১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

গণপ্রজাতন্ত্রে আমরা সবাই প্রজা হতে চাই

গণপ্রজাতন্ত্রে আমরা সবাই প্রজা হতে চাই - প্রতীকী ছবি

নব্বইয়ের দশকে মহল্লার স্কুলগুলো যেন একেকটি একান্নবর্তী পরিবারের মতো ছিল। সবার সাথে সবার একটা বন্ধন ছিল আর সৌহার্দ্যরে জায়গাটাও ছিল বেশ সহজ ও সরল। তাই মহল্লার স্কুলগুলোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই অনেকটা মহল্লার অনুষ্ঠান। আমি তখন সবে ক্লাস ফোরে উঠেছি। সেবার বার্ষিক খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান একসাথে পড়ল। দিনের বেলা বার্ষিক খেলাধুলার সমাপনী অনুষ্ঠান হলো আর সেদিন সন্ধ্যায় স্কুল প্রাঙ্গণেই আয়োজন করা হয়েছিল বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগেই বলেছি স্কুলগুলো যেন এক পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। তাই পুরো মহল্লাকে যেন উপস্থিত হতেই হবে, তার ওপর আমাদের মাসব্যাপী অনুশীলন, সবমিলিয়ে মহা উৎসব।

খেলাধুলায় আমি বরাবর দুর্বল, তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘লিচু চোর’ কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলাম আর দলীয় সঙ্গীতে গেয়েছিলাম ‘আমরা সবাই রাজা’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুতোষ গান এটি। একটা সময় বিটিভির শিশুদের যেকোনো গানের অনুষ্ঠানে এই গান ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতো। আজ এতদিন পরে এসে নিজের অজান্তেই গানটিকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। এর সাথে সাথে নতুন নতুন ভাবনা ক্রমাগত মস্তিষ্কে আঘাত করতে থাকল যা কেবল আর শিশুতোষ গানে সীমাবদ্ধ থাকল না। সেই সীমার মধ্যে অসীমকে খোঁজার মতোই অবস্থা।

‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা যা খুশি তাই করি,
তবু তার খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
রাজা সবারে দেন মান,
সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের খাটো করে রাখেনি কেউ কোন অসত্যে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা চলব আপন মতে,
শেষে মিলব তারি পথে,
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?’

‘আমরা সবাই রাজা’ গানটি রচিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘রাজা’ নাটকে এই গানটি ব্যবহার করেছিলেন। গানটি একটু রূপকধর্মী এবং এর অনেকগুলো দর্শনগত বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘কেনো আমরা সবাই রাজা’ শীর্ষক লেখনীতে বলেছিলেন, ‘গানটির প্রথমেই তিনটি অমোঘ শব্দ, ‘আমরা সবাই রাজা’। কোনো সামন্ততান্ত্রিক কল্পনা নয়, ঘোষণাটির মধ্যে সাম্যভাব ও গণতান্ত্রিক চেতনা মিলেমিশে আছে।’

রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের আখ্যানভাগ রাজা কুশের বৌদ্ধ কাহিনী অবলম্বনে রচিত। সুকুমার সেনের মতে, রাজা একটি সাঙ্কেতিক নাটক যার মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বরের গোপন ক্রিয়া। কারো মতে, রাজা নাটক রোমান পুরাণের গল্পের আদলে লিখা আবার কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন যে, পবিত্র বাইবেল এর ‘মধষধঃরধহং ৫’ অধ্যায়ের অনুকরণে লেখা। কিন্তু আমার কাছে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর, ‘রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের রাজনৈতিক দর্শন’ শীর্ষক লেখাটির কথা এই সময়ে খুব বেশি করে মনে হয় যখন আমার দেশের বেশির ভাগ মানুষ তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের হারিয়ে যাওয়া সুতাটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। রাজ্যের রাষ্ট্রীয় রীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কয়েকটি বিষয় থেকে। প্রথমত, নাগরিকদের গান, যেটি অনেকটা জাতীয় সঙ্গীতের মতো, গানের ভেতর দিয়ে তারা বলছে : ‘আমরা সবাই রাজা/আমাদের এই রাজার রাজত্বে/নইলে মোরা রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে।’ আরো বলা হচ্ছে, ‘আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে;’ এবং ‘রাজা সবারে দেন মান/সে মান আপনি ফিরে পান/মোদের খাটো করে রাখেনি কেউ কোনো অসত্যে।’ বোঝা যাচ্ছে রাজ্যে বৈষম্য নেই, রয়েছে সমানাধিকার ও স্বাধীনতা। এখানে ত্রাস নেই; রাজা নিজে কারো দাস নন, অন্যকেও তিনি দাস বানাতে চান না, সবার জন্যই রয়েছে সমান সম্মান।
নাগরিকদের গানে এটিও বলা আছে, ‘আমরা চলব আপন মতে/শেষে মিলব তারি পথে।’
পথের ব্যাপারটিও লক্ষ করার মতো। এ রাজ্যে পথচলার কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, সবাই চলে আপন মতে, কিন্তু সব পথই রাষ্ট্রীয় পথ, কোনোটিই ব্যক্তিগত নয়।’

সাহিত্যে একটি নিত্য অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে, সেটি হচ্ছে পাঠকের কাছে কবির সৃষ্ট সাহিত্যের অন্তর্নিহিত ভাবের বহিঃপ্রকাশ। এটি একপ্রকার নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব যে, কবি যে গভীর ভাবনা থেকে তার সাহিত্য রচনা করলেন, আর পাঠক হিসেবে সেটি পড়ে আমাদের একই ভাবনার প্রস্ফুটন ঘটবে। আমার মনে হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কবিগুরু যে চিন্তা বা প্রেক্ষাপট কিংবা সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকেই গানটি লিখে থাকেন না কেন, আমি বা আমার মতো অনেকেই এই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেবল একটি সহজ সরল শিশুতোষ গানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূচনাই দেখছি। যদি সেটিই সত্যি হয় তাহলে তিনি যে আদর্শ গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র দেখিয়েছেন তা এই উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগেই আদর্শিত। সময়ের বিচারে এই উপমহাদেশের প্রায় সবগুলো দেশেই আনুমানিক একই সময়ে গণতন্ত্রের শুরু; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউ কি সেই আদর্শ জায়গার কাছাকাছিও যেতে পেরেছি? আর গণতন্ত্রের সুফল পাওয়া তো স্বপ্নাতীত। আমরা তো খালি দেখেই এলাম গণতান্ত্রিক শাসনের গতিমুখ সর্বদাই কেন যেন স্বৈরতান্ত্রিক।

শত শত বছরের সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ছায়াকাঠামো আমাদের মেরুদণ্ডে পরগাছার মতো জড়িয়ে রেখেছে, তা না হলে যে রাজার প্রস্থান ঘটেছে বহু আগে; কিন্তু দেশনেতাদের রাজাতুল্য ভাবাপন্ন করে আমরা এখনো সেই আসনেই বসিয়ে রাখতে পছন্দ করি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় যে গণতন্ত্র পেলাম এবং গণতন্ত্রের সুবাতাসে আমরা প্রজা থেকে রাজাতে রূপান্তরিত হলাম সেই আমরাই কিনা বারবার এই গণপ্রজাতন্ত্রে রাজা না হয়ে প্রজা হতে চাই। এই প্রশ্নের উত্তর আমরা হয়তো জানিই না। কেননা, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্বাচিতদের দায়িত্ব না বলে ক্ষমতা বলি আবার একই মুখে আমরা বলে থাকি জনগণই সব ক্ষমতার উৎস।

কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিকরা বহুভাবে দেখিয়েছেন, জাতি হিসেবে বাঙালিরা একটু রোমান্টিক, আবেগপ্রবণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংগ্রামীও বটে; কিন্তু তারা যদি একটু কষ্ট করে শুধুই গালভরা প্রশংসা না করে মুদ্রার অপর পিঠটাও দেখাতেন তাহলে সেখানে দেখা যেত বাঙালিরা বোকা, অতি মাত্রায় বৈষয়িক, দূরদর্শিতাহীন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একক হিসেবে ভীরু বললেই চলে। এর মধ্যে এই অতি বৈষয়িক বিষয়টি আমাকে বেশি ভাবায়। শুধু নিজে ভালো থাকার জন্য এই শ্রেণীর মানুষ সত্যকে এড়িয়ে যেতে লজ্জা পায় না। আমার ধারণা, সেখানেই আমাদের বিচ্যুতি ঘটে আর সেখানেই আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় হারিয়ে ফেলি।

আমরা ধীরে ধীরে নিজের মতাদর্শ বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে আবর্তিত হয়ে উঠি। রাজনৈতিক দল হিসেবে সে আপনি বাম কিংবা ডান যে পন্থার কথাই বলেন না কেন, এই উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক পথ চলায় কোনোদিনই কেউ মানুষের জীবনের মূল্যকে একটিবারের জন্য মূল্যায়ন করেনি। আমার কাছে জীবনের মূল্য এবং মর্যাদা দুটোই সর্বোচ্চ, তাই মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার সবার আগে, তার পর উন্নয়নের কথা। আর মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে। তাহলেই কেবল কবিগুরুর মতো করে বলতে পারব ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।

পরিশেষে আবার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই, ‘দেশের শাসক, এ ক্ষেত্রে রাজা, যতই অপ্রত্যক্ষ থাকেন দেশের জন্য ততই মঙ্গল। রাজা থাকবেন, তিনি লক্ষ করবেন সমস্ত কিছু, কিন্তু প্রয়োজন না হলে আত্মপ্রকাশ করবেন না। আদর্শ রাষ্ট্রে রাজার হস্তক্ষেপও ঘটবে কম, সেখানে নাগরিকরা সবাই সমান, ব্যবস্থাটা গণতান্ত্রিক। সবাই সম্মানিত এবং সবার মধ্যেই এই ভাবটা থাকবে যে রাজ্য তাদের সবার, মালিকানা তাদেরই।’


আরো সংবাদ



premium cement
উড়ছে বার্সালোনা, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ইয়ামাল ইরানের মাটিতে ইসরাইলের চালানো যত ‘গোপন অপারেশন’ নাইজেরিয়ায় নৌকাডুবে ৪০ জনের প্রাণহানি দোয়ারাবাজারে গলায় ফাঁস দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা ৬ অঞ্চলে ঝড়ের আশঙ্কা, নদীবন্দরে সতর্কতা অভ্যুত্থানে নিহতদের জন্য মসজিদে নববীতে সাঈদীর ছেলের দোয়া ভারত যাওয়ার পথে মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্তসহ আটক ৪ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা ইউনূসকে পদ্মায় চুবানো খালেদাকে ফেলার হুমকি, হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক সপ্তাহের মধ্যে পুনর্গঠন মহানবী সা. মানব জাতির অনুকরণীয় আদর্শ : তারেক রহমান

সকল