১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

আদালতের রাজনৈতিক রায়ে সংবিধান সংশোধনী

আদালতের রাজনৈতিক রায়ে সংবিধান সংশোধনী - ছবি : সংগৃহীত

১৯৭২ সালে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে অবস্থিত ‘মুন সিনেমা হল’-এর জমি ও সিনেমা হলকে তৎকালীন সরকার ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ ঘোষণা করে তা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে প্রদান করে। তখন ওই সম্পত্তির মালিক মাকসুদ আলম সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। ১৯৭৭ সালে হাইকোর্ট ওই সম্পত্তি ফেরত দেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৯৭৭ সালের সামরিক আইনের ৭ নং বিধানের বলে হাইকোর্টের ওই আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে গেছে। সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে ১৯৯৪ সালে মাকসুদ আলম আবার হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। তখন তার আবেদন আবার প্রত্যাখ্যান করা হয়। মাকসুদ আলম ২০০৩ সালে সামরিক আইনের ৭ নং বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে ২৯ আগস্ট বিচারপতি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবিরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ শুধু ৭ নং বিধানই নয়, সামরিক আইন জারিকেই অবৈধ ঘোষণা করে এক যুগান্তকারী রায় দেয়।

যখন এ রায় ঘোষিত হয় তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। হাইকোর্টের রায়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা বিবেচনা করে, তখন সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করে। মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আবার সরকার গঠিত হওয়ার পর তারা মামলাটি সম্পর্কে ভিন্ন অবস্থান নেয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের দায়ের করা আপিল খারিজ করার আবেদন করেন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও আরো তিনজন আইনজীবী মামলার পক্ষ হওয়ার আবেদন করেন।

২০০৯ সালের ৪ মে সুপ্রিম কোর্ট আলোচ্য রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত ‘লিভ টু আপিল’ দাখিল করার জন্য চার সপ্তাহের সময় দেন। ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, সরকার পঞ্চম সংশোধনীসংক্রান্ত আপিলের মামলাটি চালাতে আগ্রহী নয়। তিনি একই সাথে মামলার রায় স্থগিতকরণের আদেশ বাতিলেরও আবেদন করেন। সরকারের আবেদন সুপ্রিম কোর্ট মঞ্জুর করে। তখন আইনমন্ত্রী জানান, যেহেতু আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে; তাই হাইকোর্টের রায়ই বহাল রইল। হাইকোর্টের রায়ের ফলে সংবিধানে যেসব পরিবর্তন আসে তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান ও অবিচল আস্থা’ অংশটি বাতিল ঘোষিত হয়। এর পরিবর্তে ফিরে আসে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লিখিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।

রাষ্ট্র পরিচালনার আরেকটি মূলনীতি ‘সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’-এর ‘সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে’ অংশটুকু বাদ দিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লিখিত শুধু ‘সমাজতন্ত্র’ পুনর্বহাল করা হয়।

বাংলাদেশের নাগরিকরা ‘বাংলাদেশী’ বলে পরিচিত হবেন, এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লিখিত ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত হবেন; অর্থাৎ ‘বাঙলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ পুনর্বহাল করা হয়।

পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ‘মুসলিম দেশগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব জোরদার’ করার অংশটি বাদ দেয়া হয়।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বা পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ বলে কিছু চিহ্নিত ছিল না। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় যে, এসব মৌলিক কাঠামো কোনো দিন সংশোধন করা যাবে না।

পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের ফলে অতীতের সামরিক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সে হিসেবে তাদের শাসনকালে প্রণীত আইন, বিধিবিধান ও আদেশও অবৈধ। এমনকি তাদের সিদ্ধান্তের কারণে যে গণভোট হয়েছে, জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য যে নির্বাচন হয়েছে এবং তার মাধ্যমে যে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে তা সবই বেআইনি ঘোষণা করা হয়। সেই সংসদ যেহেতু বেআইনি, সেহেতু পঞ্চম সংশোধনীও বেআইনি।

আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর বিএনপির আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও বিচারপতি টি এইচ খান বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এমন অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলায় লিভ মঞ্জুর হলো না, সেটি চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। লিভ মঞ্জুর হবে, বাদি ও বিবাদি উভয়পক্ষ তাদের যত আর্গুমেন্ট আছে সব পেশ করবেন এবং তার পর বিজ্ঞ বিচারকরা তাদের রায় দেবেন, তেমনটিই নিয়ম। কিন্তু এ মামলায় লিভও দেয়া হলো না এবং মাত্র ছয় দিনে শুনানির পর লিভ খারিজ করা হলো। এটি অস্বাভাবিক।’এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলায় সংশোধন ও পর্যবেক্ষণের কথা বলা হলো, অথচ সংশোধন ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই লিভটি খারিজ করে দেয়া হলো- এমন ঘটনা তিনি কখনো দেখেননি বলে বিচারপতি টি এইচ খান মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের এ ভূমিকার মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক বিপদের বীজ রোপিত হলো। এ রায়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল বা ঘরানার মতামতই প্রতিফলিত। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন সেদিন বলেছিলেন, আপিল বিভাগের এ পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার সাথে সাথেই সংবিধান সংশোধন হয়ে গেল। এ জন্য জাতীয় সংসদে আর কোনো বিল উত্থাপনের প্রয়োজন নেই। রায় ঘোষণার কিছু দিন পরে সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য ১৫ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করে। ড. কামালের মতে, ওই কমিটির আপিল বিভাগের রায়ের ক্ষেত্রে কিছু করতে পারবে না।

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি মামলা হলে আদালত তার রায়ে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে সংবিধানে বিভিন্ন মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কেউ সেগুলো চ্যালেঞ্জ করেনি। ফলে জনগণ এসব সংশোধনী গ্রহণ করেছেন এবং এসব সংশোধনী সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীকে সম্পূর্ণভাবে আইনসঙ্গত বলে যে রায় দিয়েছিল ২০১০ সালে সেই সর্বোচ্চ আদালত আবার তাকেই বেআইনি বলছে। এ বিষয়ে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, পঞ্চম সংশোধনীর প্রশ্নটি শুধু আইনগত বিষয় নয়; এটি মূলত একটি রাজনৈতিক বিষয়। সেই রাজনৈতিক বিষয়কে ফয়সালা করার জন্য আদালতে টেনে আনা উচিত হয়নি। এর সুরাহা হওয়া উচিত ছিল রাজপথে বা সংসদে।

সপ্তম সংশোধনী বাতিল : আদালত কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের চূড়ান্ত রায়ের কিছু দিন পরই ২০১০ সালের আগস্টে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে দেয়। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ওই রায় ঘোষণা করে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী রায়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :

১. ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সমস্ত সামরিক ফরমান ও বিধিবিধান অবৈধ ঘোষণা;

জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী, তার শাস্তি হওয়া উচিত; তাকে মার্জনা করার কোনো সুযোগ নেই;

ধারাবাহিকতার জন্য যেসব পদক্ষেপ ওই সময় গৃহীত হয়েছিল সেগুলো মার্জনা করা হলো;

জেনারেল এরশাদ ও জিয়াউর রহমান দালাল এবং তারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসিত করেছেন;
ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে জিয়া সংবিধান ধ্বংস করেছেন এবং জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেছেন;

জিয়া ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরসহ অনেককে ফাঁসি দিয়েছেন। তার এসব কর্মকাণ্ডকে কোনোভাবেই মার্জনা করা যায় না।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়কে অনেকেই তখন একটি রাজনীতিবিষয়ক রায় বলে অভিহিত করেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল : ১৯৯৬ সালে তিনজন আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে দেয়। বলা হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তথা ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ও সংবিধানসম্মত আইন। ওই আইনজীবীরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। আদালত তাদেরকে সাহায্য করার জন্য ১০ জন এমিকাস কিউরি বা আদালতবান্ধব আইনজীবী প্যানেল নিয়োগ করে। এরা ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ব্যারিস্টার এম এ জহির, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, বিচারপতি টি এইচ খান, বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী, ব্যারিস্টার আজমালুর হক কিউসি প্রমুখ। এ ১০ জনের ৯ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে বলিষ্ঠ মত দেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ রায় দেন যে, তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানপরিপন্থী। তাই সেটি বাতিল করা হলো। তবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আগামী দশম সংসদ নির্বাচন ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভিত্তিতেই হতে পারে।

আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়া : এ প্রসঙ্গে সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এটি জাতির সাথে প্রতারণা। জাসদ সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, পরিবর্তিত সংবিধান সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী সংবিধান। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও বিকল্পধারার চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরীও একই মত ব্যক্ত করেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করে। বিশিষ্ট লেখক ফরহাদ মজহার বলেন, সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না। ডেইলি নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবীর, প্রফেসর আসিফ নজরুল থেকে শুরু করে অনেকেই একই অভিমত ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই সংবিধানকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বারবার সঙ্কট তৈরি করেছে। তাদের উদ্যোগে চতুর্থ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশকে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদীয় কমিটি : উল্লেখ্য, ২০১০ সালে সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদ সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের কাছ থেকে স্বাধীন মতামত দেয়ার আহ্বান জানায়। এদের মধ্যে ছিলেন চারজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, শীর্ষ আইনজীবী, সুশীলসমাজের নেতা ও সংবাদপত্রের সম্পাদকরা। তারা সবাই কেয়ারটেকার সরকারের পক্ষে মত দেন। বিভিন্ন মহলের সাথে বৈঠকের অংশ হিসেবে কমিটি ২৭ এপ্রিল ২০১০ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে বসলে তিনি সরকারি ও বিরোধী দল থেকে পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে ১০ জনের কেয়ারটেকার সরকার হতে পারে এবং সেই সরকারের মেয়াদ হবে ৯০ দিন। একই বৈঠকে সুরঞ্জিত বাবু প্রস্তাব করেছিলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ মোতাবেক উচ্চ আদালতের বিচারপতিদেরকে ইমপিচ বা অভিসংশন করতে পারবে জাতীয় সংসদ। কিন্তু শেখ হাসিনা সেই সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে ওই ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে রাখার সুপারিশ করেন। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে কমিটি ৩০ মে ২০১০ শেষবারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিলের পক্ষে তার মত ব্যক্ত করেন। এমনকি তিনি আগামী দু’টি নির্বাচন আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টিও আমলে নিতে রাজি হননি।

সংসদ কর্তৃক সংবিধানের সংশোধনী : ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করে। আদালতের এক রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে ব্যাপক সংশোধন আনা হয় এবং ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনেক অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হয়। এসব সংশোধনী বিতর্কের সৃষ্টি করে।

পঞ্চদশ সংশোধনী : ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এ ছাড়া অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান করা হয়। অন্য দিকে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনর্বহাল করা হয়। এ ছাড়া এ সংশোধনীর দ্বারা বেশ কিছু অনুচ্ছেদ অপরিবর্তনযোগ্য ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার ছবি প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।

ষষ্ঠদশ সংশোধনী : ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার বিচারপতিদের অক্ষমতা ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপসারণের বিধান করে। অবশ্য ২০১৬ সালের ৫ মে সুপ্রিম কোর্ট ওই সংশোধনী সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে বাতিল করে।

সপ্তদশ সংশোধনী : ২০১৮ সালের ৮ জুলাই জাতীয় সংসদ সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০টি পরবর্তী ২৫ বছরের জন্য নির্ধারণ করে।
পঞ্চদশ সংশোধনী ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের কট্টরপন্থী ও মহাজোটের বাম শরিকদের আবদারকে পাত্তা না দিয়ে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ বহাল রাখেন। জানা যায়, সংবিধান সংশোধনের বিলটি মন্ত্রিপরিষদে আলোচনাকালে পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ বহাল রাখার বিরোধিতা করলে প্রধানমন্ত্রী তাকে বেশ কড়া ভাষায় শাসন করেন। উল্লেখ্য, পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার ছিলেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের একজন শীর্ষ নেতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সভায় বলেছিলেন, “পরিস্থিতির কারণে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ রাখতে হচ্ছে।” সংসদীয় কমিটি সংবিধান সংশোধনী বিলের ওপর রিপোর্ট পেশকালে উল্লেখ করে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বিষয় তাদের ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে হয়েছে। তখন কারো এটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবে একমাত্র শেখ হাসিনার ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। শেখ হাসিনার কথা থেকে মনে হয়েছে, তিনি শেষ মূহূর্তে কৌশলগত কারণে হয়তো মহাজোট সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টির সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইছিলেন না এবং জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করতেও চাননি। তবে তিনি তার বাবার রেখে যাওয়া রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বিষয়ে শক্ত অবস্থান নেন এবং এ জন্য সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ তুলে দিয়ে তার স্থলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য, বিগত ৫০ বছরে বিষয়টি নিয়ে দেশে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও জাতির কাছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তনের কোনো অঙ্গীকার করেনি। তার মানে হচ্ছে দেশবাসীর কাছ থেকে কোনো ম্যন্ডেট না নিয়েই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংযোজন করা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, ‘কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।’ সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘আল্লাহের ওপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ বাতিল করা কি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নয়? এটি কি নির্বাচনী অঙ্গীকারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?


দেশের ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শে বিশ্বাসী কোনো দল বা আলেম সমাজ তো এটি আদৌ মেনে নেয়নি। এমনকি আওয়ামী ওলামা লীগও ‘আল্লাহর ওপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ তুলে দিয়ে তার স্থলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংযোজনের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছিল।

সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে গঠিত সংসদীয় কমিটি সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করার আগে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনা করে। অবশ্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তারা আলোচনায় অংশ নেয়নি। আরেক বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকে আলোচনায় ডাকাই হয়নি। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, দেশের অর্ধেক নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী দু’টি দলের মতামত ছাড়াই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। অপর দিকে জনগণের প্রতিনিধি নয়, এমন সংগঠনের সাথেও কমিটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছে। এদের মধ্যে আছে সংবাদপত্রের সম্পাদক, কথিত সুশীলসমাজের বাছাই করা বুদ্ধিজীবী, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ প্রভৃতি। কমিটি দেশের ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শে বিশ্বাসী কোনো দল বা আলেম সমাজের কারো সাথে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করেনি। সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করার আগে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকেই জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন ছিল। গণভোটেরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সরকার বেশ তড়িঘড়ি করে বিলটি পাস করে নিয়েছিল।


আরো সংবাদ



premium cement
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেফতার সোনারগাঁয়ে শেখ হাসিনা-শেখ রেহেনাসহ ২৩৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা গাজার চলমান ঘটনাবলী সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুল : বসনিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে ভারতের আসাম-মেঘালয় সীমান্তে আটক ৬৫ বাংলাদেশী ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম উম্মাহ'র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হোসেনপুরে স্কুলশিক্ষকের বসতঘর পুড়ে ছাই রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টির আভাস 'শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে' সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধার সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে মৎস্যচাষির মৃত্যু সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল বাবুর ওপর ডিম নিক্ষেপ

সকল