ব্রেনড্রেন আর নয়, প্রয়োজন ব্রেন গেন
- অভিজিৎ বড়ুয়া
- ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:৩৬
ব্রেনড্রেন হলো মেধাবী শিক্ষিত ও উচ্চপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের দেশ থেকে অন্য কোনো উন্নত দেশে চলে যাওয়া। এই ব্যক্তিরা আমাদের দেশে শিক্ষা অর্জন করেছেন। এতে দেশের অর্থ খরচ হয়েছে। দেশ তাদের কাছে কিছু আশা করে। দেখা গেল, উচ্চশিক্ষার কিংবা কাজের খোঁজে বিদেশে চলে গেছেন। ফলে প্রশাসন ও দেশ পরিচালনায় মেধাবীদের পরিবর্তে বিভিন্ন কোটার ভিত্তিতে অদক্ষ ও কম মেধাবীদের সমন্বয় ঘটেছে। যেখানে উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক মান বজায় রাখার জন্য অনেক উচ্চশিক্ষিত এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকের প্রয়োজন ছিল। কারণ মনে রাখতে হবে উচ্চশিক্ষিত মানুষ একটি পেশাদার সমাজ গঠনের চাবিকাঠি।
প্রতিভাবান মানুষ দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, বেড়ে উঠেছে এবং শিক্ষিত হয়েছে। কিন্তু যখন কাজ করার সময় এসেছে, যখন দেশের জন্য প্রতিদান দেয়ার সময় হয়েছে, তখন তারা একটু ভালো থাকার জন্য, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গেছেন উন্নত দেশে চাকরির খোঁজে। প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষিত এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকেরা কেন নিজের দেশ ছেড়ে চলে গেছেন? উন্নত কর্মজীবনের সম্ভাবনা, সামাজিক অবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অনেক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, দারিদ্র্য ও প্রযুক্তিগত উন্নতির অভাব, মেধার অবমূল্যায়ন, কম সুযোগপ্রাপ্তি, দলীয়করণের কালো থাবা, দুর্নীতি, অসম্মান এবং নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, অনুন্নত স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব তাদের চলে যেতে উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশী নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়। কেবল বিভিন্ন সেক্টরে ভারতের বেশ কয়েক লাখ নাগরিক চাকরি করে। ভারতের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীনের নাগরিকরা। আয়কর ফাঁকি দিয়ে ভারতের নাগরিকরা এ-থ্রি ভিসা, বি-ভিসা কিংবা ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। বাংলাদেশের পোশাক খাতের উচ্চতর পদগুলোতে ভারতীয়দের অবস্থান শক্ত। পোশাকের বায়িং হাউজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা। ফলে পোশাক কারাখানাগুলো বায়ার পেতে তাদের কারখানায় মার্কেটিং এবং হিসাব বিভাগেও ভারতীয়দের নিয়োগ দিয়ে থাকে। এর বাইরে আইটি খাতেও ভারতীয়দের দাপট। এমনকি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি এসব খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই কোনো ওয়ার্ক পারমিট নেই। তাদের বেতন অনেক বেশি।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশে বেকার সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার অনেকের হিসাবে ১২ শতাংশ বলেও উল্লেখ করা হয়, যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের দেশের তরুণ যুবারা কর্মসংস্থান খুঁজতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুবরণ করছেন। মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে নির্বিচারে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। অন্য দিকে বাংলাদেশে কর্মরত অবৈধ বিদেশীরা বছরে ১২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ এ দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এই বিদেশীরা অবৈধ হওয়ায় ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান না করেই দেশের টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে।
ব্রেন ড্রেনের ফলে তাৎক্ষণিক ক্ষতিকারক ফলাফল দেখা যায় না; বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে গুরুতর বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। উদ্বেগজনক এই সমস্যা এখনো নিয়ন্ত্রণহীন এবং তা দিন দিনই বাড়ছে। ব্রেনড্রেন বৃদ্ধি এই মুহূর্তেই বন্ধ করা দরকার। দরকার দেশে মেধাবীদের সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাতে তারা বিদেশে যেতে আগ্রহী না হন। এটি শুধু কর্মসংস্থানের বিষয় নয়। যারা উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণার কাজ করতে চান, যারা সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস নিয়ে গভীরতর অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করতে চান তাদের সবার জন্য যথেষ্ট সুযোগ দেশে সৃষ্টি করা জরুরি। তাদের মূল্যায়নের সব ধরনের সুযোগ দেশে থাকা দরকার। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যসহ সহজ, সাবলীল জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা তাদের দিতে হবে।
আমাদের আরো উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে, গবেষণার সুবিধাদিসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপকরণ আমদানি করতে হবে, যাতে করে মেধাবীরা তাদের মেধাচর্চার সুযোগ পান। মেধাবীদের ধরে রাখার জন্য তাদের যোগ্য কাজ, পদ ও বেতনভাতা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিক্ষিতদের দিকে নজর রাখা এবং নীতি তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা, যাতে শিক্ষিত মেধাবী ব্যক্তিরা দেশে থাকার অনুপ্রেরণা পাবেন এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন।
উন্নত দেশে অবস্থানকারী মেধাবীরা বা উচ্চ দক্ষ মেধাবীরা দেশের সাথে এক ধরনের সেতুবন্ধ তৈরি করে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য দেশের বিভিন্ন সংস্থার সাথে তাদের সংযুক্ত করার নীতি তৈরি করতে হবে। ‘রিভার্স ব্রেনড্রেন’ নীতিরমাধ্যমে বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানো মেধাবীদের স্থায়ীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা নিশ্চিত করতে হবে।
ভালো বেতনের চাকরির পাশাপাশি প্রণোদনা প্রদান করতে হবে, উচ্চ আর্থসামাজিক অবস্থা বৃদ্ধির সুযোগ দিতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে দেশব্যাপী একটি নীতি তৈরি করতে হবে। আমাদের প্রবাসী ও দক্ষ শ্রমিকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের অন্যতম ড. জামাল নজরুল ইসলামের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। সবাই সমৃদ্ধ ও বিত্ত-বৈভবের জীবন চান না। বরং নিছক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশের জন্য কিছু করার তাগিদে তথাকথিত সফল জীবনের সব রকম রঙিন হাতছানি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসতে চান, জামাল নজরুলের মতো এমন বহু মানুষ আমাদের তরুণদের মধ্যেও আছেন। শুধু দরকার সামান্য সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা। দেশের বর্তমান স্বৈরাচারমুক্ত নতুন পরিবেশে আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা