২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তাহরির স্কয়ার থেকে শাহবাগ

তাহরির স্কয়ার থেকে শাহবাগ - নয়া দিগন্ত

২০১১ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের কথা সবারই জানা। তখন মিসরের ক্ষমতার মসনদে আসীন ছিলেন স্বৈরাচারী হোসনি মোবারক। এই স্বৈরাচারের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিল সে দেশের ইসলামপন্থীরা। তার নানামুখী নির্যাতনের প্রতিবাদে মিসরের জনগণ আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেক্যুলার নেতারা। সেক্যুলার নেতৃত্ব মেনে নিয়েই ইসলামপন্থীরা মোবারকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।
প্রথম যখন মোবারকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন ইসলামপন্থীরা উভয় সঙ্কটে পড়ে যায়। কারণ এ আন্দোলনে যোগ না দিলে ইসলামপন্থীরা মোবারকের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হতো। অন্য দিকে সেক্যুলাররা আগে থেকেই ইসলামপন্থীদের সেনাবাহিনীর দালাল বলে গালাগালি করত।

আবার আন্দোলনে যোগ দিয়ে ব্যর্থ হলে মোবারক সরকার ইসলামপন্থীদের ওপর চরম মাত্রায় চড়াও হবে এমন আশঙ্কাও ছিল।

শেষমেশ তারা পরামর্শ সভার আহ্বান করে। সভায় তারা মোবারকবিরোধী আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

মাত্র ১৮ দিনের সর্বাত্মক আন্দোলনে ১১ ফেব্রুয়ারি মোবারকের পতনের সাথে সাথে আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রসংস্কারের দাবিতে সেøাগান দিতে থাকেন। তাহরির স্কয়ার থেকে ঘোষণা করা হয় যে, প্রত্যেক মিসরীয়কে সাথে নিয়ে মিসরের পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজ শুরু হবে।
১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিপুল পরিমাণ নারী-পুরুষ তাহরির স্কয়ার পরিষ্কার করার কাজে হাত দেয়। ১৮ দিন ধরে জমা হওয়া ময়লা এবং গ্রাফিতি মুছে ফেলা হয়। পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে শুরু হয় রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজ।

মোবারকের পতনের পর ২০১২ সালে মিসরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী ড. মোহাম্মদ মুরসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। অবশ্য নির্বাচন নিয়ে ব্রাদারহুড খুবই সতর্ক ছিল।
নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া নিয়ে ব্রাদারহুডের মধ্যে অনেক সংশয় ছিল। আলজেরিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে ব্রাদারহুড জানত যে, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার চেয়েও নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া বেশি বিপজ্জনক। নির্বাচনে পরাজিত হলে বিরোধী দলে থাকতে হবে। খুব বেশি হলে খানিকটা নির্যাতন হবে; কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হলে ক্যু করা হবে; সৃষ্টি করা হবে প্রতিবিপ্লব। এরপর শুরু হবে পাইকারি নিধন।
শেষমেশ ব্রাদারহুড ইলেকশনে যায়। ইলেকশনে ব্রাদারহুড ছিল অপ্রতিরোধ্য। ব্রাদারহুডকে হারানোর কোনো উপায়ই ছিল না। সর্বসাকুল্যে নানা ধরনের ছয়টা ইলেকশন হয়েছিল মিসরে। আর সবগুলোতেই ব্রাদারহুড জয়লাভ করে।

সরকার গঠনের পর মুরসি নিজেকে সব মিসরীয়ের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন ইসলামপন্থীদের ভোটে। তাই অধিকাংশ জনগণের প্রত্যাশা ছিল মিসর হোক ইসলামী রাষ্ট্র। অন্য দিকে সেক্যুলাররা চাইত রাষ্ট্রটি হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তাই মাইনরিটির শক্ত বিরোধিতা সম্পর্কে মুরসি সজাগ ছিলেন। তিনি উভয় কূল রক্ষা করেই চলছিলেন। দুই নৌকায় পা দেয়া মুরসি এক দিকে ইসলামের কথা বলতেন, অন্য দিকে সেক্যুলারদের রেড লাইনগুলোও মেনে চলতেন। বাধ্য হয়ে তিনি ইসরাইলের সাথে হওয়া সব চুক্তি মেনে চলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে ফিলিস্তিনের জন্য রাফাহ সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন। পরে তাদেরকে কোনো ধরনের সহায়তার প্রচেষ্টা চালাতে পারেননি। ফলে বরাবরের মতোই রাফাহ ক্রসিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

মুরসি যথেষ্ট রেভ্যুলেশনারি বা বৈপ্লবিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন নরম ও উদার প্রকৃতির মানুষ, ছিলেন গণতান্ত্রিক। ফলে মোবারক রেজিমের রেখে যাওয়া প্রশাসন প্রায় পুরোটাই অপরিবর্তিত ছিল। সেনাপ্রধান নিয়োগের সময় নামাজি দেখে আবদেল ফাত্তাহ সিসি নামের একজনকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সিসিকে সেনাপ্রধান বানাতে বেশ কয়েকজনকে সুপারসিডও করা হয়।

সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার কথা বললেও মিসরের সেক্যুলাররা ইসলামিস্টদের ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিল। ওদের আশা ছিল মোবারকের পর সেক্যুলার কোনো শাসক ক্ষমতাসীন হবে। ইসলামিস্টরাও মিসরে থাকবে; কিন্তু ক্ষমতা তাদের কাছে যাবে না। এই আশা পূরণ হচ্ছে না জেনে মোবারকের পতনের পর থেকেই সেক্যুলাররা নানাভাবে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। মিসর আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত কি না- এ বিষয়েও তারা তর্ক উত্থাপন করে।

মিসরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বসবাস রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কপ্টিক ক্রিশ্চিয়ান। তাদেরকে যথেষ্ট নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। তবুও কপ্টিক ক্রিশ্চিয়ানরা নির্যাতিত হচ্ছে এমন আওয়াজ তোলে। মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। তার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব অপপ্রচার শুরু করা হয়।

মুরসির ক্ষমতায় আসার এক বছর হতে না হতেই সমগ্র মিসরজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। নানান দাবিতে নানান দল এ বিক্ষোভ শুরু করে। তেলের দাম বেড়ে যায়। তেলের সঙ্কটও দেখা যায়। মুরসি সরকার নানান কসরত করেও তেলের সাপ্লাই ও দাম ঠিক করতে ব্যর্থ হয়।
এ রকম পরিস্থিতিতে ২৯ জুন ২০১৩ তারিখে তাহরির স্কয়ার আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাহরির স্কয়ারসহ প্রায় ২০ জায়গায় সেক্যুলাররা মুরসির পতনের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে।

পরিস্থিতি খুব দ্রুতই বাজে দিকে মোড় নেয়। মুরসি এটি বুঝতে পারেন। সেনাবাহিনী মুরসিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আলটিমেটাম দেয়। সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদেল ফাত্তাহ সিসিকে মুরসি প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে ডেকে পাঠান। সিসির সব দাবি শোনেন এবং মুরসি তা মেনে নেন। বৈঠকের শেষ মুহূর্তে মুরসি সিসিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আবদেল ফাত্তাহ, তুমি কি সন্তুষ্ট? তোমার কি আর কোনো চাওয়া আছে? আমাদের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি?’ জবাবে সিসি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, স্যার। আমি সন্তুষ্ট। আপনি তো সব কিছু সমাধান করেই ফেলেছেন। আমাদের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক কেন থাকবে না, স্যার?

কিন্তু এর পরও সব কিছু ঠিক হয়নি; ঠিক ছিল না। মুরসি বুঝতে পারেন সামথিং ইজ রং। আন্দোলন চলছেই। মুরসির সরকার আমেরিকার দ্বারস্থ হলো। মুরসির ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ছিলেন এসসাম এল হাদ্দাদ। তিনি ওবামার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার সুসান রাইসকে ফোন করেন। বলেন, মিসরকে বাঁচান! মিসরের গণতন্ত্রকে বাঁচান! একমাত্র আমেরিকাই পারে মিসরের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে। সুসান রাইস উত্তরে বলেন, আমেরিকা কোনোভাবেই মিসরকে, মিসরের গণতন্ত্রকে নস্যাৎ হতে দেবে না। যেকোনো মূল্যে মিসরের গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে।

জুলাইয়ের ২ তারিখে সুসানের সাথে এই ফোনকল করেন হাদ্দাদ। এই ফোনকলের পরদিন তিন তারিখে সেনাবাহিনীর হাতে আটক হন মুরসি! মুরসিকে আটক করে আবদেল ফাত্তাহ সিসি ক্ষমতা গ্রহণ করেন; কিন্তু আমেরিকা নীরবতা পালন করে। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে ক্যু বলতে অস্বীকৃতি জানায় আমেরিকা।

অথচ আমেরিকা অন্তত মার্চ থেকে জানত যে সেনাবাহিনী ক্যু করার পরিকল্পনা করছে। ইনফ্যাক্ট, আমেরিকান অনেকেই ক্যু করতে আর্মিকে উদ্বুদ্ধ করে। আমেরিকার ধারণা ছিল, ব্রাদারহুড পার্লামেন্টারি ইলেকশনে জিতলেও প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে জিতবে কোনো সেক্যুলার প্রার্থী। কিন্তু সব ইলেকশনে ব্রাদারহুড জয়লাভ করায় আমেরিকা এটি মেনে নিতে পারেনি। আরো মেনে নিতে পারেনি ইসরাইল, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত।
মূলত এসবই ছিল ষড়যন্ত্র। এ সময়ে তেলের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ কমে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল কৃত্রিম। আর্মি ইচ্ছা করেই এমনটি করেছিল, যাতে জনগণ মুরসির ওপর ক্ষিপ্ত হয়। সেক্যুলার জনগণ সত্যিই মুরসির ওপর ক্ষেপে গেল। সেনাবাহিনী সেক্যুলারদেরকে কাজে লাগাল। মুহুর্মুহু বিক্ষোভ ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে মুরসি সরকারকে অচল করে দেয়া হলো। দেশের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মুরসি কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে পারছিলেন না। শুধু একটার পর একটা ক্রাইসিস সামলাতেই তিনি ব্যস্ত ছিলেন।

মুরসি আর এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাননি। তিনি ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেক্যুলাররা ছিল সেনাবাহিনীর হাতের খেলার পুতুল। তাদেরকে সেনাবাহিনী ব্যবহার করল। সিসি ক্ষমতায় আরোহণ করল। অতঃপর সেক্যুলারদের আবার ব্যবহৃত টিস্যুর মতো ছুড়ে ফেলে দিলো। বর্তমান মিসরের সব জনগণ সিসি সরকারের ওপর বিরক্ত। এখন মিসরের সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীরা স্বীকার করে যে, মুরসি আসলে খারাপ লোক ছিলেন না, তাকে আরো সময় দেয়া উচিত ছিল।

এখন মিসরে মোবারকের চেয়েও ভয়াবহ দুঃশাসন চলছে। সেই দুঃশাসনের প্রধান কারিগর স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ সিসি। হাজারের বেশি মানুষকে রাবা স্কয়ারে সে গুলি করে হত্যা করেছে। নিরপরাধ শত শত মানুষকে সে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ জেলে রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে মুরসি কারাবন্দী হন। আর ২০১৯ সালের ১৭ জুন কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কয়েক দিন পর রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন তার ছেলে।

সম্প্রতি মিসরের চেয়েও কার্যকর একটি গণবিপ্লব বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। সেনাবাহিনী ব্যারাকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকের প্রেতাত্মারা এ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ডাকাতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের মধে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ক্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। হিন্দুবেশে শাহবাগসহ দেশের অন্তত ৪০টিরও বেশি জায়গায় সমাবেশ করানো হয়েছে। আনসারের মাধ্যমে এ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রশাসনের স্থবিরতা এখনো দূর হয়নি। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কর্মে ফিরলেও সক্রিয় নয়। আর্মিতে হাসিনা রেজিমের কর্মকর্তারা এখনো চাকরিতে বহাল। দেশের সব জনগুরুত্বপূর্ণ বড় পদে হাসিনার কর্মকর্তারা অফিস পরিচালনা করছেন।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর। হঠাৎ বন্যায় ১২টি জেলায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশে সামনের দিনগুলোতে খাদ্যঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইসলামী দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছে। এসব বাস্তবতা কি বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু ইঙ্গিত করে? এসব ঘটনার সাথে মিসরের তাহরির স্কয়ারের ঘটনার বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। আর এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, বাংলাদেশের মসনদে একজন সিসির আগমন ঠেকানো সম্ভব হবে কি?

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement