শিক্ষাপ্রশাসনে নিম্ন মেধাবীদের পদায়ন নয়
- মো: সরোয়ার উদ্দিন
- ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৩
অট্টালিকাদের ভাঙা ইট, বালু প্রভৃতি দিয়ে নির্মাণ ও ফসল উৎপন্ন করা যায় না বিধায় এই আবর্জনা, জঞ্জাল, অপদার্থ, নিকৃষ্ট বা অকর্মণ্য বা বাজে বস্তু। তেমনি সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত চাওয়া-পাওয়ার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ অভাব-অভিযোগগুলো যথাযথভাবে উপলব্ধি ও বিবেচনায় নিয়ে বেশি কার্যকর ও পরিমিত যোগ্যতা এবং কৌশল সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান থাকা দরকার। শুধু নিম্ন মেধাবী ও একাডেমিক শিক্ষার ঘাটতি থাকায় যথাযথভাবে আদেশ ও নিষেধ করতে ব্যর্থ হন নিম্ন মেধাবী বা দুর্বল প্রশাসক, এমনটি আমরা মনে করি।
বাস্তবতার নিরিখে প্রকৃতি ও একাডেমিক (প্রথম শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত) পরিমিত শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি, চিন্তা, ধারণা ও অনুভূতি প্রভৃতির উন্মেষ ঘটে এবং মেধাশক্তি প্রকৃতভাবে বিকশিত হয়।
মেধাশক্তি প্রধানত দুই প্রকার : যথা- ক. উদ্ভাবনী- সূত্র, তত্ত্ব, ফর্মুলা, প্রযুক্তি, মডেল ও গাইডলাইন প্রভৃতি উদ্ভাবনী শক্তি। এসব উদ্ভাবন দ্বারা যেমন- লাল-সবুজ ও আকাশি- এ তিন প্রকার রঙের সমন্বয়ে হাজারেরও অধিক প্রকার (সংখ্যা) রঙ উদ্ভাবন করা সম্ভব। তেমনি অসংখ্য উদ্ভাবন দ্বারা এ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী তিমিকেও (মাছ) নিয়ন্ত্রণ, সাগরের তলদেশ ও ভূগর্ভ থেকে মণিমুক্তা ও হীরা প্রভৃতি সংগ্রহ এবং সেই সাথে সৌরজগৎ জয় করার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীকে সুন্দর ও সুখের আবাসভূমিতে পরিণত করেছে এ মানুষ।
খ. স্মরণশক্তি- তিন প্রকার : যথা- ১. নিম্ন-অধিক সময় ও পরিশ্রমে জ্ঞানের বিষয়গুলো মস্তিষ্কে আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। এ কারণে একাধিকবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভালো-মন্দ, উন্নত-অনুন্নত, মঙ্গল-ক্ষতি ও গ্রহণ-বর্জন প্রভৃতি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য করে তোলা হয়। এ কারণে সবার জন্য প্রাথমিক স্তরের একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক ও আসল উদ্দেশ্য।
২. মাঝারি- অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ও পরিশ্রমে পাঠ্যবিষয়ে মস্তিষ্কে আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। এ জন্য এসএসসি পাসের পর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রভৃতি শিক্ষা গ্রহণ করা শেষে যোগ্যতা দিয়ে দেশ ও বিদেশে নির্মাণ, খনিজ, জাহাজ ও যান্ত্রিক প্রভৃতি শিল্পের দক্ষতার সাথে কাজ করা সম্ভব হয়।
৩. তীক্ষ্ম অল্প সময়ে কঠিক বিষয়গুলো অতি সহজে বেশি পরিমাণ আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। এদের একাডেমিক উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বিশেষায়িত জ্ঞানার্জন ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। যেমন- শিক্ষক, ডাক্তার, বিচারপতি, গবেষক ও রাজনীতিবিদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উত্তম নীতিনির্ধারণ, বিকল্পের মধ্য থেকে উত্তমটিকে গ্রহণ এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমাজ, জাতি, দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নয়ন, কল্যাণ ও শান্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
দুর্বল ও নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থা, যেমন- শিক্ষা কারিকুলামে আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যবিষয়গুলোর অনুপস্থিতি, একাডেমিকভাবে দুর্বল শিক্ষক দিয়ে নিয়মিতভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, কোচিংবাণিজ্যে রমরমা ব্যবসায়, সহজে পাস করার উপযোগী প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ফাঁস, এনটিসিবির ভুলসহ অনিয়মিতভাবে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, শ্রেণিকক্ষে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি, সময়ের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও বিষয়গুলো ক্লাসে পড়ানো হয় না, মূল টেক্সট বইয়ের পরিবর্তে গাইড ও নোটবুক অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনুসরণ, সৃজনশীল ও প্রশ্নব্যাংক প্রভৃতি দুর্বল ও নতজানু শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ এবং বিষয়জ্ঞানে ঘাটতি পরীক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রভৃতি কারণে নিম্ন মেধাবী ও দুর্বল একাডেমিক শিক্ষার্থীরাও অপেক্ষাকৃত বেশি নম্বর পেয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ পর্বে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়। সনদের মান যত সম্মানজনক ও আকাশচুম্বী হোক না কেন, তা দিয়ে কেবল বারবার বিসিএসসহ সম্মানজনক সরকারি চাকরিতে আবেদনসহ নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ মিললেও চূড়ান্ত নিয়োগে অধিকাংশ প্রার্থী ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রার্থী দুর্নীতির চোরাগলি দিয়ে দায়িত্বপূর্ণ চাকরি বাগিয়ে নিতে সক্ষম হলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে চোখে অন্ধকার দেখে। অন্যের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ওঁৎ পেতে থাকা চতুর, বর্ণচোরা ও সুযোগসন্ধানী চূড়ান্তভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে যায়। এ দায়িত্ব পালনে অহেতুক অতিরিক্ত শর্ত যোগ করায় অস্বাভাবিকভাবে অর্থ ও সময়ের অবচয় হয়। স্থবিরসহ এলোমেলোভাবে কাজ চললেও বিভিন্ন অনিয়ম দেখা দেয়। ফলে মুখ্য দায়িত্বের জায়গায় গৌণ ফল অর্জিত হয়। সুযোগসন্ধানীদের স্বার্থ হাসিল হয়।
উল্লিখিত চাকরি লাভে ব্যর্থ হয়ে কতিপয় এমফিল ও পিএইচডি অর্জনের মধ্য দিয়ে সরকার ঘোষিত ১০ শতাংশ কোটায় বিসিএসে (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) কেবল মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে (অপেক্ষাকৃত উচ্চপদে) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে সরকারি কলেজে যোগদান করেন। এরকম একজন পরিচিতি বিভাগীয় প্রধান (নাম, বিভাগ ও কলেজের ঠিকানা গোপন রাখা হলো) হিসেবে কেবল জরুরি কাজ ছাড়া সচরাচর রুটিন অনুযায়ী কলেজ বাসে আসা-যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন। একাডেমিক বিষয়ে দুর্বল, যা ইতোমধ্যে অনেকে জেনে ফেলেছেন। বিভাগে সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও একাডেমিকসহ কোনো উন্নতি নেই। সেমিনারসহ বিভাগের সব কিছু একরকম অরক্ষিত বলা চলে। অনেকটা ইচ্ছানুযায়ী সবাই বিভাগে আসে ও যায়। বিভাগে সব দায়িত্ব একজন জুনিয়র শিক্ষককে দিয়েছেন ইত্যাদি। শেষে যদি দুর্বলতা ফাঁস হয়ে যায়- এ ভয়ে কাউকে কোনো শক্ত আদেশ-নির্দেশ করেন না। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, বিভাগের একজন অধ্যাপক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ পর্বের প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে একজন পরীক্ষকের নম্বরপত্র হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুজির পর পরিশেষে ওই পরীক্ষকের দেয়া তথ্যে জানা যায়- বিভাগের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী (মাস্টাররোল) রেজিস্ট্রিকৃত ডাকে নম্বরপত্রটি যথাযথভাবে গ্রহণ করেছে। এ ঘটনা বিভাগীয় প্রধানকে অবহিত করা হলে তিনি স্পষ্টভাবে জানান, ‘আমরা (কর্মচারীসহ বিভাগীয় প্রধান) একই জেলার মানুষ বিধায় কিছু বলতে ও করতে পারব না।’
বিভাগীয় প্রধান নিম্ন মেধাবী হওয়ায় উচ্চ একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করা সত্ত্বেও যথাযথভাবে মস্তিষ্কে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিধায় সরকারি কলেজে চাকরিতে যোগদানের পর আবশ্যকভাবে কতিপয় বিষয়ের ওপর বিশেষ জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এ যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী পর্যায়ের উচ্চধাপে (অধ্যাপক হিসেবে) দক্ষতার সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে প্রয়োজন হয়। যেমন- বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং ডিপার্টমেন্টাল ও সিনিয়র স্কেলে ছয়টি বিষয়ে প্রতিটিতে লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম ৬০ শতাংশ নম্বর অর্জন করলে উত্তীর্ণ বলে গণ্য করা হয়। এ সম্পর্কে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সম্পূর্ণভাবে অজানা। কারণ ওই প্রশিক্ষণ ও লিখিত পরীক্ষার বিষয়গুলোর ন্যূনতম নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। এ কারণে তারা সর্বশেষ পদোন্নতি হিসেবে সহযোগী অধ্যাপক হতে পারবেন। কোটায় নিয়োগপত্র এসব চতুর, বর্ণচোরা ও সুযোগসন্ধানী কিছু ব্যক্তির সাহায্য ও কারসাজিতে অধ্যাপক হিসেবে ১৬তম বিসিএসের ১২ ও ১৩তম মেধাতালিকার ভেতর প্রবেশ করেছেন।
উল্লিখিত তথ্যে এটি প্রমাণ করে, কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা নিম্ন মেধাবী ও একাডেমিকভাবে দুর্বল শিক্ষক। এ জন্য নিম্ন মেধাবীদের প্রশাসক, যথা- বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ ও অফিস প্রধানসহ হিসেবে পদায়ন করা উচিত হবে না। এ ক্ষেত্রে কার্যে স্থবিরতাসহ এলোমেলো এবং উন্নয়নকে চেপে ধরাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদে বাধার সৃষ্টি করবে। তীক্ষ্ণ মেধাবী ও একাডেমিক উচ্চজ্ঞানসম্পন্ন যোগ্য শিক্ষক নিয়োগদান নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাদানে উত্তম সুযোগ সৃষ্টিসহ আলোকিত সমাজ, জাতি ও দেশ নির্মাণে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন- এ প্রবন্ধের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি এ আবেদন জানাই।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা