শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা ও বাস্তবতা
- মো: নূরুল হক
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫১
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনা নাগরিক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন জেলায় সংঘটিত এসব ঘটনা উদ্বেগজনক। এ নিয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার জরুরি। একই সময়ে আমরা দেখেছি যে, অনেক সম্মানিত ও যোগ্য শিক্ষককে তাদের পদ থেকে পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। শিক্ষকরা, যেকোনো উন্নত ও সভ্য জাতির স্র্রষ্টা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে তারা অত্যন্ত সম্মানিত। তবে, আমাদের শিক্ষকরা যখন ছাত্রদের হাতে অপমানিত এবং লাঞ্ছিত হন- সেটি শুধু মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারকই নয়, এটি আমাদের সবার জন্য একটি সতর্কবার্তাও বটে।
এটি আমাদের প্রাচীন মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। অ্যারিস্টটল তার শিক্ষকদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মের জন্য আমার পিতা-মাতার কাছে ঋণী, কিন্তু আমার জীবনের জন্য আমি আমার শিক্ষকদের কাছে ঋণী।’ তবে, রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক এবং ধর্মীয় উত্থান-পতনের কারণে সময়ের সাথে সাথে এই মূল্যবোধ ও নীতির অবনতি এবং ক্ষয়ে গেছে। আমাদের, সমাজ হিসেবে, এখনই এগিয়ে আসার এবং এই মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করার সময়। আমরা সবাই, সমাজের সদস্য হিসেবে, এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি এবং এখনই পদক্ষেপ নেয়ার সময়।
কিন্তু এখন প্রশ্ন এবং কৌতূহল জাগে যে, কেন এতসংখ্যক শিক্ষককে বরখাস্ত ও অপমানিত করা হচ্ছে যখন অন্যদের পদত্যাগ না করতে অনুরোধ করা হচ্ছে? এই প্রশ্নের রহস্য উন্মোচন করতে হলে আমাদের শেখ হাসিনার পতিত শাসন ও তার সহযোগীদের ইতিহাস এবং দেশের সর্বস্তরের শিক্ষকদের সাথে তাদের পক্ষপাতিত্বের দিকে নজর দিতে হবে।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান দলীয় আনুগত্য ও চাটুকারিতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার বলে নয়। এই প্রধানরা দলীয় উদ্দেশ্যে কাজ করেছেন এবং তাদের শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর পরিবর্তে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্তাদের ব্যাগ বহন করেছেন। অধিকন্তু এই শিক্ষকরাই বাংলাদেশের মূল ইতিহাস বিকৃত করেছেন এবং শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেছেন, যা একজন শিক্ষকের নৈতিক বিচ্যুতি। কিছু শিক্ষক শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করেছেন এবং ছাত্রদের তাদের অধীনে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেছেন।
শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর স্বাদ ও আনন্দ তাদের কাছে এতটাই তুচ্ছ হয়ে গেছে যে, এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, যদি তাকে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ দেয়া হয় তবে তিনি তা মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করবেন এবং দ্বিতীয়বার ভাবার আগেই তার ভিসির পদ ত্যাগ করবেন। আমাদের অনেক শিক্ষক জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পিতৃত্বকে আধ্যাত্মিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তরুণদেরকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিমণ্ডিত করতে বা তার ছবির সামনে মাথা নত করতে বাধ্য করেছেন, যা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করেছে।
কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং জনগণের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন নির্দয় পুলিশ এবং ছাত্রলীগের নৃশংস গুলিতে তরুণ ছাত্ররা নির্মমভাবে আহত ও নিহত হয়েছিল। এই সময়ে পক্ষপাতদুষ্ট প্রধান ও শিক্ষকরা আমাদের ছাত্রদের এই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণে বাধা দিয়েছিল এবং হুমকি দিয়েছিল। এমনকি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের ভয় দেখিয়েছিল। এই ঘটনাগুলো সেই পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষকদের প্রতি অবিশ্বাস্য ক্রোধ ও ঘৃণা সৃষ্টি করেছিল।
তবে, আমাদের দেশের মানুষ শিক্ষকদের সম্মান ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখতে চায়, কারণ তারা জাতির নির্মাতা। তারা জ্ঞান, সত্য এবং সৌন্দর্যের মাধ্যমে ছাত্রদের হৃদয় প্রজ্বলিত করবে। আমাদের শিক্ষকদের অসম্মান করা এবং তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা আমাদের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি আমাদের নাগরিক সমাজের জন্য একটি অশুভ পূর্বাভাস। শিক্ষকদের যেমন অপরাধের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তেমনই অন্য দিকে আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদরা তাদেরকে কিছু ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য করেছেন, যা আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের জন্য অপ্রত্যাশিত।
পতিত সরকার অত্যন্ত চতুরতার সাথে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে তাদের হাতের পুতুলের মতো অভিনয় করার জন্য পরিকল্পনা করেছে। তাই, আমাদের বিদ্রোহী এবং বিজয়ী ছাত্রদের বোঝা উচিত যে, আমাদের শিক্ষকরা নির্দোষ এবং আমাদের গর্ব। তাদের মর্যাদা নষ্ট করে, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করছি। যদি আমাদের কোনো অভিযোগ বা অভিযোগ থাকে, আমরা তা রাষ্ট্রের বিদ্যমান নিয়ম ও বিধির ভিত্তিতে আইনত এবং নৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারি।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও সরকারি ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সমস্যার ইঙ্গিতগুলো সাম্প্রতিক শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর প্রবণতায় স্পষ্ট। সমাজের স্তম্ভ হিসেবে এবং দেশের ভবিষ্যতের স্রষ্টা হিসেবে দেখা শিক্ষকদের অবমাননা এবং অপব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রবণতা নাগরিক সমাজের মধ্যে প্রচুর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নাগরিকরা এই ঘটনাগুলোকে শিক্ষকদের সম্মান করার এবং তাদের প্রশংসা করার ঐতিহ্যগত নীতির অবনতি হিসেবে দেখছে।
এই সমস্যার মূল কারণটি দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকরণের মধ্যে নিহিত। অনেক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং অধ্যাপককে তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়; বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত করা হয়েছে, যার ফলে একটি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক এজেন্ডা ব্যক্তিগত স্বার্থকে অ্যাকাডেমিক সততার ওপরে স্থান দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, যখন শিক্ষকদের ওপর বিশেষ রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচারের জন্য ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে ইতিহাসকে পরিবর্তিত করা এবং শ্রেণিকক্ষে রাজনৈতিক স্লোগান চাপিয়ে দেয়া তার অন্তর্ভুক্ত।
তবুও, এই পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা ন্যায়সঙ্গত হলেও, উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিরক্তি থেকে প্রভাবিত হলেও, এই প্রতিক্রিয়া শিক্ষকদের প্রতি দেয়া উচিত সম্মান এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকি তৈরি করে। এই সমস্যার কার্যকর মোকাবেলা করতে, শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতি থেকে মুক্ত করা, শিক্ষকদের জন্য আইনগত সুরক্ষা বাড়ানো এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংযোগের চেয়ে তাদের যোগ্যতা ও অ্যাকাডেমিক সাফল্যের ভিত্তিতে নির্বাচন ও মূল্যায়ন করা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
সরকার, নাগরিক সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে বাংলাদেশের শিক্ষাপেশার সম্মান ও মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। শিক্ষকদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা চাপ ছাড়া পরামর্শদাতা এবং গাইড হিসেবে তাদের দায়িত্বগুলো কার্যকরভাবে পালন করার জন্য কর্তৃত্ব এবং স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা অপরিহার্য। এই বিষয়টির মোকাবেলা করা প্রয়োজনীয়, কারণ এটি সরাসরি শিক্ষকদের কল্যাণের ওপর প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এবং পরিণামে পুরো জাতির ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আইইউবিএটি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা