২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কলঙ্কিত মুক্তিযুদ্ধ

-

পাকিস্তানিদের শাসন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কলঙ্কিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী স্বৈরশাসক হাসিনা। একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্য মতে, ৫০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব মুক্তিযোদ্ধার বংশধররা বিভিন্ন কোটা-সুবিধায় লেখাপড়াসহ চাকরি-সুবিধা ভোগ করছে- এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মাসিক ভাতা পাচ্ছে। কারো কারো মতে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আরো বেশি। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, ৫৫ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধাকে আনা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) নেপথ্যে থেকে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী শাজাহান খান এই তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেছেন, এমন অভিযোগে সংসদীয় কমিটির সদস্য লতিফ সিদ্দিকী এমপির সাথে শাজাহান খানের বাদানুবাদ হয়। লতিফ সিদ্দিকী এমপি ও শাজাহান খানের বাদানুবাদের এ বিষয়টি কিছু দিন আগে মিডিয়ায় আসে। এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে সচিবালয়ে কয়েকজন সচিব বিশেষ কোটার সুবিধা নিয়ে স্বৈরাচার সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় জাতির কাছে সম্মানিত। তারা না চাইতেই স্বৈরাচার সরকার তাদের নামে মাসিক ভাতা বরাদ্দ করেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা সমাজে সচ্ছল, পারিবারিকভাবে বংশানুক্রমে বিত্তশালী। প্রশ্ন হলো, হাসিনা সরকার কেন এত উৎসাহী হয়ে তাদের নামে মাসিক ভাতা বরাদ্দ দিয়েছিল? মুক্তিযোদ্ধারা কি কোনো দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন? রাস্তা অবরোধ করে জাতীয় কর্তৃপক্ষকে জানান দিয়েছিলেন? না, এসব কিছুই তাদের করতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে, জাতিকে বিভক্ত করতে, সবার অজান্তে এই ভাতা ঘোষণা করা হয়। যেন সব মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকে। কৌশলটা এখানেই।

বিএনপি ঘরানার অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই ভাতার আওতাভুক্ত হতে পারেননি। জামায়াত ঘরানার যে কয়জন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তাদের তো নাম দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বহু আগে ইসলামিক পন্থা অবলম্বন করার কারণে পাকিস্তানপন্থী অভিহিত করে তাদের সুবিধাবঞ্চিত করা হয়। তাদের ভাষ্য, জামায়াত মানেই স্বাধীনতাবিরোধী। আর যারা জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও, তারাও স্বাধীনতাবিরোধী। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ করলেই মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামী লীগ না করলে মুক্তিযোদ্ধা নয়। আর জামায়াত করলে তো মুক্তিযোদ্ধা হলেও রাজাকার। এভাবে হাসিনা ও তার দোসররা সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১১ নম্বর সেক্টরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বীর উত্তম খেতাব দেন। পরবর্তীকালে দেশের নানা পটপরিবর্তনে তিনি জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠন করে রাজনীতিতে আসেন। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অংশীদারির কারণে শেখ হাসিনা তাকে অপরাধী বানিয়ে তার মুক্তিযুদ্ধের খেতাবে হস্তক্ষেপ করেন। তাকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যাকারী প্রচার করে তার দলের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য নানা যুক্তি দাঁড় করিয়ে গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। যেন জনগণ তার দল আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপিকে বেছে না নেয়। শুধু তা-ই নয়, তার দলের লোকসহ তার ১৪ দলীয় অংশীদাররা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়েও বহাল তবিয়তে টিকে থাকার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বদনাম করেই যাচ্ছিলেন। তাদেরই একজন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি মিডিয়াতে বলেছেন, জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের চর। ইনুর এই চাটুকারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, যে ইনুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে পাস করার মতো জনপ্রিয়তা ছিল না, তাকেই আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনা সমর্থন দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচনে পাস করিয়ে আনেন। পরে উপহার দিয়েছেন মন্ত্রিত্ব।

হাসিনার চাটুকারিতা করার জন্য ইনু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের মূল নামটি দখল করে ফেলেন। শাহজাহান সিরাজ, মেজর জলিল, আ. স. ম আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খান জাসদের প্রথম পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব। তারা যতটা জাসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন, ইনু তার চেয়ে অনেক নিচে। কিন্তু হাসিনা সরকারের আমলে ইনু এই দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতা সেজে যান। যার ফলে ক্ষমতাসীন দলে জোট করে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। নির্বাচনপূর্ব এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, তার সম্পদ বেড়েছে ২০০ গুণ। অথচ ইনু কোনো মুক্তিযোদ্ধা তো দূরের কথা মুক্তিযুদ্ধের কেউ নন; বরং এই ইনুদের দল অখণ্ড জাসদ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের প্রতিবাদ করায় বিরোধে জড়িয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে শতশত নেতাকর্মী মারা গেছেন এবং আওয়ামী লীগের কয়েক এমপিসহ অনেকে জাসদের হাতে মারা গেছেন। তার পরও এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সপক্ষের শক্তি সেজে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবহার করে, বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক বনে গেছেন তিনি।

আজকের সচেতন ছাত্রসমাজের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন জাতিকে তাদের থাবা থেকে মুক্ত করার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাসিনা ও ভারতের মোদি সরকারের আরেকটি ষড়যন্ত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যারা আওয়ামী লীগ ব্লকের বাইরে, তাদের নিজেদের বৃত্তের ভেতরে আনা। তারই অংশ হিসেবে টার্গেট করা হয় বিএনপির শীর্ষ নেতা সিলেটের শমসের মুবিন চৌধুরীকে। তাকে বিএনপি থেকে সরিয়ে নিতে নানা প্রলোভন ও গোপন চুক্তি করে কৃতকার্য হয়। এরপর আরেক খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পার্টির মুহম্মদ ইবরাহিমকে বিএনপি জোট থেকে গোপন চুক্তিতে সরিয়ে নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বিএনপির আরেক নেতা শাহজাহান ওমরকে একইভাবে সরিয়ে নেয়া হয়। হঠাৎ হঠাৎ এসব খ্যাতিমান নেতা যারা দীর্ঘদিন বিএনপি করে এসেছেন, তারা কেন নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে সরে গেলেন? সরেই যদি যেতে হয়, তবে আগে কেন বিএনপিতে এসেছিলেন। এমন নানা প্রশ্নের জালে পড়ে যান তারা। আসলে হাসিনাদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের বড় বড় খেতাবধারীদের আওয়ামীকরণ। যাতে আওয়ামী লীগকে শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি প্রমাণ করা যায়।

আওয়ামী লীগের আরেক সমালোচক আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নেতা কাদের সিদ্দিকীকে তারা টার্গেট করে। অবশ্য তার নামে আগেও অনৈতিকতার অভিযোগ ছিল। তার ওপর এক সময় একটি ব্রিজ নির্মাণ করার সরকারি দায়িত্ব ছিল। সেই ব্রিজ অসম্পন্ন রেখে বিল উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়েছে বলে জানা যায়নি। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সেই কাদের সিদ্দিকী যখন আওয়ামী লীগের সমালোচনামুখর, তখন তারও মুখ বন্ধ করার প্রচেষ্টা ছিল নিরন্তর। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তার নামে এক টাকার নজরানায় একটি দামি বাড়ি বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ এসেছিল তখন মিডিয়ায়। এভাবে স্বৈরাচারী হাসিনা গং মুক্তিযুদ্ধের খেতাবধারী আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা সবাইকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছে।

শেখ হাসিনা এক বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। তিনি এক সময় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হাসিনার আওয়ামী লীগ এমন একটি মেশিন, যার একদিক দিয়ে রাজাকার ঢুকলে অন্যদিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বের হয়ে যায়।’ মূলত অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা করার যে আওয়ামী প্রক্রিয়া, এটিকেই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এসব কারণে মুখের ওপর উচিত কথা বলা এই রাজনীতিককে, হাসিনা বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আজ্ঞাবাহী বিচারকদের মাধ্যমে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। যিনি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা। তিনি এক সময় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা কেউ নেই। তিনি ধরে ধরে বলেছিলেন, বীর উত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক- প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বাইরে। শেখ হাসিনা তার বাবার ডাকে সাড়া দেয়া মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণ পারিবারিক সম্পদ মনে করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব, প্রাণত্যাগ কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তার এই মনোবৃত্তি ক্ষমতার শেষ সময় পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
সমন্বয়কদের ওপর হামলা হালকাভাবে দেখছে না সরকার কমছে ৪৭তম বিসিএসের আবেদন ফি গাজীপুরে কোরআন অবমাননার অভিযোগে কলেজছাত্র গ্রেফতার অযাচিত অস্থিরতা নয়, দায়িত্বশীল হোন সুখী : দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন বেসরকারি স্কুল-কলেজে সাত পদে এনটিএসসির অধীনে নিয়োগ এই মুহূর্তে হঠকারিতা দিকে যাওয়া জাতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে : মির্জা ফখরুল পাইকগাছার নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার সেনা অভ্যুত্থান, সেনা শাসন ও আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদের দোসরদের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : গোলাম পরওয়ার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও এডুকেশন মালয়েশিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক

সকল