২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নির্বাচনের আশা, ভূরাজনীতির ছায়ায়

নির্বাচনের আশা, ভূরাজনীতির ছায়ায় - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে তুলনারহিত এক ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান দেখল দেশবাসী। ১৬ বছর পর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর ছাত্র-জনতা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে আগে এমনটি দেখা যায়নি। বলা যেতে পারে, এ এক অভূতপূর্ব বিজয়। এখন মানুষের চাওয়া অনুযায়ী একসময় অবশ্যই ভোট হবে, যে ভোটের দেখা এ দেশের মানুষ পায়নি বিগত তিনটি নির্বাচন নামের প্রহসনে।

প্রক্সি পার্লামেন্ট বাতিল হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক ছাত্রনেতারা বলছেন, কোটা সংস্কারই শুধু নয়, আরো অনেক কিছু সংস্কার তারা করতে চান। এটিকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার। সবাই তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সেই ধারায় এগোচ্ছে দেশ।

বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলোয় নির্বিঘ্ন জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে, হয়ে আসছে। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের অভাবে সরকারের পতন হচ্ছে, এক জোটের বিদায় আরেক জোট আসছে। কোথাও বা মধ্যবর্তী নির্বাচনও হচ্ছে। কিন্তু এই ধারায় ছিল না বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশীদের জন্য দীর্ঘশ্বাসের কারণ ছিল। নেপালে ২০২২ সালে নির্বাচন হয়েছে, পাকিস্তানে নির্বাচন হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

মালদ্বীপে নির্বাচন হয়েছে। একেবারে হালে পাশের দেশ ভারতেও নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ এই লেখার বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা এতটাই অকার্যকর যে, তা বদলানোর তাগিদ অনুভূত হচ্ছে সব মহলে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোই ধ্বংস করে গেছে। তারা সম্ভবত এমন একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চেয়েছিল, যা তাদেরকে আজীবন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে। তবে শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ফল দেয়নি। বিরোধী দলগুলো ১২ বছর ধরে আন্দোলন করার পরও তাদের টনক নড়েনি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি বলে আওয়ামী লীগকে শেষ পর্যন্ত চরম শিক্ষা পেতে হলো। এমনই বলছেন বিশ্লেষকরা। এটিই যেকোনো স্বৈরশাসকের পরিণতি।

নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। আবার তা মেটানোরও কিছু ব্যবস্থা থাকে। এসব বিরোধের কারণেই বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। তিনটি নির্বাচন সে ব্যবস্থায় হয়েছে এবং এর সুফল জনগণ ভোগ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ অযাচিতভাবে সে ব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর কালিমা লেপন করে। আশার কথা আওয়ামী লীগের তৈরি ব্যবস্থায় আগামী নির্বাচন হচ্ছে না। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর এখন কোনো দলীয় সরকার নেই। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। বলা যায়, প্রকারান্তরে সেই নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাই ফিরে এলো। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের কথাও বলছে। সেই আলোকে এ লেখায় কিছু কথা বলতে চাই।

বিশ্বে পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসিতে দু’টি নির্বাচন ব্যবস্থা আছে। একটি ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা এফপিটিপি হিসেবে পরিচিত। ঘোড়দৌড় থেকে রূপক হিসেবে এ নামটি এসেছে। এর মানে যে রেসের সময় প্রথম পোস্ট অতিক্রম করতে পারে। প্রার্থীদের মধ্যে যিনি এক ভোট হলেও বেশি পাবেন তিনি নির্বাচিত হন এ ব্যবস্থায়। আরেকটি ভোট ব্যবস্থা আনুপাতিক হারে ভোট বা প্রোপোরশনাল ভোট। দলগুলো মোট প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন ভাগ করে নেবে। আগে থেকে সাবমিটকৃত তালিকা অনুযায়ী তা করা হবে। এখানে প্রার্থী টু প্রার্থী ভোট না হওয়ায় ক্যাওস বা গণ্ডগোল হট্টগোল কম হয়। কিছু কিছু দেশে দুটোর সমন্বয় আছে। একটি অংশের ভোট হয় ফার্স্ট পাস্ট সিস্টেমে আর কিছু হয় আনুপাতিক হার হিসেবে। এর বাইরে কোনো কোনো দেশে সংরক্ষিত নারী, সংখ্যালঘু বা রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিবেচনাধীন কিছু আসন থাকে। তার আলোকে আসন নির্ধারিত হয়।

কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। প্রথমেই বেছে নিচ্ছি নেপালকে। কারণ দেশটিতে আমাদের মতোই রাজনৈতিক বিরোধ ইত্যাদি ছিল। তার আগে ছিল রাজতন্ত্র। প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর তারা নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার করে এমন একটি স্থানে আসতে পেরেছে যেখানে ঝামেলা কম। লক্ষ করার বিষয়, ২০২২ সালে নির্বাচন হওয়ার পর দেশটিতে এ নিয়ে তিন দফা সরকার পরির্বতন হলেও সেখানে কিন্তু খুব বেশি বিরোধ দেখা দেয়নি। নতুন নির্বাচনের আয়োজনও করতে হয়নি। কোনো কোনো দেশে বছরে একাধিক সাধারণ নির্বাচন করতে হয়েছে- এমনটি দেখা গেছে। কোন মন্ত্র বলে নেপালে তিনবার সরকার বদল হলেও পার্লামেন্ট অটুট থাকল এবং নতুন নির্বাচনের প্রয়োজন হলো না তা একটু দেখার চেষ্ট করি।

’২২ সালের নির্বাচনে কোনো দল সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ২৭৫ আসনের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয় নেপালি কংগ্রেস। তাদের এমপির সংখ্যা ৮৯। সিপিএন (ইউএমএল) হয় দ্বিতীয়, আসন সংখ্যা ৭৯। আর সিপিএনের (মাওয়িস্ট সেন্টার) রয়েছেন ৩২ জন এমপি। নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন পাঁচদলীয় জোটের শরিক হিসেবে ভোটে লড়েছিল পুস্পকমল দাহল প্রচন্ডের দল সিপিএন (মাওয়িস্ট সেন্টার)।

কিন্তু নেপালি কংগ্রেস প্রধান শের বাহাদুর দেউবা অর্ধেক মেয়াদের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব চুক্তি অনুযায়ী প্রচন্ডকে দিতে অস্বীকার করায় নির্বাচনের পর জোট ভেঙে যায়। কে পি শর্মা ওলির সিপিএন (ইউএমএল), রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি (আরএসপি) এবং ছোট দলের সাথে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন প্রচন্ড। কিছু দিন যেতেই সরকার পরিচালনায় সঙ্কট দেখা দেয় এবং ওলির দল সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর দেউবার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেস প্রচন্ডকে সমর্থন করলে টিকে যায় প্রচন্ড সরকার। জুলাই মাসে আবার সঙ্কট দেখা দেয়। দেউবা সমর্থন প্রত্যহার করায় প্রচন্ড সরকারের অবসান ঘটে। এরপর তেলে জলে মিশ খাওয়ার মতো অবস্থা হয়। নেপালের দুই প্রধান দল কংগ্রেস ও সিপিএন (ইউএমএল) সরকার গঠনে সম্মত হয়। কেপি শর্মা ওলি ২২ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন ১৫ জুলাই। এখানে দেখার বিষয় হলো- ১৯ মাসে তিন বার সরকার পরিবর্তন হলেও নতুন নির্বাচন আহ্বান করা হয়নি। রাজনীতিতে বিরোধ থাকবে, সমর্থন প্রদান ও প্রত্যাহার বা দরকষাকষি থাকবে, কিন্তু সিস্টেম ভালো হলে ঘন ঘন নির্বাচন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর ভোট সুষ্ঠু হওয়াড কারো মধ্যে কোনো আপত্তি থাকে না।

বলতে গেলে অনন্য এক নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে নেপালে। একজন বিশ্লেষক লিখেছেন, নেপালের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলক সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ী বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেখানে জাতীয় পার্লামেন্টের পাশাপাশি প্রদেশগুলোর জনপ্রতিনিধি সভাও সরাসরি ভোটে গঠিত হয়। দেশটিতে জাতীয় ফেডারেল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যসংখ্যা ২৭৫। এর মধ্যে ১৬৫ জন (৬০ শতাংশ) সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন।

