - সংগৃহীত

আমাদের দেশে বন্যা একটি অতিপরিচিত বিষয়। এটি বরাবরই ভিন্ন ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়, যার ফলে মোকাবেলার ব্যবস্থাও ভিন্ন পন্থায় নিতে হয়। এবারের বন্যা আসে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে। ফলে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। বন্যা হওয়ার কোনো পূর্বাভাস বা সঙ্কেত এমনকি প্রাকৃতিক অবস্থাও ছিল না যথেষ্ট পরিমাণে। রাতের অন্ধকারে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ দেখে বিছানায় পানি, কারো চৌকি/খাট ভাসছে পানিতে, কারো একতলা ডুবে গেছে, কেউ তৃতীয়তলা থেকে ফজরের নামাজে যাবেন বলে বেরিয়ে দেখেন দ্বিতীয়তলা পানিতে ভাসছে।

হাইওয়েতে কাকের ছানা, বকের ছানা, কচুড়িপানা, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, গাছপালা, তরুলতা, জমির ফসল, ফলফলাদি সবই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তীব্র বেগে প্রবল স্রোত। ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, দালানকোঠা, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, কিছুই বাকি নেই, সবকিছুই বন্যার প্রবল স্রোতের মধ্যে ভাসছে যা এযাবৎকালের সব ঘটনা ও রূপকথার কল্পকাহিনীকে হার মানিয়েছে। দেশের পূর্ব-উত্তর দক্ষিণের একটি বিশাল অংশের বানভাসি মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন।

অতিসম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পর আকস্মিকভাবে স্মরণকালের ইতিহাসের মহা দুর্যোগপূর্ণ এই বন্যা দেখা দেয় যা মুহূর্তের মধ্যে গড়েছে আরেকটি ইতিহাস। এবারের বন্যায় যত প্রবল বেগে তলিয়েছে এ দেশের একটি বিশাল অংশ, বলা বাহুল্য তেমনই দ্রুতবেগে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন এ দেশের ছাত্রছাত্রী, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বয়োজ্যেষ্ঠ-বয়োবৃদ্ধ সব শ্রেণিপেশার মানুষ।

কোথায় ছিল এতদিনের বৈষম্য তা এক মুহূর্তের জন্য কেউ খুঁজেও পায়নি। যার যা সাধ্যে কুলিয়েছে পুরোটা নিয়েই হাজির হয়েছে বন্যার্তদের সাহায্যে। কারো হুকুম বা অনুরোধে নয়, স্বেচ্ছায় শিশু তার টিফিনের টাকা, রিকশাচালক তার সারা দিনের ঘাম ঝরানো উপার্জনের টাকা, অনাথ ভিক্ষুকও সারা দিনের সঞ্চয়, কোনো অসহায় বাবা তার এক দিনের বাজারের খরচ বাঁচিয়ে সেই টাকা, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত কেউই হাত গুটিয়ে না রেখে যার যার সাধ্যমতো সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন। কেউ টাকা, কেউ খাবার, কেউ বা শুকনো খাবার, কেউ শিশুখাদ্য, তেল, পেঁয়াজ, মরিচ, চিঁড়া-মুড়ি, সাবান, ফলফলাদি, ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাওয়ার স্যালাইন এমনকি পশুখাদ্যও দিয়েছেন।

দিয়েছেন পরার কাপড়, শুকনো লাকড়ি, রান্নার গ্যাস, শিশুর ডায়াপার পর্যন্ত। কেউ বা দূর-দূরান্ত থেকে সব নিয়ে এসে রান্না করে খাইয়েছেন। নৌকা, স্পিডবোট, কোষা নৌকা, কলাগাছের ভেলা পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারেন।

স্কুলগামী ছোট ছোট শিশু সন্তান প্রখর রোদের মধ্যে হাইওয়ে রোডে বেগবান গাড়ির ভিড়ে দাঁড়িয়ে ত্রাণের টাকা সংগ্রহ করেছে। বৃষ্টিতে ভিজে, দিনে রাতে নিজেরা না খেয়ে ঘুরে ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করছে। ক্লান্তি যেন ঘামে ভিজিয়ে ধুয়ে নিয়ে গেছে। পরিশ্রান্ত, নিজে ক্ষুধার্ত তবুও ঠোঁটের কোনায় একটা কিছু করতে পারার প্রশান্ত হাসি, অথচ গতকালও বাবা-মা তার এ সন্তানকে একা স্কুলে যেতে দেননি। বাংলার মানুষের প্রতি অবাক তাকিয়ে পৃথিবী।

সারা দেশের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষ বৈষম্যহীন ছাত্র-জনতা মিলে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি যেন এক ত্রাণের মিলনমেলায় পরিণত হয়। রাত-দিন তা সংগ্রহ করেন ছাত্র-জনতা ও অন্যরা বিরামহীনভাবে। যা দেখে যে কেউ চোখ সুশীতল করে নিতে পারেন। মানুষ মানুষের জন্য। ত্রাণ আর অর্থের অভাব ছিল না, অভাব ছিল একটু সমন্বয়ের। মানুষ এত সাহায্য সহযোগিতা করেছিল যে, পরবর্তী সময়ে অনেক সংগঠন আর কোনো সাহায্য নিতে রাজি হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে, ছাত্রছাত্রীরা দল গঠন করে, পাড়ামহল্লায়, মসজিদ-মাদরাসাভিত্তিক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ইসলামী সংগঠন ও দল, আস-সুন্না ফাউন্ডেশন এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে সাহায্য দিয়েছে।
আর প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তি, দল, সংগঠন দূর থেকে গেছে নগদ অর্থ ও ত্রাণ নিয়ে। কেউ গেছেন অসহায়ের সহায় হয়ে, অন্যের দুঃখকে কাছে থেকে উপলব্ধি করতে, তাদের কষ্ট ভাগ করে নিতে। অধিকাংশই জানতেন না প্রত্যন্ত এলাকার খবর, চিনতেন না বিচ্ছিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, যার ফলে বিচ্ছিন্ন এলাকার অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। কিছু দিন অনাহারে, অর্ধাহারে কাটিয়েছেন, পানিতে ভেসেছেন অথচ একফোঁটা পানির অভাবে তৃষ্ণার্ত থেকে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন। যদিও সব ব্যক্তি, দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের এবং রাষ্ট্রীয় ত্রাণ সহযোগিতা একসাথে করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউএনও, ওয়ার্ড মেম্বার, ইউনিয়ন কাউন্সিলর, মসজিদের ইমাম এবং এলাকার সুধীজনদের নিয়ে করা যেত তাহলে আরো ফলপ্রসূ হতো। সুশৃঙ্খলভাবে প্রদান করা যেত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুনর্বাসন করতে পারলে যথাযথভাবে হবে ইনশা আল্লাহ।

বন্যার পানি ক্রমে কমতে শুরু করেছে। দুর্যোগ শেষ নয়, আরো ধেয়ে আসছে। মানুষজন নিজ বাড়িঘরে আশ্রয় নিতে উদগ্রীব। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত ও ভাঙা, গাছ উপড়ে গেছে, ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যা আছে তা নড়বড়ে। আসবাবপত্র, লেপ-তোশক, কাঁথা-বালিশ পচে গেছে, আঙিনা তথা জমির কষ্টার্জিত সব ফসলাদি ধ্বংস হয়ে গেছে। হাঁস-মুরগি এবং পশু-পাখি মরে পচে পড়ে আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। পুকুর, টিউবওয়েলের পানি দূষিত হয়ে আছে। বিশুদ্ধ পানির ভীষণ অভাব। শুরু হবে কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইসিস ও চুলকানির মতো নানাবিধ জটিল রোগ।

এই সময়ে আরো সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে সুপেয় পানির বিষয়ে। এই সময়ে পানি ফুটানো কষ্টসাধ্য, তাই পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (অ্যাকুয়াটেবস ৩৩ মিলিগ্রাম, ট্রোক্লোসিন সোডিয়াম ট্যাবলেট) ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত পাঁচটি ধাপে বিশুদ্ধকরণ করে পানি পান করা যায়। যথা-১. পাঁচ লিটার পানি সংগ্রহ করা; ২. তা পরিষ্কার সুতি কাপড় দিয়ে ছেঁকে নেয়া; ৩. এই পানিতে একটি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়া; ৪. ভালোভাবে নাড়ানো; ৫. ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা। এরপর পানি পান করা যাবে। কাঁচা ফল, শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। বাসি-পচা খাবারের বিষয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। খাবার ও গোসলের পানির বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।

বন্যার সময় ও বন্যা-পরবর্তীতে অনেক মেডিক্যাল টিম ও চিকিৎসকরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তাই এ সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা লক্ষণভিত্তিক ব্যবহার করতে পারেন যথাক্রমে- কলেরা বা ডায়রিয়ায় একোনাইট ন্যাপ, আর্সেনিক এলব, সিকেলিকর, কার্বোভেজ, ভিরেট্রাম এলব, ক্যামফর, নেট্রাম সালফ ইত্যাদি।

আমাশয়ের জন্য নাক্স ভমিকা, মার্কসল, নাক্স মকস, সালফার। পেটের পীড়ার জন্য নাক্স, লাইকো, চেলিডোনিয়াম, আস, কার্বোভেজ ইত্যাদি। চুলকানির জন্য রাসটক্স, আর্সেনিক, সালফার, ইচেনেশিয়া, মেজরিয়াম, বেলেডোনা ইত্যাদি। কৃমির জন্য সিনা।

বন্যাপরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন একটি বড় কাজ। পানি কমার সাথে সাথেই প্রত্যেকে নিজ গৃহে ফিরবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সময়ে বেশ কিছু বিষয় জানা দরকার।

এ সময় সর্বপ্রথমে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। পচা ও বাসি খাবার পরিহার করতে হবে। গৃহে প্রবেশ করার আগে গৃহের অবস্থা ভালো করে দেখে নিতে হবে, তা থাকার উপযোগী কি না। যদি বসবাস উপযোগী না হয় তাহলে মেরামত করে নিতে হবে। ঘরবাড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে, যাতে কোনো জায়গায় সাপ, বিচ্ছু লুকিয়ে না থাকে। এ ছাড়া বিদ্যুতের সুইচ ও সংযোগ ভালোভাবে পরীক্ষা করে ব্যবহার করতে হবে।

পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ছোট ছোট রাস্তাঘাট নিজেরা বা সামাজিকভাবে মেরামত করে নিতে পারেন। বন্যাপরবর্তীতে ফসল ভালো জন্মায়, যার কারণে বাড়ির বা আঙিনার আশপাশের জমি খালি না রেখে ফসল-শাকসবজি চাষ করতে হবে।
ঘরবাড়ি মেরামত করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানানো বা ক্রয় করা, অসহায় দরিদ্রদের এ বিষয়ে আগের মতো সহযোগিতা করে গড়ে দেয়া যেতে পারে আবাসন। সামাজিকভাবেও একটি দল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করে দলগতভবে এক দিনে একজন করে ক্ষতিগ্রস্তের কাজ করে দেয়া যেতে পারে। কারণ, এক ব্যক্তির একক কাজের চেয়ে একসাথে অনেকে করলে তা অনেক সহজে ও সুন্দরভবে করা যায়।

লেখক : হোমিও চিকিৎসক


আরো সংবাদ



premium cement