২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা

নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ গত ৫ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করে গণমানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিরপেক্ষ নির্বাচন, গণতন্ত্রের স্বাদ ও সেবা উপহার দেয়ার জন্য। জনগণ ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের হাতে শোষিত হবে না, নাগরিকদের কাছে সরকারের জবাবদিহি থাকবে। নির্বাচিত সরকার জনগণের সম্পদ শোষণ করবে না, দেশে বৈষম্য থাকবে না। সরকার এবং সরকারি দলের নেতা এবং কর্মীরা হবে জনগণের সেবক। ১৯৭৩ থেকে পরবর্তী অনেক জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা ভোগ করতে পারেনি। ১৯৮৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সব নির্বাচন দেখার এবং বুঝার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশে তিনটি সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে।

১. ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে; ২. সামরিক সরকারের অধীনে এবং ৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তিন ধরনের সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলেও দলীয় সরকার এবং সামরিক শাসকের চরিত্র সমানে সমান। জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে শাসকদল নিরঙ্কুুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সরকার গঠন করে। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচন এ শাসকদল নিরঙ্কুুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হলে সদ্য বিদায়ী সরকারি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে বিরোধী দলে বসে এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার আসন দখল করে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসন দখল করে। এটিই ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ভোটারদের ব্যালট পেপারের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার নীতি। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ম্যাজিক কী তা একমাত্র নির্বাচন কমিশন ভালো বলতে পারে। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবসময় ক্ষমতাসীন সরকারের আজ্ঞাবহ। সামরিক সরকার, দলীয় সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার যার অধীনে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন হোক না কেন জোরালো গলায় মিডিয়া ব্যবহার করে বলবেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এত শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে।

আমরা নিরপেক্ষ ছিলাম, ক্ষমতাসীন সরকারি দল যা বলবে নির্বাচন কমিশনও একই রকম বক্তৃতা বিবৃতি দেবে। বিরোধী দলের সাথে কথা বলবে না, তাদের দাবি মানবে না, নির্বাচন কমিশনের কেন এ রকম চরিত্র বুঝতে পারি না। বিরোধী দল সংসদ নির্বাচন বা মেয়র নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন যৌক্তিক দাবি করে কিন্তু সরকারি দল থেকে বিরোধিতা করায় নির্বাচন কমিশন সুর মিলিয়ে বলবে, নির্বাচনের পরিবেশ ভালো। সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই।

আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা বিরোধী দলের ভোটার সংখ্যা ৩১ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি নয়। যদি বিরোধী দলের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোটার থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশন কেন নিরপেক্ষ থেকে সহায়তা করে না। আমরা বিগত ১৫ বছরের ইলেকশনের দিকে তাকাই বিরোধী দলের সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি সঠিক ছিল। ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট দেয়ার পরও নির্বাচন কমিশন বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। কিন্তু এরশাদের ১৯৮৪ সালের হ্যাঁ/না ভোট, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নিবাচন; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ১৯৯১, ২০০৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন, দলীয় সরকারের ১৯৭৩, ১৯৭৯, ২০০৬, ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন ভোটাররা দেখলেন, সুশীলসমাজ দেখল, নির্বাচন কমিশন দেখল। ফলাফল কী সবার জানা।

সব নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হলে জেনারেল এরশাদকে ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনের জন্য ছাত্র-জনতা কেন ভোটডাকাত বলল? ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তাকে বিধায় নিতে হলো। ২০১৪, ২০১৮ সালে রাতের বেলা ব্যালট পেপার সিল মেরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে নিজেরাই বিভক্ত হয়ে ভোটারবিহীন সংসদ সদস্য হয়েও ক্ষমতা দখল করে রাখতে পারল না। হাজারও ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়েও পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমন ছিল :

১. সংবিধান মোতাবেক ফখরুদ্দীনের সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না, এটি অসাংবিধানিক বৈষম্যমূলক সরকার ছিল। ২. সরকার ছিল ভারতের আধিপত্যবাদের অনুগত ফখরুদ্দীন ও জে. মঈনের পুতুল সরকার। মঈন নিজের পদবি লে. জেনারেল থেকে জেনারেল করেন। ৩. প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১৯৭৩ সালের মতো নির্বাচন করবেন। বাস্তবে তাই ঘটেছিল। লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং বি. জে. সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। তিনি খুব ভালো বলতে পারবেন। তখনকার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ আরো ভালো বলতে পারবেন। ৪. পুলিশ বাহিনীর প্রধান নুর মোহাম্মদ এবং জেনারেল মঈন সেনাবাহিনীর সদস্য এবং পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে সারা দেশে আগের রাতে ব্যালট পেপার সিল মেরে প্রতিটি কেন্দ্রে বাক্স ভর্তি করে রেখেছিল। যার ফল ছিল বিএনপি ৩০ আসন। জামায়াত দুই আসন। ৫. সেনাবাহিনী চারদলীয় জোটকে ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট নিয়োগ করতে দেয়নি। নওগাঁয় ১১০ ভাগ ভোট কাস্ট হয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র থেকে ফলাফল ঘোষণা হয়নি। ইউনিয়নভিত্তিক পোলিং অফিসার এবং প্রিজাইডিং অফিসার এই কারচুপির নির্বাচন পরিচালনা করেছিল। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচন তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ৬. জেনারেল মঈন, লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং ফখরুদ্দীন ও তার উপদেষ্টাদের, ২০০৮ সালের শামসুল হুদা কমিশনকে নির্বাচনে কারচুপির সহযোগী হিসেবে আইনের আওতায় আনতে হবে। ওই কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরশাসন ১৫ বছর বাঙালি জাতির ওপর চেপে বসেছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন মানেই সরকারি দলের স্থান বিরোধী দলে এবং বিরোধী দল বিজয়ী দল হিসেবে সরকার গঠন করা। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সংস্কৃতি হলো ক্ষমতাসীন দল গণমানুষের মন জয় করতে পারেনি। সরকারে থাকলে রাজনৈতিক দলের চরিত্র একরকম এবং বিরোধী দলে থাকলে আরেকরকম কেন? বিরোধী দলে থাকলে কখনো ভোটার তালিকায় ভুল, কখনো এই নির্বাচন কমিশন চাই না, ইভিএম চাই না, সেনাবাহিনী মোতায়েন দাবি, নির্বাচনে সূক্ষ্ম বা স্থুল কারচুপি, কেন্দ্র দখল, জালিয়াতি, জালভোট ইত্যাদি দাবি করা হয়। সরকারে থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, ভোট কারচুপি হয়নি, কেন্দ্র দখল হয়নি, সেনাবাহিনী লাগবে না, ইসির ভূমিকা নিরপেক্ষ ইত্যাদি। এ গোলক ধাঁধা কতদিন চলবে? সুশীলসমাজ কখন হবে সবার? মিডিয়া কখন হবে সরকারের দালালিমুক্ত এবং গণমানুষের নিরাপদ নিরপেক্ষ নির্বাচনের সহায়ক শক্তি?

দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির কার্যক্রম শুরু করা দরকার। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করেছে। ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত পরিসরে সংলাপ হবে নিশ্চয়ই। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। জনগণ আশা করে যৌক্তিক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে এই সরকার সফল হবে।


আরো সংবাদ



premium cement