বাকি ১১০ জন (৪০ শতাংশ) দলগুলোকে দেয়া হয় তাদের সর্বমোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হিস্যা অনুযায়ী। নিজ নিজ প্রার্থী মনোনয়নের সময় দলগুলোর জন্য নারী, দলিত, আদিবাসীসহ অনেক জনগোষ্ঠীকে মনোনয়ন দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। যেমন- দলগুলোর জনপ্রতিনিধিদের ভেতর এক-তৃতীয়াংশ নারী থাকতে হয়। অন্য দিকে সাতটি প্রদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন ৫৫০ জন। এর ৬০ শতাংশ (৩৩০ জন) সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং বাকি ৪০ শতাংশ আসন (২২০ জন) দলগুলোর আনুপাতিক ভোটের হিস্যামতো পায়। জাতীয় ও প্রাদেশিক জনপ্রতিনিধিরা আবার বিশেষ নিয়মে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৫৬ সদস্য নির্বাচন করেন (প্রতি প্রদেশে আটজন)। প্রতিনিধি পরিষদের ২৭৫ জন এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৫৯ জন (তিনজন প্রেসিডেন্টের মনোনীত) মিলে নেপালের ফেডারেল পার্লামেন্ট।

আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের ভোট ব্যবস্থা কী রকম দেখা যাক। বিশে্বর সব চেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা লোকসভার আসন ৫৪৩টি। সরাসরি বা এফপিটিপি ভোটে সবাই নির্বাচিত। আছে উচ্চকক্ষ বা রাজ্যসভাও। এ ছাড়াও আছে দেশের প্রতিটি রাজ্যের আলাদা আইনসভা বা রাজ্য বিধানসভা। সেখানেও সরাসরি ভোটে এমপি ও এমএলএ নির্বাচিত হন।

পাকিস্তানে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৩৩৬ জন সদস্য। ২৬৬টি সাধারণ আসন নির্বাচনী এলাকায় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট ভোটে নির্বাচিত হয়। সাধারণ আসনের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ৭০টি সংরক্ষিত আসন মহিলা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য। পরে তা দলের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় প্রত্যক্ষ ভোটে। পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২২৫। তাদের মধ্যে ১৯৬ জন সারা দেশের ২৫টি প্রশাসনিক জেলা থেকে সরাসরি ভোটে জিতে আসেন। বাকি ২৯ জন এমপি মনোনীত হয়ে আসেন- কোন দল কত ভোট পাচ্ছে, সেই অনুপাতের ভিত্তিতে। ভোটের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। ভোটে যেকোনো নির্বাচনী কেন্দ্রে কোনো দলেরই নির্দিষ্ট প্রার্থী নেই। ব্যালট পেপারে ভোটারদের দাগিয়ে আসতে হয় প্রার্থীদের মধ্যে কে তার প্রথম পছন্দ, কে দ্বিতীয়, কে তৃতীয়। প্রতিটি দলকে মোট ভোটের অনুপাত অনুসারে প্রতিটি জেলার জন্য কোটা থেকে কয়েকটি আসন বরাদ্দ করা হয়। তবে দেশটিতে পার্লামেন্ট আলঙ্কারিক।

মালদ্বীপও প্রেসিডেন্টশাসিত। পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ৮৮। ৮৮ জন সদস্য নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে সরাসরি ভোটে বা এফপিটিপি ব্যবস্থায় নির্বাচন হয়। আর ভোটের ফলের ভিত্তিতে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টন করে দেয়া হয়। এখানে প্রধান দলগুলোর মধ্যে বিরোধ এতটাই যে, নির্বাচনী সংঘর্ষ লেগেই থাকে। ফল প্রকাশের পর দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখা দেয়। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্য আনুপাতিক হারে ভোটে যাওয়া একটি ভালো ব্যবস্থা হতে পারে। এ নিয়ে অনেক দিন ধরে লেখালেখি হচ্ছে, অনেকে দাবিও জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সবগুলো আসনে সম্ভব না হলেও ৫০ শতাংশ আসনে সরাসরি নির্বাচন না করে আনুপাতিক হারে ভোট হতে পারে। এতে সঙ্ঘাত কমে আসতে পারে। বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। দ্বিতীয়ত, দেশের পার্লামেন্টকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার দাবি আসছে। সেটিও বিবেচনা করা যেতে পারে। নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের নিজেদের স্বার্থেই প্রয়োজন।
সংবিধানে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নেই। সেটি ফিরিয়ে আনা দরকার। অতীতে দেখা গেছে, এ ব্যবস্থাতেও কিছু কিছু সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বা কোনো না কোনো ব্যত্যয় থেকে যায়। আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থার দিকে গেলে এসব সঙ্কট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যাবে।

লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement