১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

রাষ্ট্র ও বিএনপির সংস্কার

রাষ্ট্র ও বিএনপির সংস্কার - ফাইল ছবি

রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইলে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব, সংগঠনেরও যুগোপযোগী আদর্শিক ও সাংগঠনিক সংস্কার প্রয়োজন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাই এ দলটির প্রথাগত পুরোনো ধাঁচের কার্যক্রম পুনর্মূল্যায়ন করে দলটির গঠনতন্ত্রে কিছু যুগোপযোগী সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে ও নিকট ভবিষ্যতে এই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিএনপিকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে বলে অনেকে মনে করেন।

এই একবিংশ শতাব্দীতে ‘জেনারেশন-জি’র বৈশিষ্ট্য তথা- সৃষ্টিশীলতা, মুক্তমন ও সংবেদনশীলতা (Creative, Open-minded, Sensitive) বুঝে এবং প্রযুক্তিভিত্তিক এই সমাজের চাহিদার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক দলকে তার আদর্শিক ও কৌশলগত অবস্থান আগে ঠিক করতে হবে। আদর্শিক অবস্থানের ভিত্তিতেই একটি দলের সাংগঠনিক বিভিন্ন দিক, দলের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতিগুলো নির্ধারিত হয়।
নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বিশ্ব বাস্তবতায় শুধু যদি বলা হয়, বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সে ক্ষেত্রে অনেক রকম বিতর্ক চলে আসে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। এই দলের গোড়াপত্তন হয়েছিল ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসের একটি অবস্থান থেকে। জিয়াউর রহমানের এই অবস্থান অল্প সময়ের মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি শক্ত জনভিত্তি তৈরি করতে পেরেছিল। তাই, নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় সভ্যতার সঙ্ঘাত যেখানে অনিবার্য বিষয় হিসেবে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেখানে দেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপর ভিত্তি করে মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনার প্রতি দৃষ্টি রেখেই বিএনপিরও উচিত সব ধর্মের প্রতি সম্মান এবং অধিকার নিশ্চিতের সাথে সাথে ইসলামী মূল্যবোধকে গুরুত্বের সঙ্গে দলীয় আদর্শের মধ্যে অবস্থান দিয়ে নীতিনির্ধারণ করা ।

দেশের মানুষ চায় না ভারত বা আমেরিকার তাঁবেদার কোনো গোষ্ঠী তাদেরকে শাসনের নামে আবার কারো দাসে পরিণত করুক। তারা এ-ও চায় না যে- ভারত, ব্রিটেন বা আমেরিকার সংবিধান নকল করে এনে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর আরোপ করা হোক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, আমাদের জাতীয়ভাবে এটি উপলব্ধি করা দরকার যে, এই জুলাই বিপ্লবের অন্যতম একটি কারণ আমাদের দেশের বাস্তবতায় ও সংস্কৃতিতে পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা। পশ্চিমা গণতন্ত্রের অন্ধ অনুসরণ, পশ্চিমা মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানের অনুকরণ বস্তুত তাদের দাসত্ব বরণ করা নয় কি? মানুষ কোনো তাঁবেদার শাসক বা শাসনব্যবস্থাও চায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সুলতানি বা নবাবী আমল ছিল আমাদের জাতি হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তি, সমৃদ্ধি ও গৌরবমণ্ডিত সময়। তাই, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আমাদের সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে আমাদের দেশের নতুন সংবিধান ও শাসনব্যবস্থার রূপরেখা প্রস্তাব করতে পারে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। প্রাচীন, মধ্যযুগ বা আধুনিক যুগ কোনো বিষয় নয়; দেখতে হবে আমরা কখন সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে সমাজে অধিকতর শান্তিতে ছিলাম। প্রাচীনকাল থেকে আমরা ভাত খাই। এর মানে এই নয়, বর্তমান যুগে ভাত খাওয়া সেকেলে একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ঠিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও প্রাচীন, মধ্যযুগ অথবা আধুনিক যুগের সমন্বয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা আসতে পারে। আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধরন হওয়া উচিত আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্ধ দাসত্বের মধ্যেই ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা লুকিয়ে আছে- এটিই প্রমাণিত হয়েছে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

গত ১৫ বছরে আমরা আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে অল্প কিছু নতুন নেতৃত্ব দেখতে পেলেও বিএনপির মধ্যে সে ধরনের নতুন নেতৃত্ব দেখতে পাইনি। যেহেতু, বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল, তাই দলটির উচিত তাদের সংবিধানের মধ্যেও যুগোপযোগী পরিবর্তন এনে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতি বছর কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন সদস্য এবং নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা। দুঃখের ব্যাপার, বড় দলগুলো তাদের গঠনতন্ত্র খুব কমই মেনে চলে। কর্মী ও সদস্যদের কাছে কোনোরকম জবাবদিহির কোনো উল্লেখ আমরা তাদের গঠনতন্ত্রে দেখতে পাই না। প্রকৃত অর্থে দলগুলোর অভ্যন্তরে ‘টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ’ রয়েছে যার কারণে নিয়মতান্ত্রিক চর্চা বা তার অনুকূল কোনো পরিবেশ দলে নেই। দলীয় শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক বা সিনিয়র নেতাদের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৃণমূলের বা তরুণ কর্মীদের সমালোচনার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন ‘উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নীতি বা সংস্কৃতি’ই মূলত দেশে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল।

শুধু ‘ভোট’ নেতা নির্বাচনের একমাত্র নির্ধারক হিসেবে দলীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থাকা উচিত নয়। নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়াগুলো আমরা অন্যান্য উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশগুলোর থেকে গ্রহণ করতে পারি। যেমন, নিরপেক্ষ কিছু ব্যক্তি দিয়ে দলের তরুণ নেতৃত্ব নির্বাচনের একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া দলে সংযোজন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য কিছু নির্ধারক (Indicator) ঠিক করে দলীয় ফোরামে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বা নম্বর প্রদান করে নতুন নেতৃত্ব বাছাই করা। এই নির্ধারকগুলোর মধ্যে থাকতে পারে একজন কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, গত এক বছরে তার দলীয় ও সামাজিক অঙ্গনে অবদান, উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এগুলো শুধু বিএনপি নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব মূলত নির্বাচিত হয় একজন কর্মীর পেশিশক্তি, টাকা ও পারিবারিক প্রভাবের উপর নির্ভর করে। সত্যিকার অর্থে একজন কর্মীর নেতৃত্বের গুণাবলি, সদস্যদের মধ্যে সমর্থন, সততা, মেধা ও দলের প্রতি ত্যাগের মতো বিষয়গুলো খুব কম ক্ষেত্রেই বিবেচনায় নেয়া হয়।

বিএনপিতে গত ১৬ বছরের জুলুম ও নির্যাতনের শিকার ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন হওয়া দরকার। আমাদের পরিচিত অসংখ্য ত্যাগী নেতা আছেন, যাদেরকে বিগত দিনে মোটেই যোগ্যতা-মেধা-ত্যাগ অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়নি। জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক নেতৃত্বের কোনো সংস্কৃতি ও লক্ষণ আমরা বিএনপিতে এখনো দেখতে পাচ্ছি না। দলটির নীতি এবং আদর্শের সংরক্ষণ ও দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যে ধরনের মিডিয়া ও রিসার্চ ইউনিট বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত ছিল, তা বিগত দিনে তেমন দেখা যায়নি। ফলে বিরোধী দলে থাকাকালীন দলটির নীতি আদর্শ ও কার্যক্রমগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার মতো তেমন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস আমরা লক্ষ করিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে আরো একটু বাড়ানো উচিত এবং জিয়াউর রহমান যেমন মেধার ভিত্তিতে তার ‘ক্যাবিনেট অব ট্যালেন্ট’ তৈরি করেছিলেন তেমনি করেই দলের মধ্যে শিক্ষিত ও গুণীজনদের সুযোগ করে দেয়া উচিত। দলের চেয়ারম্যানের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা উচিত। চেয়ারম্যান প্রয়োজন মনে করলে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, স্থায়ী কমিটি এবং চেয়ারম্যান মনোনীত অন্য কমিটিগুলো বাতিল করতে পারেন। সব কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারেন। জাতীয় কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যার তিন-চতুর্থাংশের ভোট যদি চেয়ারম্যান অপসারণের অনুকূলে হয় তাহলে চেয়ারম্যানকে অপসারিত করা যাবে, তবে জাতীয় কাউন্সিলের ওই দাবিতে চেয়ারম্যানের অপসারণে সভায় একমাত্র বিষয় হিসাবে দেখাতে হবে এবং অপসারণের কারণ স্পষ্টভাবে লিখিত থাকতে হবে। বিএনপির গঠনতন্ত্রের এ ধারাগুলো অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কারণ এভাবে কোনো চেয়ারম্যানকে পরিবর্তন করা একরকম অসম্ভব। এ ধরনের নীতি দলের অভ্যন্তরে স্বৈরাচারী সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারে।

ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ না করা ছিল জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। পাশাপাশি ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বের সাথে একটি সৌহার্র্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল উদারনৈতিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাও ছিল তার অন্যতম সফল নীতি। এই নীতিটির চর্চা আমরা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তেমন দেখতে পাইনি। মূলত এটিই বিএনপির জনসমর্থন দুর্বল করেছে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী। অবশ্যই আমরা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলোকে মাথায় রেখে এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে ভারতের সাথে একটি সুষম সম্পর্ক রাখতে চাই। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই নতজানু নীতির মাধ্যমে নয়।

বিএনপি তথা দেশ গড়া ও শাসনের সাথে যারা সম্পৃক্ত সব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে হবে, এই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রধান মন্ত্র ছিল ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও মানবিক মযাদাপূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা। এই মন্ত্রগুলো বিএনপি যদি তার আদর্শ ও কার্যক্রমের মধ্যে ধারণ করতে পারে তাহলে এই নতুন সময়ে তারা নতুন প্রজন্মের কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারবে।

লেখক : শিক্ষক, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি
ই-মেল: khansarifuzzaman@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ৪৬ ঘণ্টা পর লঞ্চ চলাচল শুরু উড়ছে বার্সালোনা, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ইয়ামাল ইরানের মাটিতে ইসরাইলের চালানো যত ‘গোপন অপারেশন’ নাইজেরিয়ায় নৌকাডুবে ৪০ জনের প্রাণহানি দোয়ারাবাজারে গলায় ফাঁস দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা ৬ অঞ্চলে ঝড়ের আশঙ্কা, নদীবন্দরে সতর্কতা অভ্যুত্থানে নিহতদের জন্য মসজিদে নববীতে সাঈদীর ছেলের দোয়া ভারত যাওয়ার পথে মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্তসহ আটক ৪ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা ইউনূসকে পদ্মায় চুবানো খালেদাকে ফেলার হুমকি, হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক সপ্তাহের মধ্যে পুনর্গঠন

সকল