অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা
- ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব
- ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৪০
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে অনেকটা বিনা চ্যালেঞ্জে, বিনা বাধায়। স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে একইভাবে। মানুষের ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং মৌলিক মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছে চরমভাবে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে নিজের স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে। ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় এবং গত ৫ আগস্ট ২০২৪, সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অনেক বেশি। এই সরকারকে সংস্কার ও রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে সময় নিয়ে এবং মূল্য দিতে হবে জনগণদের প্রত্যাশার।
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতে হলে সবার আগে দরকার বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। বিচার বিভাগ নামেমাত্র স্বাধীন হলেও বিগত সরকার ভিন্নমত ও পথ দমন ও নিপীড়নের জন্য বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে একদম নিজের মতো। রাজনৈতিক পরিচয়ে বিচারক নিয়োগ দেয়ায় ন্যায়বিচার হয়েছে চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত।
বিগত দিনের অবিচার, বিচারহীনতা, বিরোধীপক্ষকে হয়রানি, নামে-বেনামে মামলা, গায়েবি মামলা, বিচারকদের রাজনীতি, মামলার জটসহ বিদ্যমান সমস্যা দূরীকরণে সবার আগে দরকার সেপারেশন অব পাওয়ার, বিচারকদের বিচারিক কাজ মনিটর করার জন্য ওয়াচডগ ও মনিটরিং সেল তৈরি করা, বর্তমান আইন কমিশনকে ঢেলে সাজানো, বিচারকদের বিচারিক কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারক বৃদ্ধি, বিচার কার্যালয় বৃদ্ধি, রিমোট হিয়ারিং সিস্টেমের ব্যবস্থা, আদালতে আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা, বিচারকদের আধুনিক ট্রেনিং দেয়া এবং আদালতপাড়ায় দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। দল-মত নির্বিশেষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না গেলে রাজনৈতিক যে সরকারই ক্ষমতায় আসবে তারাও ঠিক তাদের পূর্ববর্তীদের মতো বিচার বিভাগের গলা চেপে ধরবে, আর সাধারণ জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।
শিক্ষা খাত বাংলাদেশের দুর্বলতম খাতগুলোর অন্যতম। এই খাতে বাজেট বরাদ্দ তলানিতে। কয়েক দিন পরপর শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কাটাছেঁড়া চলেছে। শিক্ষার নিন্মমান, দলীয় পরিচয়ে অযোগ্য-অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং ব্যবসায়, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, কারিগরি শিক্ষার অপ্রতুলতা ইত্যাদি সমস্যার কারণে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিমুখী।
শিক্ষার উন্নয়নে দরকার ক্ষেত্রে বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি বন্ধ করা, মেধাবীদের মূল্যায়ন করা, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, মেধা পাচার বন্ধ, ব্যবসায়িক শিক্ষার প্রসার, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা আবশ্যক করা, সত্যিকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন দলের পরামর্শে শিক্ষা, সিলেবাস, দলীয় বিষয় অন্তর্ভুুক্তি আইনের মাধ্যেমে বন্ধ করা। পাশাপাশি গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের ট্রেনিং, আধুনিক অবকাঠামো বৃদ্ধি, প্রয়োজনে অনলাইন ক্লাস চালু করা, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ফ্রি স্কুল মিল চালু করা, বিনামূল্যে কলেজ পর্যন্ত ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, টিচিং স্ট্যান্ডার্ড মেনটেন করা, কিন্ডারগার্টেন, কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, আবার মাদরাসার মধ্যে কওমি, আলিয়া, ইবতেদায়ি ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা দরকার।
স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিটি সরকারই সিকিউরিটি ফোর্সকে নিজেদের মতো ব্যবহার করে আসছে। পতিত সরকারের সময় পুলিশ সরকারের দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ঘুষ, হয়রানি, বিরোধী পক্ষকে দমন, নিপীড়ন, গায়েবি মামলা প্রদান, গুম, খুন, হত্যার মাধ্যমে বিরোধী মত শায়েস্তা করার জন্য পুলিশ, বিজিবি এমনকি সেনাবাহিনীকে যত্রতত্র ইচ্ছামতো ব্যবহার করা হতো। ফলে পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ বেড়েই চলছিল। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আমরা দেখেছি পুলিশবাহিনীর ওপর জনগণের ক্ষোভ। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, অন্যায়-অত্যাচার বন্ধে স্বাধীন সিকিউরিটি ফোর্স এখন সময়ের দাবি। পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনীতে পরিণত করা, আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা কায়েম করা, তাদের বেতন বৃদ্ধি করা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া, অস্ত্র ব্যবহারকে জবাবদিহির আওতায় আনা, আধুনিক ট্রেনিং প্রদান, রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করা, পুলিশকে স্বাধীন ক্ষমতা প্রদান এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। পাশাপাশি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি করার জন্য একটি পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করা।
দেশে মানসম্মত আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যাও বিদ্যমান। আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, প্রতিটি জেলা শহরে আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা, সরকারিভাবে সম্ভব না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে বড় ও সর্বাধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা, হেলথকার্ড চালু করা, যতটা সম্ভব বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করা না গেলেও প্রাইভেট চিকিৎসার একটি ফি কাঠামো তৈরি করা, রোগীকে অহেতুক হয়রানি না করা, বিনা প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সংস্কৃতি বন্ধ করা, চিকিৎসাব্যয় কমানো, চিকিৎসকদের জবাবদিহির আওতায় আনা, কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা, রোগীদের ডাটাবেজ তৈরি ও সমন্বয়ের স্বার্থে রেকর্ড শেয়ার করা। এ জন্য একটি টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে যানজট অন্যতম প্রধান সমস্যা। যানজটের জন্য প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করা দরকার।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া বা সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা ছিল একটি কমন বিষয়। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য চারটি পত্রিকা ছাড়া সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছিল শেখ মুজিবের আমলে। এর ধারাবাহিকতায় সব সরকারই সংবাদমাধ্যমকে সবসময়ে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে অভ্যস্ত। তবে গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী সরকার বিগত দিনের সমস্ত ইতিহাসকে ভঙ্গ করে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিরোধী সংবাদমাধ্যম দমনের সব অতীত ইতিহাসকে ভঙ্গ করেছে, বন্ধ করেছে বহু পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল। অন্যদিকে, হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক ছাড়া, সব সাংবাদিকদের নিজেদের কর্মিবাহিনীতে পরিণত করেছে। সাংবাদিকরাও নিজের ঐতিহ্য, কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গ করে স্বৈরাচারী তোষণে ব্যস্ত ছিলেন। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, সাংবাদিকরা সরকারের গুণগানে ব্যস্ত ছিলেন। সাংবাদিকদের কেউ কেউ চাঁদাবাজি, অসত্য রিপোর্ট প্রকাশ, দুর্নীতি, ঘুষ এবং ভিনদেশীদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে জড়িত হয়ে পড়েন। বিষয়গুলি দুঃখজনক।
সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরাই সাংবাদিকের কাজ। সরকারকে সুপরামর্শ, গঠনমূলক সমালোচনা, সরকারের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরার জন্য সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতা দিতে হবে। সাইবার সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার রোধ, সরকারি লেজুড়বৃত্তি বন্ধ, ভুল তথ্য-উপাত্ত প্রকাশে আইনের আওতায় আনার জন্য আধুনিক ও বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এক কথায়, সত্যিকারের স্বাধীন ও আধুনিক গণমাধ্যম গড়ে তোলার জন্য যা করা দরকার, সরকারকে তাই করতে হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি অন্যতম খাত রেমিট্যান্সে। প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যখন দেশে আসেন তখন তারা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন বিমানবন্দরে। তারা নানা হয়রানি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হন। বর্তমান সরকারকে প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় নজর দিতে হবে। প্রবাসীদের জন্য নতুন নতুন দেশে কর্মসংস্থান, আধুনিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী করে গড়ে তোলা, কম্পিউটার স্কিল ও বেসিক আইটি ও প্রযুক্তি ট্রেনিং প্রদান করা, অল্প খরচে বিদেশে শ্রম রফতানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে এমন একটি সেক্টর নেই যার সংস্কার দরকার নেই। বরং দেশটি এক খাদের কিনারায় অবস্থান করছে। দেশের অর্থনীতি আজ শূন্যের কোঠায়। সুন্দর ও সম্ভাবনায় রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছিল শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলদারির সাথে সাথে গুম, খুন, হত্যা যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সয়লাব হয়েছে গত ১৫ বছরে, এতে মানুষ হাল ছেড়েই দিয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে নতুন সম্ভাবনাময় একটি সরকার তার যাত্রা শুরু করেছে। ক্ষয় হয়ে যাওয়া এই রাষ্ট্রের সংস্কার ও মেরামত করতে হবে সময় নিয়ে।
লেখক : বার অ্যাট ল
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা