২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গণতন্ত্র যেভাবে সম্ভব বাস্তবায়ন

গণতন্ত্র যেভাবে সম্ভব বাস্তবায়ন - প্রতীকী ছবি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শাসনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও রয়েছে। এসব পদ্ধতির মধ্যে গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক বেশি। এই শাসন পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো নিয়ামকের ওপর। বর্তমান বিশ্বে এসব নিয়ামকের সবগুলোকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছে এমন রাষ্ট্র পরিলক্ষিত হয় না। আবার যেসব নিয়ামক বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলোও আংশিক মাত্রায় হয়েছে, পূর্ণমাত্রায় নয়। ফলে নাগরিকদের চাহিদার তুলনায় প্রাপ্তি অনেক পিছিয়ে আছে। এ কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিভিন্ন অঘটন প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শাসনব্যবস্থাকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিতে গেলে গণতন্ত্রকে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় উন্নীত করতে হবে। আর এ জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক :

১. জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকবে এবং তার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে : নির্বাচন হলো বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে একটি বড় রকমের প্রতিযোগিতা। আর যেকোনো প্রতিযোগিতায়ই বিচারককে নিরপেক্ষ হতে হয়। বিচারক যদি নিরপেক্ষ না হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী কোনো দলের মধ্য থেকে হয়ে থাকে তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। এ কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকতে হবে এবং তার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

২. সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি না হয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদ হবে : একটি দেশের সরকারপ্রধানকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেক শাসক স্বৈরাচার ও একনায়কে পরিণত হতে পারে। তার এই একনায়কতন্ত্র কিংবা স্বৈরাচারিতা তার নিজের জন্য, অনুসারীদের জন্য, সর্বোপরি দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে। একনায়কতন্ত্রের কুপ্রভাব অনেক সময় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের দেশেও ছড়িয়ে পরতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশে এর নজির রয়েছে। এই একনায়কতন্ত্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য একক ব্যক্তির পরিবর্তে একটি পরিষদকে সরকারপ্রধান করা একান্ত আবশ্যক। এই পরিষদের তিনজন সদস্য আসবেন সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্য থেকে। একজন আসবেন শিক্ষার্থী কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে যিনি পেশায় একজন শিক্ষক হবেন। একজন আসবেন নির্দলীয় বিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদ থেকে।

৩. সরকারে নির্দলীয় ও বিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসেন তারা মূলত একেকজন একেক রাজনৈতিক মতাদর্শের হয়ে থাকেন। মাঠপর্যায়ের নানা প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাদেরকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এমন অনেক বিষয় চলে আসে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ওই বিষয়ে শাস্ত্রীয় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও নিরপেক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এসব গুণ অনেক সময়ই থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ অবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও সেটি দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার গঠনের সময় একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা খুবই জরুরি। এ পরিষদের সদস্যরা হবেন সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও দলনিরপেক্ষ। তাদের ভূমিকা দেশকে দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কোনো সমস্যার উন্নততর সমাধান দিতে পারে। জনপ্রতিনিধিরা এই পরিষদের কাছ থেকে পরামর্শ বা উপদেশ নিয়ে কাজ করলে এর গ্রহণযোগ্যতা বজায় থাকে। তারা প্রচলিত আইনকানুনের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নতুন বিধিবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেবেন। উপদেষ্টা পরিষদ নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কোনো বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন হলে এই পরিষদ তা করতে পারবে। উপদেষ্টাদের যোগ্যতা নিরূপণে প্রাধান্য পাবে প্রখর মেধা, যা নতুন কিছু উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রমাণিত বা দৃশ্যমান হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ১৫ ও সর্বোচ্চ মন্ত্রণালয় সংখ্যার সমান হতে পারে।

৪. মতপ্রকাশের যথাযথ ক্ষেত্র থাকবে : গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এখানে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক যেকোনো বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতে পারে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এর ব্যাপক ব্যত্যয় লক্ষ করা যায়। স্বাধীন মতামত ব্যক্তকরণ কিংবা ন্যায্য অধিকার চাওয়ায় অনেককেই অনেক সময় হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারে একটি বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থাকা উচিত। এখানে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক সরকারকে তাদের মতামত জানাতে পারবে, পরামর্শ দিতে পারবে, অভিযোগ জানাতে পারবে এবং তাদের কোনো ন্যায্য দাবি থাকলে সেটিও জানাতে পারবে। সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই অভিযোগ, পরামর্শ, মতামত কিংবা দাবির বিষয়ে তাদের নেয়া পদক্ষেপের তথ্য নাগরিককে জানিয়ে দেবে। এ ছাড়া দফতরে না এসেও কোনো নাগরিক যদি সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, গণমাধ্যমে বিবৃতিসহ বিভিন্ন উপায়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করে, অভিযোগের কথা জানায় কিংবা কোনো সমস্যার প্রতিকার চায় তাহলেও এই দফতর স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এর ফলে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং গণতন্ত্র সুসংহত হবে। এই দফতরের কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকির জন্য একটি কমিটি থাকবে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ থাকবে সমাজের প্রতিনিধি, গবেষক ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা। ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়মিত শিক্ষার চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে অথবা হতে যাচ্ছে এমন কিছু শিক্ষার্থীকেও এ কমিটিতে রাখা যাবে।

৫. জাতীয় সংসদে যুক্তিসঙ্গত সংরক্ষিত আসন থাকবে : সব ধর্ম ও স্বীকৃত সব লিঙ্গের মানুষ থেকে কমপক্ষে একজন করে সংসদ সদস্য থাকতে হবে। সাধারণভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে থেকে কেউ যদি উল্লিখিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত না থাকেন তবে তা সংরক্ষিত আসন হিসেবে পূরণ করতে হবে। এর মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক কার্যকরী সংসদ গঠিত হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যদি দেখা যায় যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে কেউই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী নেই তাহলে ওই শ্রেণীটি প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে একটি সংরক্ষিত আসন দিতে হবে। একইভাবে যদি দেখা যায়, সাধারণভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কেউই নারী নেই তাহলে ওই শ্রেণীটি প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে একটি সংরক্ষিত আসন দিতে হবে। আর যদি দেখা যায়, সাধারণভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নারী রয়েছে তাহলে তাদেরকে সংরক্ষিত আসন থেকে কোনো আসন দেয়ার প্রয়োজন নেই।

৬. বৈষম্যহীন সংসদ থাকবে যেখানে কাউকে দাফতরিকভাবে বিরোধী দল করা হবে না : সংসদ থেকে বিরোধী দল প্রথা বিলুপ্ত করে একটি বৈষম্যহীন কার্যকরী সংসদ প্রবর্তন করা উচিত। নতুন এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কোনো দল বিরোধী দল হিসেবে থাকবে না। সবাই সরকারের অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে। মুক্তচিন্তার মাধ্যমে সব সংসদ সদস্যের আনীত কোনো বিলের ওপর তাদের মতামত দেবেন। এতে ভালো দিক-মন্দ দিক সবই আলোচনায় উঠে আসবে। পরিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আনিত বিলটি পাস অথবা বাতিল হবে। এর ফলে সংসদ সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতাভাব কমে আসবে। দলীয় সঙ্কীর্ণতাও হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের মঙ্গল হবে।

৭. দলের গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্র বজায় থাকবে যেখানে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র থাকবে না : বহু রাজনৈতিক দল আছে যাদের গঠনতন্ত্রই অগণতান্ত্রিক। দলীয় প্রধানই এখানে সব। কাউকে দলে রাখা কিংবা বহিষ্কার করা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। এসব দল থেকে আগত জনপ্রতিনিধিরা সঠিক গণতন্ত্র চর্চায় অভ্যস্ত নন। কাজেই নিবন্ধনকৃত সব রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্র বজায় আছে কি না সেটি নিশ্চিত হতে হবে। ঘাটতি থাকলে সেটি পূরণ করতে হবে।

৮. সংসদ সদস্যপদ খারিজের ক্ষমতা শুধু সংসদ কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে, যাতে দলীয় ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে মতপ্রকাশ করা যায় : কোথাও কোথাও এমন নিয়ম আছে, কোনো কারণবশত কেউ দলীয় পদ হারালে তার সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। এই খারিজের ভয়ে বহু সংসদ সদস্য স্বাধীনভাবে তাদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করতে পারেন না। এ রকম কালো আইন থাকলে সেটি বাতিল করে সংসদ সদস্যদের পদ খারিজের ক্ষমতা শুধু সংসদ কর্তৃপক্ষের হাতেই ন্যস্ত করতে হবে।

লেখক : প্রকৌশলী
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement