গণ-অভ্যুত্থান ও আগামীর বাংলাদেশ
- ড. মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
- ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭
ছাত্রসমাজ ও জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পাশের দেশে পালিয়ে যান। এক মহাপরাক্রমশালী স্বৈরাচারের পতন ঘটে।
বাংলাদেশের অতীতের গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের সাথে সাম্প্রতিক আন্দোলনের পার্থক্য রয়েছে। এবারের আন্দোলন দ্রুত তীব্রতা লাভ করে এবং স্বল্পসময়ে অনেক রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কোনো কোনো গণমাধ্যমে এক হাজারের বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত হলে হতাহতের সংখ্যা এ যাবৎ পাওয়া সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
সাধারণভাবে ছাত্রসমাজ কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করলেও প্রায় দীর্ঘ ১৬ বছর একটি দলের জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন একদলীয় স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থায়, অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, গুম, বৈষম্য, বাকস্বাধীনতা হরণ, প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা বন্ধসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও সংস্থা, কমিশন, অধিদফতর সর্বত্র একচ্ছত্র দলীয়করণের মাধ্যমে একক ক্ষমতায় নিয়ে জনগণকে তাদের মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণে জনগণের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় ছিল। ছাত্র-জনতার ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনে দেশের সব শ্রেণিপেশাসহ সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বৈরশাসককে পদত্যাগে বাধ্য করতে সক্ষম হয়। সর্বস্তরের মানুষের প্রচুর রক্ত, জীবনদানের মধ্য দিয়ে এ বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছে।
নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের কাছে শিক্ষার্থী ও সর্বস্তরের জনসাধারণের অন্যতম চাওয়া- বাংলাদেশকে শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। কাজটি সহজ নয়। তারপরও এ সরকারকে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। জোরপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দীর্ঘ ১৬ বছরের একদলীয় শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভোটাধিকার রহিত করা হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির বিকাশ ও প্রসারের পথ উন্মুক্ত করেছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অনেককে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করেছে, কাউকে অব্যাহতি দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। যেনতেনভাবে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছামাফিক নির্বাচন আয়োজন ও ফলাফল ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের ব্যাংক ও বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা অর্থ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট আর্থিক রেগুলেটরি সংস্থাগুলো অর্থলুণ্ঠনকারী ও ঋণখেলাপিদের সর্বোচ্চ ছাড় ও সুবিধা দিয়ে অর্থলুণ্ঠন ও পাচারে সহযোগীর ভূমিকায় ছিল।
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মৌলিক মান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সব সংস্থাই একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতায় পরিচালিত হতো। এ করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ছাত্র ও জনতার আকাক্সক্ষা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বল্পমেয়াদে যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করে তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। আন্দোলন ও সংগ্রামে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। ছাত্রসমাজ ও জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি ও হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। মানুষের জীবনধারণের জন্য আবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ। বিশেষ করে চাল ডাল লবণ তেল আলু পেঁয়াজ রসুনসহ জরুরি ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা।
এ ছাড়া ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের ক্ষতিসাধনকারী টাকাপাচারকারী ব্যাংকিং খাতের বড় বড় ঋণখেলাপিকে দ্রুত গ্রেফতারের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ও সঠিক বিচারের ব্যবস্থা করা। দেশের রিজার্ভ-সঙ্কট উত্তরণের ব্যবস্থা ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া। সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তথা কমিশন, সংস্থা, অধিদফতরগুলোয় পদায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ। বিশেষ করে যারা যোগ্যতাসম্পন্ন; কিন্তু বিগত দিনে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের যথাযথ মূল্যায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগে সততা, দেশপ্রেম ও যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের মাঝ থেকে পদায়ন প্রয়োজন। উজানে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়া এবং অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে দ্রুত উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সমাজ ও রাষ্ট্রের সব স্তর ও পর্যায়ে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ। রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রের সংবিধান, রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সংস্থা, কমিশন, অধিদফতর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ফাইন্যান্সিয়াল সব সংস্থার বিধিবিধান ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা অনুসারে ঢেলে সাজানো। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বিগত দিনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ।
মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি করা। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে যে দুষ্টচক্র ও টাকাপাচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় এনে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ। আর্থিক খাত তথা ব্যাংকিং ও বীমা খাতে সংঘটিত সব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত করা ও ব্যাংক ও বীমা খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন। ব্যাংক ও বীমা সংস্থার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ ক্ষমতা প্রদান এবং এ ক্ষেত্রে সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের পদায়নের ব্যবস্থা করা।
সাধারণ জনগণ ও ছাত্রসমাজের আবেগ ও ইচ্ছার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানো ও জনগণের জবাবদিহির মুখোমুখি করা। ছাত্রসমাজ ও আপামর জনতার রক্তস্নাত এ অভ্যুত্থানকে যথাযথ কার্যকর ও অর্থবহ করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর ও পর্যায়ে বৈষম্য সৃষ্টিকারী কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সাম্প্রতিক রক্তস্নাত বিজয় ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধমে প্রতিষ্ঠিত নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপামর ছাত্র ও জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সঠিক ও বাস্তবধর্মী কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবে। এটাই সব মহলের প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা