সম্মিলিত চেষ্টায় দুর্যোগ মোকাবেলা হোক
- ড. আনোয়ার হোসেন
- ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৫
পানি কিছুটা নামতে শুরু করলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির এখনো আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। দেশের ১২ জেলার মানুষ এখনো নজিরবিহীন বন্যায় ভারাক্রান্ত। এরকম বন্যার প্রকোপ ও পানির তাণ্ডব এ পর্যন্ত আমরা স্বচক্ষে দেখিনি। যারা বন্যার ইতিহাস সম্পর্কে জানেন, তাদের অনেকে বলেছেন, ১৯২২ সালে অর্থাৎ প্রায় ১০২ বছর আগে এরকম বন্যা একবার হয়েছিল। এবার অতিবৃষ্টিতে ও ভারতীয় উজান থেকে ধেয়ে আসা পানিতে ভয়াবহ এই বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এখন একেবারে বিপর্যস্ত। বন্যা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ দেখা গেছে ফেনীতে।
এছাড়া নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা এবং কক্সবাজার জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এই জেলাগুলোতে এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাচ্ছে গৃহপালিত প্রাণীও। বন্যায় দেশের ১২ জেলার ৮০টিরও বেশি উপজেলা ও ৫৮৪টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভা প্লাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৮০ লক্ষাধিক। এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মাত্র দুই লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
এই বন্যার জন্য অনেকেই ভারতকে দায়ী করছেন। বলা হচ্ছে, ভারত ষড়যন্ত্র করে পানি ছেড়ে দেয়ায় এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, এটি ভারতসৃষ্ট রাজনৈতিক বন্যা। বাংলাদেশের একজন পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, এ বন্যা প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে অতিবৃষ্টির কারণে। এ কথা বলায় তাকে অনেক বিরূপ কথা শুনতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভারত কমপক্ষে দু’টি বাঁধ খুলে দেয়ায় এই বন্যা ত্বরান্বিত হয়েছে। যাই হোক এটা তো সত্যি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ভারত বর্ষাকালে নিজেদের প্রয়োজনে বাংলাদেশকে পানি দিয়ে তলিয়ে দিচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে সব পানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারছে। নদী-নালা, খাল-বিল ও ফসলি জমি চৌচির ও ধূ-ধূ বালুকাময় করে দিচ্ছে। এ বন্যার পেছনেও ভারতের ষড়যন্ত্র থাকা অস্বাভাবিক নয়। ভারত আমাদের তিস্তার পানিও দিচ্ছে না। ফারাক্কা বাঁধসহ অভিন্ন নদীর উজানে তারা অন্যায়ভাবে বাঁধ নির্মাণ করেছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ না দিয়ে প্রায়ই অভিন্ন নদীর স্লুইস গেটগুলো খুলে দেয়। যা থেকে বাংলাদেশ হঠাৎ করে প্লাবিত হয় এবং অমানবিক এক অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়।
বর্তমানে বন্যার এই ক্রান্তিলগ্নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অর্থ খাবার ও আনুষঙ্গিক উপকরণ নিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকার দিকে ছুটছে। শিশুরাও তাদের জমানো অর্থ বন্যার্তদের জন্য দান করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল অনেক ভিক্ষুকও বন্যার্তদের জন্য ১০ টাকা হলেও দান করছেন। এমন ঘটনায় প্রশংসায় ভাসছেন প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকরাও। যে মানুষ জীবনে কোনো দিন একজন অন্ধ ব্যক্তিকেও দান করতে পকেটে হাত দেননি, তিনিও অকাতরে দান করছেন এই বন্যাদুর্গতদের জন্য।
দলমত নির্বিশেষে পুরো জাতি এখন এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। সব ভেদাভেদ ভুলে আমরা যেন একে অপরের অভিন্ন সত্তা হয়ে উঠেছি। এই বন্যায় আমাদের একে অপরের প্রতি যে সহমর্মিতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে, এ জাতিগত ঐক্য ধরে রাখতে পারলে পরবর্তীতে যেকোনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবো বলে বিশ্বাস করি। এর মাধ্যমে হয়তো আমাদের জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। এ ঐক্য ধরে রাখতে পারলে এখন পর্যন্ত যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতেও হয়তো বেশি সময় লাগবে না।
নজিরবিহীন বন্যায় গত কয়েক দিনে যা কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরছি। গত ২২ আগস্ট নোয়াখালী সদরের এক ভদ্রলোক কল করে জানালেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তার ঘরে পানি। বিদ্যুৎ নাই, রান্নাঘর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় শুকনো খাবার খেয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন। তিনি আরো জানান, জীবাণুযুক্ত পানির কারণে তার ও পরিবারের অন্য সদস্যদের হাতে-পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। পুরো শরীরেও চুলকানি দেখা দিয়েছে। একই দিন আরেক ভদ্রলোক কল করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তিনি ছয় লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মৎস্য প্রজেক্ট করেছেন। সব প্রজেক্টই ভেসে গেছে। তিনি কিভাবে এখন ঋণ শোধ করবেন, এ নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেই। একই দিনে আরেক ভদ্রলোক জানান, বন্যায় তার ঘরে হাঁটুপানি। তার গরু ছাগলের খামার রয়েছে। ছাগলগুলো প্রায় পানিতে ভাসছে, গরুগুলোর শরীরও পানিতে অর্ধেক ডুবন্ত। দোকানপাট বন্ধ থাকায় খো-খাদ্যের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। গবাদিপশুগুলো তিনি বাঁচাতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার আমার আরেক আত্মীয় জানান, তিনি বন্যার কারণে মৎস্যখামার খুইয়েছেন। গবাদিপশুগুলো নিয়েও খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এক আত্মীয় ফোনে জানান, তিন দিন আগে তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। তাকেও শারীরিকভাবে আঘাত করেছে।
দুর্গত এলাকায় বিদ্যমান এসব পরিবেশ পরিস্থিতি সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া মোকাবেলা করা অসম্ভব।
লেখক : কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা