আওয়ামী লীগের দর্পচূর্ণ
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৮
২০০৯ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা যেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও হয়ে পড়েছিল সীমাহীন বেপরোয়া। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নেতাকর্মীদের ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে একের পর এক নির্বাচন নামের তামাশার মাধ্যমে একটানা প্রায় ১৬ বছর দেশ শাসন করেছে। কখনো হয়েছে বিনাভোটের নির্বাচন। কখনো নিশিরাতের নির্বাচন। আর ২০২৪ সালে হয়েছিল ‘ডামি’ নির্বাচন। এমন আজব নির্বাচন স্বীকৃত কোনো স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও হয় না। ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’-এর সব সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলেছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনার গণতন্ত্র ছিল, আওয়ামী লীগ যা বলবে, যা করবে তার সবই গণতন্ত্র। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যা করবে তা সবই অগণতান্ত্রিক। বিরোধী দল বেশি বাড়াবাড়ি করলে ‘ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা’ করার ব্যবস্থাও ছিল নির্মম ও নিষ্ঠুর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আবার বিরোধী দলের সাথে খেলতে খুব পছন্দ করতেন। তার ডায়ালগ ছিল, ‘খেলা হবে’। এই ‘খেলা হবে’ ডায়ালগটি আওয়ামী লীগের সব শ্রেণীর নেতাকর্মীর কমন ডায়ালগে পরিণত হয়েছিল।
রাজনীতিবিদরা সাধারণত দাবা খেলতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ দাবার প্রতিটি চালের মধ্যে রাজনৈতিক কৌশল নিহিত আছে। দাবা খেলতে খেলতেই মাথার অনেক জট খুলে যায়, যা রাজনীতির চালে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যে খেলার কথা বলেছেন সেই খেলার মধ্যে দাবার কোর্ট ছিল না, ছিল রক্তপাতের হুঁশিয়ারি, ছিল জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়নের হুমকি। বিরোধী নেতাকর্মীদের দমনে অস্ত্র হাতে দলবাজ পুলিশ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসী কায়দায় তাণ্ডবলীলা চালানোই ছিল ওবায়দুল কাদেরের খেলার মূল উপজীব্য। আওয়ামী লীগ কর্মীরা খেলার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করত পিস্তল, বন্দুক, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল।
দিবালোকে শতসহস্র মানুষের সামনে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করা, মানুষের সহায়-সম্পদ লুট করে নেয়া, দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে মামুলি ব্যাপার। পুলিশ, আদালত সবই ছিল তাদের কৃতদাস। সব বেআইনি কর্মকাণ্ড নত মস্তকে জায়েজ করতে তাদের বিবেকে বিন্দুমাত্র বাধেনি। দেশটিকে এক আশ্চর্য মগের মুল্লুকে পরিণত করেছিল শেখ হাসিনার নেতৃতাধীন আওয়ামী সরকার ও আওয়ামী লীগ।
বেপরোয়া শাসন, দাম্ভিকতার চরম সীমা লঙ্ঘন, দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি মানুষের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নিয়ে একটি ভয়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার খেসারত হিসেবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে বিভোর আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে এসে এই দেশের জনগণ মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে। ‘আওয়ামী লীগ পালায় না’, ‘শেখ হাসিনা পালায় না’-এমন দাম্ভিকতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। এমনভাবে বিচূর্ণ হয়েছে যে, দলটির কোন নেতা কোথায় পালিয়েছে তা হাজার ভোল্টেজের বাতি জ্বালিয়েও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ১৬ বছরের আন্দোলন এবং ছাত্রজনতার ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের কাছে এমনভাবে পতিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ কিছু দিন আগেই শেখ হাসিনা তনয় সজিব ওয়াজেদ জয় হাঁকডাক করেই বলেছিল, ‘আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের চিহ্নও বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।’ আওয়ামী নেতৃত্বের এই দর্প কতটা ভয়ঙ্করভাবে চূর্ণ হয়েছে যে, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের নাম নেয়ার মতো একজন লোকও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এই নির্মম বাস্তবতা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের অবৈধ শাসন আর দাম্ভিকতার পুরস্কার হিসেবে পাওনা ছিল।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। এই দলটি মূলত তখন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সব আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্বের দাবিদার। কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অংশগ্রহণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, অন্য দিকে দেশ স্বাধীনের পর আওয়ামী লীগ একটি সুবিধাবাদী দলে পরিণত হয়েছিল, এটিও সত্য। রীতিমতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে তারা ব্যবসায় খুলে বসেছিল, যা শেখ হাসিনার শাসনামল ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এখানে লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে যতটা উচ্চমার্গে রাখার চেষ্টা করা হয়, সেই আওয়ামী লীগকে কিন্তু স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান বিলুপ্ত করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে একদলীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। শুধু তাই নয়; ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক একক রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে অনেক আশা-প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু দেশের সঙ্কট, অর্থনৈতিক সমস্যা এত তীব্র ও প্রকট হলো যে, শেষ পর্যন্ত মানুষের সব আশা এবং প্রত্যাশা ধুলোয় মিশিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে পর্যন্ত হত্যা করা হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের বাকশালী শাসনের অবসান হয়েছিল বটে কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই দেশের জনগণকে দ্বিতীয় বাকশালী শাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানুষ দেখেছে বাকশালী শাসনের নির্মমতা।
আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, সেই দল যখনই ক্ষমতায় গেছে তখনই তারা গণতন্ত্রকে ভুলে গেছে। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের দল হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সরকারি চাকুরেদের মধ্যেও দলটির সমর্থন ছিল। একটা সময় পাকিস্তান আমলের সিএসপি অফিসাররাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এর অর্থ উচ্চতর শ্রেণীগুলোকে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ কুক্ষিগত করে নিয়েছিল। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের খোলস থেকে বের হয়ে একটি লুটেরার নৈরাজ্যকর দলে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট, অধিকার হরণ, খুন-খারাবি দলটির আদর্শের জায়গাটিকে গিলে ফেলেছে। অতিমাত্রায় ব্যবসায়িক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি দলটিকে একটি দুর্নীতিপরায়ণ নিষ্ঠুর দলে পরিণত হতে সহায়তা করে এবং তাদের প্রত্যক্ষ মদদে ২০১৮ সাল থেকে ‘আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ করে। ফলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একনায়কী শাসনের ভাবমর্যাদা ফুটে উঠেছিল।
আওয়ামী লীগকে অতিমাত্রায় ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ‘একমাত্র অভিভাবক’ হিসেবে তকমা দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা জাতিকে স্পষ্টত বিভক্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু দেখা যায়, শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনা উভয়ের শাসন আমলেই কথিত রাজাকার কিংবা তাদের সন্তানদের পাশে বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত যোদ্ধা যারা ভিন্ন মতের ছিলেন তাদেরকে রাজাকার তকমা দিয়ে ভয়ঙ্করভাবে সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছেন। জাতি শেখ হাসিনার এই দ্বৈতনীতি কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, শেখ মুজিবুর রহমানকেও তিনি জাতীয় সম্পদের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের দলীয় সম্পদে পরিণত করেছিলেন। তাকে অতি উচ্চতায় তুলতে গিয়ে এই প্রজন্মের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করেছেন। এটি কারোরই কাম্য ছিল না। তাকে মহানায়ক বানাতে গিয়ে অনেক নিচে নামিয়ে আনার দায়ে নিজ দলে শেখ হাসিনার বিচার হতে পারে। শেখ হাসিনার বিচার হতে পারে আরো অনেক ঘটনায়। মানুষের সামনে উন্নয়নের দৃশ্যমান স্তম্ভ দাঁড় করিয়ে, অন্তরালে মহাদুর্নীতি, কোটি কোটি ডলারের ঋণের বোঝা চাপিয়ে নিজে পালিয়ে বেঁচেছেন কিন্তু জাতিকে রেখে গেছেন মহাসঙ্কটে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে পঙ্গু করে জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের দায় থেকেও মুক্তি পাওয়ার সুযোগ নেই। সব কিছু ধ্বংস করার দায় যেমন শেখ হাসিনার রয়েছে তেমনি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নর্দমায় নিক্ষেপ করার দায়ও। এসব দায় থেকে তাকে রেহাই দেয়ার সুযোগ নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, রাজনীতির যে ভুলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে, রাজনীতির একই ভুলে ২০২৪ সালের সেই আগস্ট মাসেই শেখ হাসিনাকেও চরম মূল্য দিতে হলো। জনগণের মুখের ভাষা, চোখের ভাষা, প্রতিবাদের ভাষা না বুঝে অহমিকা বা অস্ত্র দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় না। আমাদের সামনে বিগত দিনের অনেক ইতিহাস রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের সামনে অহমিকা, অস্ত্র সবই তুচ্ছ। অতিমাত্রায় তুচ্ছ। আওয়ামী লীগের দর্পচূর্ণ তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা