২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আন্দোলন এবারই কেন সফল হলো

আন্দোলন এবারই কেন সফল হলো - নয়া দিগন্ত

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে হয়েছে এবং এর ছিল কিছু অনন্য ও অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য। ইতোপূর্বে এই সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা তথা সরকারের আন্দোলন দমনে সফলতাগুলো বিশ্লেষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পটভূমি ও সফলতার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করব।

আওয়ামী লীগ তার আগের সব অপরাধের খতিয়ান প্রায় ধুয়ে-মুছে ২০০৯ সাথে ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সেনা অফিসার হত্যায় সরকারের মদদ ছিল এমন ধারণা সেনাবাহিনীতে প্রবল হলেও সরকারি শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে তাদের পক্ষে আন্দোলন করা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো সম্ভব ছিল না। সেনাকুঞ্জে যারা উচ্চকণ্ঠ হয়েছিল তাদের নানাভাবে দমন করে সেনাবাহিনীতে আওয়ামীকরণ শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ শাসনের শুরু থেকে যেকোনো বিরোধিতা তীব্র পুলিশি দমন-পীড়নের মাধ্যমে মোকাবেলা করেছে, সাথে ছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী। জামায়াত-শিবিরকে সর্বাত্মক নির্যাতনের নীতি নিয়েছিল, আইন ও রীতিনীতির ন্যূনতম তোয়াক্কা করেনি; বরং তাদের দলগত ও ব্যক্তিগত নাগরিক অধিকারহরণকে নানাভাবে বৈধ বলে প্রচার করা হয়েছে। এতে সহযোগী হয়েছে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও সংবাদমাধ্যম। রাজনৈতিক ও সামাজিক তো বটেই, এমনকি অর্থনৈতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যে হিংস্রতায় ইসলামী ব্যাংক দখল করা হলো তা বিস্ময়কর। এরপরে একে একে সব ইসলামী ব্যাংকই ‘রাজাকারমুক্ত’ করে আওয়ামী দখলে চলে গেল!

আন্দোলন দমনের হিংস্রতা চূড়ান্ত রূপ পেল ২০১৩ সালে, সামরিক কায়দায় এসল্ট ফরমেশনে হেফাজতের ওপর নৃশংস কায়দায় গুলি করে শত শত লাশ ফেলে আন্দোলন নিস্তব্ধ করে। সৌভাগ্য আওয়ামী লীগের যে, তখনো স্মার্টফোন ও তার ভিডিও সুবিধা দেশে তেমন আসেনি, তারা টিভি ক্যামেরা ব্লাকআউট করে দিয়ে লাশগুলো ইতোমধ্যে উদ্ধারকার্য শেষ হয়ে যাওয়া রানাপ্লাজায় পাঠিয়ে সেখানের বেওয়ারিশ লাশ বলে ধামাচাপা দিতে পেরেছিল। সচেতন মানুষ যদিও কী হয়েছে তার একটি ধারণা করতে পেরেছিল, কিন্তু চোখের সামনে লাশ না দেখায় ‘হেফাজতি মোল্লাদের’ জন্য জনতার ক্ষোভ দানা বাঁধতে পারেনি। হেফাজতকে আমাদের সুশীলসমাজ ঊনমানুষ মনে করে, তারা প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর হলেও এমনকি বামপন্থীরাও তাদের প্রতি নিদারুণ অসদয়। তারা মারা গেলে কেউ বেদনা অনুভব করে না, করলেও সেটিকে নিজের ক্ষতি মনে করে না। বিশেষত আওয়ামী ও তথাকথিত প্রগতিশীল মিডিয়া হেফাজতের ওপর নৃশংসতাকে যথাসম্ভব চেপে যেতে এবং প্রকাশিত নৃশংসতাকে রাজাকার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের উপযুক্ত পাওনা বলে জায়েজ করায় পরস্পরের সহযোগী ছিল। অন্য দিকে জঙ্গি উত্থানের গল্প বলে হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে হেফাজত দমনকে আন্তর্জাতিক মহলে জায়েজ করাও সহজ হয়েছিল।

সরকার যতই দমন-পীড়ন করুক, তাদের প্রতি পাঁচ বছর পরে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। ২০১৪-এ বিনা ভোটের নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের জোট সারা দেশ কব্জা করতে পারলেও বৃহত্তর ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। সবশেষে আওয়ামী সরকার জাতীয় পার্টির সহায়তায় বিনা ভোটের নির্বাচন করে সরকার গঠন করে ফেললে সরকার পতনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। এই ধাক্কায় বিএনপির আন্দোলন-সামর্থ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়, নেতাকর্মীরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে যার জেরে ২০১৮ সালে নির্বাচনে যেতে বাধ্য হয়, রাতের ভোটের ব্যবস্থায় পায় মাত্র সাতটি আসন! আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিনা ভোটের নির্বাচন, রাতের ভোটের নির্বাচন ও সবশেষে ডামি ভোটের নির্বাচন করে প্রশাসনকে দলীয়করণ করে পুলিশি নির্যাতনের একই ধারায় কোনো বৈধতা ছাড়াই টিকে যেতে পেরেছে। ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর একটি প্রকাণ্ড মিথ হয়ে উঠেছিল যে, ভারত হাসিনা সরকারকে যত দিন রাখতে চাইবে, কেউ তাকে সরাতে পারবে না। ভারতই জাতীয় পার্টিকে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় আমলে প্রলোভন এবং ভয় দেখিয়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সব ক’টি নির্বাচনে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় নির্বাচনে নামিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ জনগণ নয়; বরং ভারতকে দেশ লুটে ভাগাভাগি করে খুশি করলেই চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে, অন্তত ২০৪১ সাল নাগাদ ক্ষমতায় থাকবে, এই আওয়ামী বয়ান দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস হয়ে অনেকাংশে দানা বেঁধেছিল। এই বিশ্বাস মানুষেকে আন্দোলনের প্রতি নিস্পৃহ করে তুলেছিল। ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর এতই আত্মবিশ্বাস ধ্বংসকারী ছিল যে, বিএনপি ও জামায়াত তাদের চিরাচরিত ভারতবিরোধিতা ছেড়ে ভারততুষ্টির দিকে মনযোগ দেয়।

হেফাজতের ছাত্র মারা গেলে যেমন মানুষ আক্রোশে ফেটে পড়ে না, একইভাবে বিএনপি-জামায়াত মারা গেলেও জনমানুষ নিজেদের ক্ষতি মনে করে না। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলের প্রতি অনেকের বীতশ্রদ্ধা আছে। সে জন্যই আওয়ামী লীগ ভয়ঙ্কর মাত্রায় স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেও তাদের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ কথাটি সত্য। আওয়ামী আমলে একটি ফাঁপা অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছিল, তারা নিত্যদিন ‘দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে’ বলে উন্নয়নের বয়ান জপত। কিন্তু ভয়াবহ লুটপাটের ফলে ২০২২ সালে মিথ্যা অর্থনীতির বেলুন ফুটো হয়ে গেলে জীবন ও জীবিকার উত্তাপ মানুষেকে পোড়াতে লাগল, মানুষের মোহভঙ্গ হতে থাকল। সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো বয়ান থাকল না!

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ওঠা জনগণ গত সংসদীয় নির্বাচনের আগের আন্দোলনের সাথে কিছুটা সম্পৃক্ত হচ্ছিল। ব্যাপকমাত্রায় মামলা, জেল-জুলুম, গ্রেফতারের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের এক দিকে আদালতপাড়ায় ব্যতিব্যস্ত রেখে নিরাপত্তাহীন করে রেখেছে, অন্য দিকে নেতৃত্ব থেকে কর্মীদের পৃথক করে ফেলেছে, ফলে আন্দোলনের জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার অবকাশ পায়নি। আন্দোলনে ব্যাপক জনসম্পৃক্তি না থাকায় তারা আওয়ামী পুলিশ ও হেলমেট বাহিনীকে রাজপথে সংখ্যাধিক্যে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত গুলি, গ্রেফতার, হামলা, মামলার কাছে পরাস্ত হয়েছে। তবে নির্বাচনে জিতে এলেও এবারের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন, পদে পদে কারচুপি তথ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে উঠে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো ফেসবুক ও ইউটিউবে রাজনৈতিক একটিভিস্টরা সবচেয়ে সরব ছিলেন, সরকারের প্রতিটি মিথ্যাচার ও স্বৈরাচারী পদক্ষেপ মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, যা আন্দোলনকারী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র ও সাধারণ জনতাকে যেমন উজ্জীবিত করেছে, তেমনই সরকারি দল এবং বাহিনী ও সংস্থাগুলোকে স্বৈরাচারী হতে সতর্ক ও দ্বিধান্বিত করেছে। বিশেষ করে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাঙ্কশনের ঘোষণা ক্ষমতাসীন এলিট শ্রেণীর একাংশকে রয়েসয়ে বিরোধী দলনে বাধ্য করেছে। আগের নির্বাচন নিয়ে বিদেশীরা তেমন সক্রিয় না থাকলেও এবারে ছিল, তারা নির্বাচনকে ভুয়া বলে আগেই স্যাব্যস্ত করেছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। এতে তরুণ ভোটারদের ওপর, যাদের আমরা জেন-জি বলে জানি, তাদের পর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যে, তারা ভোটার হয়েছে, নির্বাচনও হচ্ছে কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের চোখে স্পষ্ট ধরা পড়েছে, তিন তিনটি ভুয়া নির্বাচন সামলে ফেলে হাসিনা নিজের ক্ষমতাকে অপ্রতিরোধ্য মনে করছেন, ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন, নেতাকর্মী-মন্ত্রী-আমলা-জেনারেল সবাইকে দিয়ে নিজেকে কদমবুচি করাচ্ছেন, মুজিবের মূর্তি-ম্যুরালে পূজার ফুল দেয়াচ্ছেন, তার দম্ভ-অহমিকা আকাশ স্পর্শ করেছে! সেটি এমনই যে, দেশটি তার বাবা স্বাধীন করেছেন, দেশের মানুষকে তিনিই খাওয়াচ্ছেন, বিদ্যুৎ দিচ্ছেন, ইন্টারনেট দিচ্ছেন, অবাধ্য হলেই এসব বন্ধ করে ভোগান্তি দেবেন- এমন ভাবতেন ও বলতেন। জেন-জির কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর অতিমানবীয় চরিত্রের ক্রমাগত মিথ্যার বেসাতি প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কোনো বয়ান আর তারা গিলছিল না, তারা মিথ্যাচার উগরে দেয়া শুরু করেছিল।

এবারে আন্দোলন সরকার নিজেরাই ডেকে এনেছে, যা শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারেনি। ভারতকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে দশর্না হয়ে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি দিয়ে ট্রেন করিডোর দেয়ার ব্যাপারটি সরাসরি সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির হওয়ায় জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করতে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে ফিরিয়ে এনেছিল। ডামি নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে দেশ-বিদেশে বৈধতার সঙ্কটে পড়া সরকার অর্থনৈতিক খাদের কিনারে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ানোর কোনো বিহিত ব্যবস্থা করতে পারেনি। এ অবস্থায় মোদির ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতার এনে আওয়ামী সরকারের কাছে তার একতরফা চাওয়া-পাওয়া এমনই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে, হাসিনার পক্ষে কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখার কোনো ক্ষমতা ছিল না, সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণত ভারতের কব্জায় চলে যায়। গ্লানিকর ভারতবশ্যতা তখন অর্থনৈতিক চীন-নির্ভরতাকেও গ্রাস করে ফেলে। এ অবস্থায় ভারতের অনাপত্তি নিয়ে অপমানকর চীন সফরের অভিজ্ঞতাসহ নানান ব্যর্থতা হজম করতে হাসিনার জন্য ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়ে। আর সেটার জন্য কোটাবিরোধী আন্দোলনকে বেছে নেয়া ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল!

শুরু থেকেই ছাত্র আন্দোলনের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। এবারের ছাত্ররা হেফাজতি ছাত্রদের মতো তাচ্ছিল্যকর কোনো ঊনমানুষ নয়, তারা হাওয়া ভবনের বীতশ্রদ্ধা কুড়ানো ক্ষমতার অপর পিঠ না, জামায়াত-শিবিরের মতো রাজাকার না, তারা আমাদের সন্তান! এসব ছাত্র একটি ন্যায্য দাবিতে রাজপথে নেমেছে, এই সত্যের চেয়েও বেশি ছিল ছাত্রদের রক্তপাত প্রতিটি অভিভাবকের কাছে ছিল নিজের মৃত্যুর চেয়েও বেশি ক্ষোভ ও প্রতিবাদের। এই প্রথমবারের মতো মায়েরা আন্দোলনে সন্তানদের সাথে রাজপথে নেমে এসেছে। ছাত্রদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দুই চিরচেনা কার্যকর অভিযোগ- অস্ত্র ‘ক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাজাকার’ কোনোটাই প্রযোজ্য ছিল না। ফলে বহুল ব্যবহৃত রাজাকার অস্ত্রটির মারাত্মক অপব্যবহার এখানে বুমেরাং হয়েছে। ছাত্রদের দাবিটি ছিল সর্বজনীন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় শিক্ষাক্ষেত্রের ছাত্রদের কাছে একই রকম আবেদনময়। ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ও ভার্চুয়ালি সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি ইন্টারকানেকটেড থাকায় তাদের পক্ষে আন্দোলনের ডাক দেয়া ও রাজপথে নামা অন্যদের চেয়ে সহজ হয়েছে। জেন-জির নিজস্ব ইউনিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তারা সামাজিক মাধ্যমে সাড়া জাগাতে পেরেছে। টিকটক ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া শর্ট ভিডিওগুলো ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও আবেদনশীল, মানুষকে সহজেই সম্পৃক্ত করতে পেরেছে।

এখানে আবু সাঈদের প্রতিবাদ ও মৃত্যু ছিল বিশাল টার্নিং পয়েন্ট। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়; বরং মানবেতিহাসে প্রতিবাদের এক অন্যতম স্মারক হয়ে যুগ যুগ মানুষকে অনুপ্রেরণা দেবে। ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়ে স্যাবোটাজের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে অনুপ্রবেশকারী বলে দোষ চাপিয়ে এবার পার পাওয়া যায়নি। কারণ আন্দোলনকারীদের কাছে এসব মিথ্যাচার পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ছিল এবং ক্ষোভের মাত্রা বাড়িয়ে চলছিল। সরকারের কাছে আন্দোলন দমনের জন্য টার্গেটও পরিষ্কার ছিল না। কেননা ছাত্র নেতৃত্ব একক কারো ওপর নির্ভরশীল ছিল না, ফলে নেতৃত্ব থেকে সাধারণ ছাত্রদের পৃথক করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় আন্দোলন দমনের জন্য গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ আন্দোলনকে আরো বেগবান করেছে। প্রথমে ওবায়দুল কাদের হেলমেটবাহিনী নামিয়ে আন্দোলন দমানোর চিরাচরিত ঔদ্ধত্য দেখালেন, এতে উল্টো হেলমেটবাহিনী মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে গেল।

এর পরই ছুটির দিনে জরুরি আদালত বসিয়ে কোটা কমিয়ে নতুন রায় দিতে বাধ্য হলো সরকার- পরপর অর্জিত দু’টি বিজয় আন্দোলনকারীদের কাছে শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের এক দফা দাবির বিজয়ও অবশ্যম্ভাবী বলে অনুপ্রেরণা জুুগিয়েছে। অপরপক্ষে স্বৈরাচারী হাসিনা গং এই দুই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পুলিশ ও বিজিবি দিয়ে বেপরোয়া গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালালে ছাত্রদের সাথে প্রথমে অভিভাবক ও পরে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরাও যোগ দেয়, এতে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। ছাত্র সমন্বয়ের কতিপয় নেতাকে ডিবির পুলিশ ধরে নিয়ে যে নাটক মঞ্চস্থ করে তাও সর্বত্র সরকারের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করে। সেই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী নামিয়ে কারফিউ জারি করে অফিস-আদালত বন্ধ করে ইন্টারনেট শাটডাউন করে ১৯ জুলাই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলনে সাময়িক রাশ টেনে ধরা হলেও তাতেই বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি হয়, তথ্যের অভাবে গুজব ও গুঞ্জন বাড়তে থাকে। এ সময়ে আওয়ামী টিভি চ্যানেলগুলোর জামায়াত-শিবিরের অন্তর্ঘাত ও ধ্বংসযজ্ঞের বয়ানে এক গুমোট পরস্থিতি তৈরি হয়। অবশেষে ইন্টারনেটে আংশিক অ্যাকসেস পাওয়া গেলে স্মার্টফোনে ধারণকৃত হত্যাযজ্ঞের ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে, পানি খাওয়ানো মুগ্ধ ও এপিসি থেকে ময়লার বস্তা ফেলে দেয়ার মতো ছাত্র ইয়ামিনকে ফেলে দেয়া এমনকি কোনো সাধারণ আওয়ামী লীগাররাও মেনে নিতে পারছিলেন না।

আওয়ামী নিউজ চ্যানেলের সংবাদ ও টকশো মানুষের মধ্যে ক্রমাগত ঘৃণা ও ক্ষোভ বাড়িয়েছে। ইন্টারনেট শাটডাউন বা এর গতি ও অ্যাকসেস কমানো হিতে বিপরীত হয়েছে, এটি সরকারের আরেকটি দমন-পীড়নের টুলস হিসেবে আন্দোলনে বরং গতি এনেছে। এ সময়ে ছাত্র সমন্বয়করা কিছু ইউনিক ও কার্যকর কর্মসূচি দিয়েছে। তবে আন্দোলনে সেনা মোতায়েন ভয় ও আতঙ্ক কেটে গেছে অফিসারদের সাথে সেনাপ্রধানের ভাষণ-পরবর্তী প্রশ্নোত্তর পর্বে। ততক্ষণে আন্দোলনকারী ও দেশের মানুষ জেনে গেছে, সেনাবাহিনী তাদের ওপর গুলি করবে না, ততক্ষণে মানুষ নির্ভয় হয়ে গেছে, ততক্ষণে মানুষ স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের এক দফার ডাকে অপেক্ষা করতেও রাজি নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভিডিও দেখিয়ে পুলিশের সেই ঐতিহাসিক বর্ণনা আন্দোলনের পরিণতিকে নির্ধারণ করে দেয়- ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার, গুলি করলে মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না, এটিই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার বিষয়।’ লীগের পুলিশ যখন নির্বিচারে গুলি করেও বিপুল জনতাকে রাজপথ ছাড়াতে পারেনি, ক্ষমতার কেন্দ্র বৃহত্তর ঢাকা আন্দোলনকারীদের কব্জায় চলে যায়, তখন আওয়ামী লীগ ও তার বাহিনীগুলো নিজেরাই পলায়নের পথ খুঁজে, ফলে নীতিনৈতিকতাবিহীন লুটেরা, খুনি শেখ হাসিনার তখন পেছন দরজা দিয়ে লক্ষণ সেনের মতো পলানোই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

মুজিবের মূর্তিপূজারি কাল্ট প্রজন্ম গড়ে তুলতে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে গিয়ে যে জোরজুলুম ও আতঙ্কের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল, জেন-জি মুজিবের মূর্তি, ম্যুরাল ও ছবি এবং মুজিব কর্নার ভাঙার মাধ্যমে এই চেতনা বেচাবিক্রিকে প্রত্যাখ্যানই করেনি, মাটিচাপা দিয়েছে। কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, কেউ কেউ একে স্বাধীনতা ২.০ কিংবা বিজয় ২.০ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের গ্রাফিতি খুবই চমৎকার ও পজিটিভ বার্তা দিচ্ছে। এই নবায়িত স্বাধীনতা আমাদের প্রচলিত ঘুণেধরা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সংস্কার করবে এবং আগামী প্রজন্মকে বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণে অনুপ্রাণিত করবে বলে আমরা আস্থা রাখতে পারি।


আরো সংবাদ



premium cement
হিন্দু পল্লীতে আগুন : মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন নাইক্ষ্যংছড়িতে আ’লীগের দুই নেতা কারাগারে লজ্জায় ডুবলো শ্রীলঙ্কা, মাত্র ৪২ রানে অলআউট সাবেক এমপি রশীদুজ্জামানের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হজযাত্রী নিবন্ধনের সময় বাড়লো ‘সমাবর্তন ছাড়াই মূল সনদপত্র পাবে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা’ রাজশাহীতে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সিকাণ্ডে গ্রেফতার ৩ চিন্ময়ের গ্রেফতারে কুমিরের কান্না কাঁদছে শেখ হাসিনা : রিজভী কাউনিয়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে ব্যবসায়ী নিহত মুন্সিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের স্বীকৃতি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত শ্রম কমিশনের অগ্রাধিকার

সকল