১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে

- প্রতীকী ছবি

ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়েছেন। এখন ভারতেই অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে ১৫ বছরের দুর্দণ্ড প্রভাবশালী শাসনের অবসান হয়েছে। গত ৮ আগস্ট নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। তারা এখন দেশ পুনর্গঠন এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করছেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসন ছিল চরম দুঃশাসনে ভরা। এ সময়ে আর্থিক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। শেয়ারবাজার ধ্বংস করে লুট করা হয়েছে লাখো কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি হয়েছে। দেশ থেকে পাচার হয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকা, যার তথ্য বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক বণিক বার্তায় ৭ আগস্ট প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ করেছে এবং এ সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সময়ে এক ডলারের বিনিময় মূল্য ১২০ টাকা হলে পাচার হওয়া অর্থের বর্তমান মূল্য ১৮ লাখ কোটি টাকা। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অর্থ পাচার বন্ধ এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে।

আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ কারণেই আমাদের দেশ অনুন্নত রয়ে যাচ্ছে। এসব অর্থ উন্নত দেশে জমা হচ্ছে। ফলে উন্নত দেশগুলো উন্নতই রয়ে যাচ্ছে। অর্থ পাচারের এই ধারা নদীর স্রোতের মতোই প্রবহমান। উঁচু এলাকার পানি যেমন সবসময় নিচু এলাকার দিকে চলে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের মতো অনুন্নত দেশের অর্থ পাচার হয়ে উন্নত দেশে চলে যায়। ফলে অনুন্নত দেশের ভাগ্যও ফেরে না, আর উন্নত দেশের অবস্থাও খারাপ হয় না। অনুন্নতরা অনুন্নতই থাকে আর উন্নতরা উন্নতই থাকে। ফলে উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোর ওপর খবরদারি করে। অনুন্নত দেশগুলো তখন উন্নত দেশগুলোর আজ্ঞাবহে পরিণত হয়। যেই পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, তা যদি পাচার না হয়ে এ দেশে থাকত এবং এ দেশে বিনিয়োগ হতো, তা হলে বাংলাদেশ আজ অনেক বেশি উন্নত হতো। শিক্ষার হার বাড়ত, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা হতো, কর্মসংস্থান বাড়ত, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতো, আরো বেশি জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, বেকারত্ব কমত, দারিদ্র্য কমত, আমদানি কমত ও রফতানি বাড়ত। বড় বড় সেতু আর বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি এবং বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হতো না। দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হতো। আমাদের আয় বাড়ত। ফলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতাম। অথচ এখনো আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। এখন আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় দুই হাজার ৭৪৯ ডলার। পাচারকৃত অর্থ এ দেশে বিনিয়োগ হলে আমাদের গড় আয় আজ কমপক্ষে দ্বিগুণ হতো। আমরা লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজের (এলডিসি) দল থেকে বের হতে পারতাম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯-২৪ সালে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়েছে, যা দিয়ে প্রতি বছর গড়ে বড় আকারের কমপক্ষে ২০০টি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করা যেত। প্রতিটি শিল্পকারখানায় গড়ে ২০০ মানুষের কর্মসংস্থান হলে প্রতি বছর এসব কারখানায় ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। ফলে বেকারত্ব কমত। এসব শিল্পকারখানায় যদি ৫০ ধরনের পণ্যও উৎপাদন হতো তা হলে ওই ৫০টি পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো না। ফলে ওই ৫০টি পণ্য আমদানিতে কোনো অর্থ ব্যয় হতো না। ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি হতো এবং আমাদের জিডিপি বাড়ত। এভাবেই দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেত। এভাবে প্রতি বছরই যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, সেই টাকা বিদেশে পাচার না হয়ে যদি দেশে বিনিয়োগ হতো, তা হলে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে উন্নতির দিকেই এগিয়ে চলত এবং আমরা একটি উন্নত দেশেই পরিণত হতাম। আমরা এখন একটি শিল্পসমৃদ্ধ দেশেই পরিণত হতাম। আমরা আমদানিপ্রধান দেশ না হয়ে তখন রফতানিপ্রধান দেশে পরিণত হতাম। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে তখন এ দেশের কোটি জনতাকে জীবিকার সন্ধানে বিদেশ যেতে হতো না; বরং দেশেই কর্মসংস্থান হতো। অন্য দিকে এসব অর্থ পাচার না হলে উন্নত দেশগুলোতে এত শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা হতো না। ফলে ওই সব দেশে এত কর্মসংস্থান হতো না। তাদের রফতানি আয় কমত। আমাদের সাথে তাদের ব্যবধান কমত। ফলে তারা আমাদের ওপর এত খবরদারি করতে পারত না। এভাবে পৃথিবীতে ধনী দরিদ্রের ব্যবধানটা কমে আসত। ফলে মানুষের মধ্যে শোষণের মাত্রাটা কমে যেত এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা হতো। এভাবেই বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মানুষের জীবন উন্নত, সমৃদ্ধ ও সুখের হতো। কেউ তখন আর অট্টালিকায় এবং কেউ বস্তিতে বসবাস করত না। প্রতিটি মানুষেরই অন্তত একটি বাড়ি থাকত, জীবনযাত্রার মান উন্নত হতো এবং থাকত সুখের নিবাস।

গরিবরা কখনো বিদেশে টাকা পাচার করে না; বরং তারা বিদেশে পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায়। তাদের অতিরিক্ত অর্থও নেই, অর্থ পাচারের পথঘাটও তারা চিনে না এবং বিদেশে তাদের কোনো সেকেন্ড হোমও নেই। এমনকি বিদেশে অর্থ পাচারের প্রয়োজনও তাদের নেই। বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদরাই আজ অর্থ পাচারের সাথে জড়িত। তারা ব্যাংক থেকে ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ বিদেশে পাচার করছে। সেখানে বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি কিনছে, ব্যবসায় বাণিজ্য গড়ে তুলছে এবং বিদেশকে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। ফলে আমাদের অর্থে বিদেশ উন্নত হচ্ছে। এই অর্থ পাচারের প্রধান অংশ আমদানি রফতানির মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে এবং এর শতকরা হার প্রায় ৫৮ শতাংশ; অর্থাৎ বিদেশে পাচারকৃত অর্থের অর্ধেকেরও বেশি ব্যাংকিং চ্যানেলকে ব্যবহার করে পাচার হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী পণ্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিং করে অর্থাৎ পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থটা বিদেশে পাচার করে। আবার পণ্য রফতানির সময় আন্ডার ইনভয়েসিং করে অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে রফতানি পণ্যের মূল্যের একটি অংশ বিদেশেই রেখে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে খালি কনটেইনার আনা হয় অথবা মূল্যবান পণ্য ঘোষণা দিয়ে ইট, বালু আর পাথর আনা হয়। এভাবে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে এ দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ বিদেশে পাচার করায় অনেক ঋণগ্রহীতা ঠিকমতো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারে না বা পরিশোধ করে না। ফলে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের একটি অংশ আদায় হচ্ছে না এবং এতে ব্যাংকিং সেক্টর সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে এ দেশ থেকে বিদেশে যেন অর্থ পাচার করতে না পারে সে জন্য ব্যাংকিং সেক্টরে মনিটরিং বাড়াতে হবে এবং সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু সব ব্যাংকের কন্ট্রোলিং অথরিটি, সুতরাং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বটা সবচেয়ে বেশি। অর্থ পাচার রোধে দেশে মানিলন্ডারিং আইন প্রবর্তিত হলেও অর্থ পাচার বন্ধ হয়নি। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ), এনবিআর ও দুদক কাজ করছে। কিন্তু অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক ও এনবিআরসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীলদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর আরো বেশি মনিটরিং ও নজরদারি বাড়ান। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বিদেশে টাকা পাচার টোটালি বন্ধের ব্যবস্থা করুন। ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ান। এ জন্য স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করুন। একই সাথে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধের ব্যবস্থা করুন। পাশাপাশি টাকা পাচারে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। তাদেরকে গ্রেফতার করে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করুন। একইভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দেশে গড়ে তোলা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করুন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে, যা অভিযোগ নয় বরং প্রমাণিত সত্য। উন্নয়নের নামে বড় প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য বড় বাজেট করা হয়েছে আর সেই বাজেট থেকে বড় অংশ লুট করা হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, তার বাসার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক এবং হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। ২০২৪ সালের সংসদের নির্বাচনের হলফনামায় এমপি প্রার্থীদের সম্পদ কয়েক শ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির চিত্র আমরা দেখেছি। এ ছাড়া রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেই শতকোটি টাকার মালিক, যা বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। বেনজীর, মতিউর, হারুন আর আবু তালেবরা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এসব সম্পদ কিন্তু আপামর জনগণের সম্পদ লুট করেই গড়া।

যেসব ব্যক্তি টাকা পাচার করেছেন তাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলছি, আপনারা অনুগ্রহ করে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনুন এবং ভবিষ্যতে টাকা পাচার বন্ধ করুন। আপনারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, এ দেশেই বড় হয়েছেন, এ দেশেই বাস করেন, এই দেশেই ব্যবসায় করেন, অথচ এই দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার করেন। ফলে আপনার টাকায় অন্য দেশ উন্নত হচ্ছে, আর আপনার নিজের দেশটা পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে আপনার দেশের লোকজনের জীবনধারা উন্নত হচ্ছে না। তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে এনে দেশে বিনিয়োগ করুন, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করুন, নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করুন এবং দেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করুন। তা হলে দেশ এগিয়ে যাবে, মানুষের জীবন উন্নত হবে এবং দেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তখন বিশ্ববাসীর কাছে এ দেশ যেমন হবে সম্মানিত, ঠিক তেমনি এ দেশের মানুষের কাছে আপনারা হবেন স্মরণীয় ও বরণীয়। এটিই সত্যিকারের দেশপ্রেম। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ থেকে অর্থ পাচার ও লুটপাট বন্ধ হোক এবং আমাদের দেশ উন্নয়ন ও শান্তির পথে অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাক, এটিই প্রত্যাশা।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল : omar_ctg123@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement