২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ : অবদান ও সংকল্প

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ - ছবি : সংগৃহীত

আজ ১১ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ব্রিটিশ-ভারতের ৯ কোটি মুসলমান ও ছয় কোটি তফসিলি তথা নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের ত্রাতা, অবিভক্ত ভারতের অবিসংবাদিত নেতা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী। কিন্তু আফসোসের বিষয়, আজো একশ্রেণীর মুসলমান তার অবদান ও সংকল্প নিয়ে সন্দিহান! তাদের উদ্দেশে আজকের কলাম লেখা। যেখানে জিন্নার অবদান ও সংকল্প কিছু তুলে ধরা হলো।

মুহাম্মদ আলী জিন্নার অবদান
প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ ড. স্ট্যানলি ওলপার্ট বলেছিলেন, ‘এ পৃথিবীতে খুব কম লোক আছেন যারা ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দিতে পারেন। আরো কম লোক আছেন, যারা পৃথিবীর মানচিত্র সংশোধন করে দেন এবং এমন ব্যক্তি কদাচিৎ পাওয়া যাবে যিনি একটা জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। অথচ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উপরিউক্ত তিনটি কাজই করেছেন।’

১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর করাচিতে গুজরাটি মুসলিম পরিবারে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম। তার বাবার নাম জিন্নাহভাই পুনজা ও মায়ের নাম মিঠাবাই। মূলত ব্যবসা শেখার উদ্দেশ্যে কৈশোরে তাকে লন্ডন পাঠানো হয়; কিন্তু তিনি সেখানে কোনো সাধারণ ব্যবসায় নয়, আইন ব্যবসায় শিখলেন। নির্ধারিত সময়ে রেকর্ড ভঙ্গ করে লিংকনস্ ইনের ইতিহাসে সেরা ছাত্র হয়ে লন্ডনে আইন পেশায় যোগ দেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতি বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন! ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একসময়ের সভাপতি ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম ভারতীয় সদস্য দাদাভাই নওরোজীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার। ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের ২০তম বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোন দেন তিনি। ১৯১২ সালে মুসলিম লীগের সদস্যপদও গ্রহণ করেন। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে জোর প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের অসহযোগিতায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ জিন্নাহ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে আলিগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রদর্শিত ‘হিন্দু-মুসলমান দু’টি আলাদা কওম’ সে পথ বাতলে নিলেন। জিন্নাহ ছিলেন একাধারে তুখোড় রাজনীতিবিদ ও একজন দক্ষ আইনজীবী। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, তার সারা জীবনের সাধনা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।

ভারতের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লালকৃষ্ণ আদভানি ২০০৫ সালে করাচিতে জিন্নাহর সমাধিতে গিয়ে পরিদর্শক খাতায় লিখেন, ‘ইতিহাসে অনেকের স্থান হয়; কিন্তু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমনই ব্যক্তি যিনি ইতিহাস গড়েছেন!’

উপরিউক্ত উক্তিটির ফলে এল কে আদভানি স্বদেশে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন! এমনকি তার নিজ দল থেকেও মন্তব্যটি প্রত্যাহারে বারবার আহ্বান জানানো হলেও তিনি সাফ জানিয়ে দেন, সম্পূর্ণ সচেতনচিত্তে তিনি তা বলেছেন, তাই তা প্রত্যাহার কিংবা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। ওই মন্তব্যের কারণে তার রাজনৈতিক জীবনের যবনিকাপাত হয়।

জিন্নাহর সংকল্প
ভারতবর্ষের মুসলমানদের হিন্দুদের গোলাম হওয়া থেকে বিরত রাখতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ শুধু একখণ্ড ভূমি চেয়েছিলেন। তার আগ্রহের বিষয়টি তিনি স্বীকারও করেছেন এই বলে যে, ভারতীয় মুসলমানদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত একটা নিজ ভূমি ও একটা নিজ সরকার প্রতিষ্ঠা। মূলত তিনি ভারতের বুকে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা দেশ চেয়েছিলেন, যেখানে মুসলমানরা শাসন করবেন; কিন্তু অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও সমান অধিকার ভোগ করবে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে তিনি যে ভাষণ দেন; তাতে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আজ থেকে পাকিস্তানের অধিবাসীদের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বলে আলাদা পরিচয় থাকবে না। তাদের পরিচয় হবে তারা পাকিস্তানি জাতি। এ ভাষণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, পাকিস্তানকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্ররূপে কল্পনা করেছিলেন তিনি। যে রাষ্ট্রে কেউ কাউকে শোষণ করতে পারবে না, আইনের চোখে সবাই হবেন সমান। উপরিউক্ত ভাষণ থেকে স্পষ্ট যে, জিন্নাহ মোটেও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তিনি ছিলেন উদার মনের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ।

জিন্নাহ উপমহাদেশের মুসলমানদের জাগতিক নেতা ছিলেন বটে; কিন্তু আধ্যাত্মিক নেতা তিনি কখনো হতে চাননি। তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে নাকি সেক্যুলার রাষ্ট্র হবে তাও তিনি নির্ধারণ করে যাননি। সে বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার সময় পাবো এবং এসব বিবাদ-বিসম্বাদ মিটিয়ে ফেলারও সময় পাবো যাতে ভুল ও জখমগুলো সরিয়ে ফেলা যাবে।

প্রকৃতপক্ষে জীবনের শেষপর্যায়ে এসে পাকিস্তান হাসিল করতে সক্ষম হন তিনি। ’৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান হাসিলের ঠিক এক বছরের মাথায় ’৪৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। ফলে তিনি নতুন দেশটির জন্য কোনো ধরনের শাসনতান্ত্রিক কিংবা অর্থনৈতিক রূপরেখা দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তার তৈরি করা পাকিস্তান হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র, যেটা মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। ধন-দৌলতের প্রতিও তার কোনো মোহ ছিল না। খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে বিপুল অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে যে অগাধ সম্পত্তির মালিক তিনি হয়েছিলেন তা একমাত্র কন্যাকে দান না করে দেশের জন্য দান করে গিয়েছিলেন। এমন ব্যক্তির কাছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বার্থকে তার মতো ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির সমান দৃষ্টিতে দেখাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকে মহৎ এই নেতার কীর্তি আজও যথাযথভাবে মূল্যায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, ইয়াহিয়া-ভুট্টো গংয়ের দেশবিরোধী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের দায় জিন্নাহর ওপর বর্তায় না! অন্তত বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস তাই বলে!

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমি
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
আলিফের পরিবারকে এক কোটি টাকা দেবে শামসুল হক ফাউন্ডেশন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যারাই যাবে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে : জামায়াত আমির এক সপ্তাহ পর বেনাপোল থেকে দূরপাল্লার পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত সমন্বয়কদের ওপর হামলা হালকাভাবে দেখছে না সরকার কমছে ৪৭তম বিসিএসের আবেদন ফি গাজীপুরে কোরআন অবমাননার অভিযোগে কলেজছাত্র গ্রেফতার অযাচিত অস্থিরতা নয়, দায়িত্বশীল হোন সুখী : দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন বেসরকারি স্কুল-কলেজে সাত পদে এনটিএসসির অধীনে নিয়োগ এই মুহূর্তে হঠকারিতা দিকে যাওয়া জাতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে : মির্জা ফখরুল পাইকগাছার নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার

সকল