১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

পুলিশের ঘুষ খাওয়া বন্ধে করণীয়

- প্রতীকী

পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ পুরনো। এমনকি তারা নিজেরাও ঘুষ দেন। পুলিশের কর্মকর্তারা ঘুষ দিয়ে পোস্টিং পান আর থানায় বসে ঘুষ নেন। সাধারণ্যে কিছুটা প্রচলিত এ অভিযোগ এবার উচ্চারিত হয়েছে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মুখে। রাস্তাঘাটে নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিশেষ আলোচনা সভায় তিনি ওই মন্তব্য করেন।

কিন্তু অভিযোগের উচ্চারণ যতটা না অভিনব, তার চেয়ে বড় খবর এ উচ্চারণের ফলে পুলিশ কর্মকর্তার সাথে ওই অকপট গোয়েন্দা কর্মকর্তার মধ্যে সৃষ্ট বাগ্বিতণ্ডা আর সেটাই হয়েছে সংবাদ শিরোনাম। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে নয়া দিগন্তের যে শিরোনামে চোখ আটকে গেল তা হলো, ‘পুলিশের প্রতি জনগণের ক্ষোভ প্রশমনের দায়িত্বও পুলিশের : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।’ পুলিশের আরেকটি বাণিজ্য রয়েছে, তা হলো নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে ঠিক এভাবেই প্রথম আলোর ‘পুলিশ শুধু ঘুষ নেয় না, দেয়ও’ শিরোনামে চোখ আটকে গিয়েছিল আমাদের। কারণ খবরটি ছিল আমাকে নিয়েই।

২০০৪ সালের ২ এপ্রিল দেশের অরাজক অবস্থা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মিটিংয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। দুর্বৃত্তদের গোলযোগের স্থান সম্পর্কে সঠিক আগাম তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিতে না পারায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আমাকে সবার সামনে কিছুটা দোষারোপ করার চেষ্টা করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আগাম গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করাও আমার কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সানন্দে দোষটা নিয়ে আমি মন্ত্রীর কাছে আমার জানা একটা গল্প সবার সামনে উপস্থাপনের অনুমতি নিলাম।

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রমনা থানায় একজন ওসিকে ওয়াকিটকির মাধ্যমে এক অপারেশনের জন্য মিন্টো রোডে আসতে বলা হয়। তখন ওসি জানালেন, মিন্টো রোড কোথায় তা তিনি জানেন না? স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটা সবার কাছেই হাস্যকর মনে হবে একজন ওসি রমনা থানার ২ কিলোমিটার দূরে মাত্র ৫ মিনিটের পথ মিন্টো রোড চেনেন না। এটি রাগান্বিত হওয়ার মতোও একটা বিষয়। আসলে না চেনার কারণটা ছিল তৎকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে দেশের প্রতিটি থানার ওসিদের বদলি। আর বদলিটা এমন ছিল গ্রামের কর্মকর্তারা শহরে আর শহরের কর্মকর্তারা গ্রামে।

তিনি সদ্য ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে রমনা থাকায় যোগদান করেছেন। তার যোগদানে যাবতীয় যাতায়াত খরচ বাবদ মোট ৫৮ টাকা লেগেছে। পরবর্তীতে দেখা যায় মিন্টো রোড না চেনা অফিসার বেশ কিছু দিনের মধ্যে তার দায়িত্বে থাকা পুরো এলাকায় চোর, ডাকাত থেকে শুরু করে সব বেআইনি কাজ বন্ধ করে এলাকার চেহারাই পাল্টে ফেলেছেন। কিন্তু ২০০৩-০৪ সালের দিকে একজন ওসিকে বদলির জন্য প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। তাহলে কিভাবে আশা করা যায় ছয় লাখ টাকা খরচ করা অফিসার ৫৮ টাকা খরচ করা অফিসারের মতো সৎভাবে তার কাজ করবে?

সরাসরি সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করি, একজন ওসিকে বদলির জন্য এই ছয় লাখ টাকা কোন সেক্টরে কাদের কাছে হস্তান্তর করতে হয়? সে নিশ্চয় নিজ সেক্টর (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে) ছাড়া প্রশাসনের অন্য সেক্টরে এই টাকাটা দেয়নি। যদিও আমার টিম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা ওসিদের বদলির টাকা নেয়, তা খুঁজে পায়নি। অন্য পদের কথা বাদই দিলাম। নৌবাহিনীতে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড অফিসার হিসেবেই পরিচিত ছিলাম আমি এবং পরবর্তীতে একই বৈশিষ্ট্য এনএসআইতে অব্যাহত রেখেছি।

তাই গল্পের মাধ্যমে মূল জায়গায় ফোকাস করে এমন প্রতিশোধ নেব ভাবতে পারেননি প্রতিমন্ত্রী বাবর। আমার দেখা এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে বাবর ছিলেন অত্যন্ত চালাক ও চৌকশ। একাডেমিক শিক্ষা কম থাকলেও তার বাবা একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন তিনি। তাই তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন আমি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছি? তিনি একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। তখন পুলিশ অফিসাররা আমার ওপর বিরক্ত হয়ে বলেন যে, যেখানে বেশি টাকা লেনদেন হয়, সেসব বিভাগে আমার বেশি নজর দেয়া উচিত। কিন্তু একজন দেশপ্রমিক হিসেবে আমি সেদিন সেখানেই থেমে থাকিনি, পরবর্তীতে সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমি একটি প্রস্তাব উত্থাপন করি যে বদলি-বাণিজ্য বন্ধের জন্য সব থানায় ওসি বদলি ঘঝও-এর তত্ত¡াবধানে একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রামের মাধ্যমে করা হোক। সেই সময় দেশের সেই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমি সব থানার ওসিদের বদলির পরামর্শ দিই।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত/দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। তাই বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ শুধু রাজনীতিবিদেই সীমাবদ্ধ থেকে যান, প্রকৃত নেতা হয়ে উঠতে পারেন না।
আজ যদি ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জাতীয় স্বার্থে ঘঝও-এর তত্ত্বাবধানে তখন থেকেই একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রতিটি জেলা বা থানায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলির সিস্টেম চালু থাকত তা হলে একজন ওসি বা এসপিকে পদায়ন ও বদলির জন্য আরেকটি বাণিজ্য রয়েছে, তা হলো ‘নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য’ স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখে এরকম কোনো খবর হয়তো আসত না।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং বিশাল দুর্নীতির মূল সমস্যাটা সিস্টেমের, পুলিশ সেক্টরে প্রথমত তাদের নিয়োগবাণিজ্য, দ্বিতীয়ত বদলি-বাণিজ্য, তৃতীয়ত রাজনৈতিক চাপ। আর তাই যত দ্রæত সম্ভব মূল সমস্যায় ফোকাস করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি প্রবাদ আছে মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে, আর দেশের পচন শুরু হয় নেতা থেকে। মাছের চলনে মাথা ও লেজ সমান গুরুত্ব বহন করে। ঠিক তেমনি একটি বাহিনীর মাথা ও লেজকে সবার আগে ঠিক করতে হবে। তা হলে মাঝের অংশ আপনা-আপনিই ঠিক হতে বাধ্য। পুলিশের ক্ষেত্রে মাথা হলো মহাপরিদর্শক এবং লেজ হলো ইন্সপেক্টর। তাই সবার প্রথমে এই দুই স্থানে শতভাগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নীতিবান লোকদের জবাবদিহির ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের ওসি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলির দায়িত্ব দিতে হবে পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের হাতে। বর্তমানে ৬৫২টি থানা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবে অন্য কোনো এজেন্সি। কোনো থানায় যদি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে সাথে সাথে ওই থানার ওসিকে জবাবদিহি করতে হবে এবং তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার পারফরম্যান্স রেকর্ডে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

নিয়োগ, বদলি বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে যদি প্রভাবশালী লোকের মৌখিক, লিখিত বা টেলিফোনে সুপারিশ প্রমাণিত হয় তাহলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অতি দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের পারফরম্যান্স, সততা, কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, জনগণের প্রতি সেবাদান প্রভৃতি বিষয় প্রাধান্য দিতে হবে।

নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০% মেধার ভিত্তিতে স্বচ্ছ নিয়োগ হচ্ছে কি না, তদারকির জন্য মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ নিয়োগ পরীক্ষা তো তারাই দেবে। তাই তাদেরকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে আমরা ঘুষ দেবো না, অন্যকে ঘুষ নেয়ার সুযোগও করে দেবো না। ঘুষ দিলে ঘুষি মারব স্লোগানে দীক্ষিত করতে হবে। যেখানেই অন্যায় সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। আর ইতোমধ্যে নতুন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই তরুণ প্রজন্ম নিজেদের একবার প্রমাণ করেছে। আমরা আশাবাদী যে, আগামী দিনেও তারা এভাবেই সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ হোক সবার, পুলিশও হোক জনতার। আর এভাবেই রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরের সংস্কার হোক, এগিয়ে যাক প্রাণপ্রিয় আমাদের সবার মাতৃভ‚মি। তখন পুলিশ ঘুষ দেবেও না এবং নেবেও না। শুধু সেবা দেবে।
লেখক : নৌবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান ও
উপ-উপাচার্য বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement
শামীম ওসমানের ক্যাডারদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারের দাবি রাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষিকাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা শাবিপ্রবির ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার হলেন যারা সেন্সরবোর্ড পুনর্গঠন করে হচ্ছে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড গণহত্যায় উসকানিদাতা কবি-সাংবাদিকদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে : নাহিদ ইসলাম সাভারে হাসিনার বিরুদ্ধে একই দিন ২টি হত্যা মামলা গাজাবাসীর পাশে দাঁড়াল রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি পড়ছে টেকনাফে, স্থলবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ আমরা সরকারকে সময় দিতে চাই : মির্জা ফখরুল গত ৫ আগস্ট দেশ স্বৈরাচার, ফ্যাসীবাদ ও অপশাসন-দুঃশাসন মুক্ত হয়েছে : মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন অনুমতি ছাড়া ঢাবি ভিসিসহ শীর্ষ ব্যক্তিদের নাম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা

সকল