১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ডেঙ্গু আতঙ্কজনক মোড় নিচ্ছে

ডেঙ্গু আতঙ্কজনক মোড় নিচ্ছে - ছবি : সংগৃহীত

ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি বছরে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮১৯ জনে। এ সময় নতুন করে আরো পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে চলতি বছরে মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ জনে। ৫৩৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ১৯৯ জন রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগে ৯০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৩ জন, খুলনায় ৫৯ জন, ময়মনসিংহে ১৭ জন ও বরিশালে ৩৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৬ হাজার ৮১৯ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। ১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত ১০২ জনের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী এবং ৪৮ শতাংশ পুরুষ।

উপসর্গ : জ্বরই প্রধান উপসর্গ। চামড়ায় দানা (র‌্যাশ), রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে কারো কারো।

অন্য ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুজ্বর সাত দিনের বেশি থাকে না। প্রথম দিকে একটানা উচ্চ তাপমাত্রায় থেকে ছয় দিনের পর জ্বর চলে যেতে পারে। দুই দিন পর একদিন জ্বর না থেকে আবার দুই দিনের জ্বর থাকল তারপর জ্বর ছেড়ে গেল এমনো হতে পারে।

ডেঙ্গুতে গায়ে ব্যথা হয় বেশি। রোগীর চোখের পেছনেও ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

চামড়ায়, মুখে, খাদ্যনালিতে, চোখে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি যা হয় তা হলো একবার মাসিক হয়ে গেলেও একই মাসে আবার হয়।

ডেঙ্গুর টিপিক্যাল র‌্যাশ বেরোয় জ্বরের ষষ্ঠ দিনে। তখন জ্বর থাকে না। দেখলেই চেনা যায়, খুঁজতে হয় না। এ ছাড়া জ্বরের প্রথমে গায়ে চাপ দিলে আঙ্গুলে ছাপ পড়ে।

ডেঙ্গু দুই ধরনের- ক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার ও খ. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার।

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু আর দশটা ভাইরাল ফিভারের মতোই। ভয় না পেলে কোনো সমস্যা নেই।

হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সব কিছুই থাকে। রক্তনালির লিকিং হয় বলে বাড়তি কিছু সমস্যা হয়। জ্বরের সাথে যদি প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হয় এবং হিমাটোক্রিট ২০ শতাংশ ভেরিয়েশন হয় তবে সেটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের চারটি গ্রেড রয়েছে।

গ্রেড-১ : টুনিকেট টেস্ট পজিটিভ হওয়া ছাড়া রক্তক্ষরণের আর কোনো আলামত থাকে না।
গ্রেড-২ : দৃশ্যত, রক্তক্ষরণ থাকে।
গ্রেড-৩ : ১ বা ২ এর সঙ্গে যদি ব্লাড প্রেসার কমে, পালস বাড়ে।
গ্রেড-৪ : ১ বা ২ এর সাথে যদি ব্লাড প্রেসার, পালস রেকর্ড না করা যায় গ্রেড ৩ ও ৪-কে একসাথে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলে।

ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : খুব টক্সিক না হলে কোনো জ্বরেরই তিন দিন আগে পরীক্ষার দরকার নেই।
টিসি ডিসি হিমোগ্লোবিন ইএসআর, এসজিপিটি : ভাইরাল ফিভারে কাউন্ট বাড়ে না। যদি কাউন্ট কমে, বিশেষ করে টিসি তিন হাজারের নিচে নামে তাহলে ডেঙ্গু নিশ্চিত।

এনএস ১ জ্যান্টিজেন : এটি জ্বরের প্রথম সপ্তাহের পরীক্ষা। জ্বর থাকাকালীন পজিটিভ হয়।
অ্যান্টিবডি পরীক্ষা : সাত দিন পর পজিটিভ হয় বলে এটি কার্যকরী নয়। এনএস ১ অ্যান্টিজেন করা গেলে এর দরকারও নেই।

প্লাটিলেট কাউন্ট ও হেমাটোক্রিট : প্লাটিলেট আতঙ্ক না থাকলে অত্যাবশ্যকীয় নয়। হেমোরেজিক ফিভার ডায়াগনোসিস ও ফলোআপের জন্য করা লাগে। পেটে ও ফুসফুসে পানি নিশ্চিত করার জন্য পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও বুকের এক্স-রে করা লাগে।

নিউট্রিশন : জ্বরের সময় ক্ষুধামন্দা হয়, বমি লাগে। এ সময় ফলের রস উপকারী। স্বাভাবিক খাবার খাওয়া যাবে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু এবং গ্রেড-১ হিমোরেজিকে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। গ্রেড-২ এ অতিরিক্ত সমস্যা হলো প্রথমে ধরতে না পারলে চিকিৎসা না দিলে গ্রেড-৩ বা গ্রেড-৪ অর্থাৎ শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে। পরিমিত পানি দিতে হবে জ্বর নামিয়ে রাখতে।

গ্রেড-২ তে যদি পেটের ব্যথা না কমে, বমি হতে থাকে অথবা প্রেসার ওঠানামা করে তাহলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়।

রক্ত দেয়া (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) : রক্তক্ষরণ হলে নিয়ম হলো রক্তবদল করতে হয়। সিস্টলিক ব্লাড প্রেসার ১০০-এর নিচে নামলে, পালস ১০০-এর বেশি হলে। হিমোগ্লোবিন ১০-এর নিচে নামলে ও হিমাটোক্রিট কমে গেলে রক্ত দিতে হবে।

প্রতিরোধ : মশা মারতে ঘরে স্প্রে ব্যবহার করুন। তা ছাড়া ফুলহাতা কাপড় এবং পায়ে মোজা ব্যবহার করুন। দিনে মশারি দিয়ে ঘুমান। মশার বংশবিস্তার রোধ করতে যেকোনো জায়গায় জমে থাকা পানিতে ওষুধ স্প্রে করুন। পানি জমে না থাকে এমন ব্যবস্থা করুন।

ডেঙ্গুজ্বর রোগীর জন্য ঘরোয়া পরামর্শ
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর জন্য উপাদেয় খাবার চিকেন ভেজিটেবল স্যুপ। স্যুপ থেকে ভিটামিন বি-১২, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, জিংক, প্রোটিন ও ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এই স্যুপ শরীরে তরল পদার্থের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি, অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করবে এবং শরীরে শক্তি জোগাবে। তবে স্যুপে মসলার ব্যবহার কমাতে হবে।

জ্বরের সময় টকদই খেলে শরীরে তরলের ভারসাম্য রক্ষা করবে, অন্য দিকে এটি পরিপাকতন্ত্রের ক্ষমতা বাড়াবে। ফলে শরীরে পুষ্টি উপাদানের শোষণক্ষমতা বাড়বে। শরীর ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা পাবে।

পেঁপের জুস ভিটামিন বি-১২ এবং ফলিক অ্যাসিডের ভালো উৎস। এটি অণুচক্রিকা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অন্তত প্রতিদিন ৫০০ মিলিলিটার পেঁপের জুস খেতে হবে। ভিটামিন বি’র উৎস হিসেবে ভাতের মাড় খুবই উপযোগী খাবার। এর সাথে কিছু সেদ্ধ সবজি এবং একটু লেবুর রস যোগ করলে এর গুণাগুণ আরো বেড়ে যায়। ডেঙ্গুরোগীকে ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরে পুষ্টির চাহিদা মিটবে আবার তরলের ভারসাম্যও বজায় থাকবে।

জাম্বুরা ভিটামিন সি ও পটাশিয়ামের বেশ ভালো উৎস। শরীরে প্লাজমার সাথে পটাশিয়াম বের হয়ে যায়। এর ঘাটতি পূরণ করতে জাম্বুরার জুস অত্যন্ত কার্যকরী। সাথে ভিটামিন এ, বি ও সি পাওয়া যায়।

নরমাল স্যালাইন : প্যাকেটজাত ওরস্যালাইন সঠিক নিয়মে আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। এতে ইলেকট্রোলাইটসের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি তরলের ভারসাম্য রক্ষা হবে। কচি ডাবের পানি সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও অন্যান্য ইলেকট্রোলাইটসের ভালো উৎস। এটিও ইলেকট্রোলাইটসের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে।

কোন খাবার খাওয়া যাবে না
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর অতিরিক্ত মসলাদার খাবার ও ভাজাপোড়া খাওয়া যাবে না। এসব খাবার রোগীকে শকের দিকে নিয়ে যায়। এই খাবারগুলো হজমের জন্য অনেক পানির প্রয়োজন হয়। এ সময়ে শরীরে এমনিতেই পানির ঘাটতি থাকে। এর মধ্যে যদি খাবার হজম করতে অতিরিক্ত পানি প্রয়োজন হয়, তখন রক্তচাপ আরো কমে যেতে পারে, যা রোগীর জন্য বিপজ্জনক। তাই এসব খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে এখন মহা আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা গেছে। ২০২৩ সালে সারা দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। অধিদফতরের তথ্যানুসারে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৮৬৮ জন। আর ২০২৩ সালেই মারা যায় এক হাজার ৭০৫ জন, যা বিগত দুই দশকের মোট মৃত্যুর প্রায় দ্বিগুণ।

এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাত, জলাবদ্ধতা ও বাতাসে অত্যধিক আর্দ্রতা এ মশার বংশবিস্তারে সহায়ক। আর মশার প্রজনন স্থানগুলো ধ্বংস করাসহ হটস্পটগুলোতে উড়ন্ত মশা মারার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গুর জন্য উচ্চঝুঁকি থেকেই যাবে।

পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, গাড়ির চাকার টায়ার, বাড়ির পানি সংগ্রহের ট্যাংক, ফুলের টব ও ফুলদানিতে জমে থাকা পানিতে এ মশা বংশবিস্তার করে। এদের ডিম ফোটার জন্য পানির প্রয়োজন হয় বলে শুকনো মৌসুমে এ মশা কমে যায়। তাই বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।

আর বর্ষাকালে যেমন মানুষ অতিরিক্ত গরম থেকে মুক্তি পায় তেমনি অনেক ধরনের রোগবালাই মোকাবেলাও করতে হয়। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধু বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বেশির ভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

লেখক : কলামিস্ট
ই-মেইল : drmazed96@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement