২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব ভারতকে বুঝতে হবে

বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব ভারতকে বুঝতে হবে - ছবি : সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার তুমুল গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোয় সরকারের সাথে ভারতের যে অতিমাত্রার বন্ধুত্ব ছিল, তারও পতন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। উভয় আমলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট।

বাংলাদেশে যতবার আওয়ামী লীগের শাসনামল ছিল ততবার ঢাকা-দিল্লি সবসময় তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্কের কথা বলেছে। একে অপরকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা সব সময় এ সম্পর্ককে বিশ্বে রোলমডেল হিসেবে বর্ণনা করেছে। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগের পতন এবং বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন-পরবর্তী সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার এ সম্পর্ক কী রকম হবে, তা আজ আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আর কখনো আওয়ামী লীগের শাসনামলের মতো হবে না। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারতের প্রতি বাংলাদেশ সবসময় অন্ধ আনুগত্য করেছে। বাংলাদেশ সবসময় ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় ভারতের চাওয়া পূরণ করেছে। ভারতের কোনো কাজের প্রতিবাদ করেনি; বরং ভারতের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। স্বয়ং শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে তা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। কিন্তু এর বিপরীতে ভারত বাংলাদেশকে কিছু দেয়নি।

আওয়ামী লীগের সব শাসনামলে বাংলাদেশের শাসকরা ঘন ঘন ভারত সফর করতেন। একইভাবে ভারতের শাসকরাও ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করেছেন। ভারতের নেতারা সবসময় আওয়ামী লীগকে অব্যাহত সমর্থনের কথা বলেছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে। তাদের ক্ষমতায় রাখতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। ভারত কখনো এ দেশের জনগণের পক্ষে কথা বলেনি, এ দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় কথা বলেনি; বরং সবসময় আওয়ামী লীগের স্বার্থে কথা বলেছে। আসলে ভারতের অব্যাহত ও একনিষ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে। ভারতের একনিষ্ঠ সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন না করে একটানা ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে দিল্লির সম্পর্ক দেখে মনে হয়েছে; ভারতের সব চাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার পূরণ করবে। বিনিময়ে ভারত সরকার আওয়ামী লীগকে এ দেশের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে। এসব কথা বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনগণ আজ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ অনেক চুক্তি করেছে। এসব চুক্তির সব ভারতের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে। যেমন ”ট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতকে অনুমতি, বাংলাদেশের নদী ব্যবহারের অনুমতি এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে রেল যোগাযোগের অনুমতি ইত্যাদি। কিন্তু ভারত এখনো তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি করেনি। বাংলাদেশকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। শুধু তা-ই নয়, ভারত বর্ষাকালে ইচ্ছামতো পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে বন্যায় ডুবিয়ে মারে। আর গ্রীষ্মকালে পানি আটকে রেখে শুকিয়ে মারে। একইভাবে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা কখনো বন্ধ করেনি।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের চার হাজার ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্তে বিএসএফের বাংলাদেশী হত্যা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এ দিকে শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। ভারতকে এ সত্য আজ মানতে হবে।

ভারত একটি বিশাল দেশ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী। অন্য দিকে বাংলাদেশ ছোট্ট রাষ্ট্র হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের যাতায়াতের একমাত্র পথ হচ্ছে বাংলাদেশ ও নেপালের মাঝখানে অবস্থিত ২০-২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে শিলিগুড়ি করিডোর, যা চিকেন নেক নামে পরিচিত। এ অবস্থায় ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সেভেন সিস্টার্সে যেতে এবং সেভেন সিস্টার্স থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে যেতে সড়কপথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এতে প্রচুর সময় এবং অর্থ খরচ হয়। ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে আগরতলায় যেতে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু ভারতের আসাম হয়ে কলকাতা থেকে আগরতলায় যেতে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। ফলে সময় লাগে বেশি, পরিবহন খরচ হয় বেশি এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ জন্য ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে রেল চলাচলের অনুমতি চায়। কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগের অনুমতি ভারতকে আমরা কখনো দিতে পারি না। একইভাবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ও ভারতকে দিতে পারি না। কারণ এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ায় শঙ্কা থেকে যায় এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ চায়, অথচ বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ২০-২২ কিলোমিটারের চিকেন নেক ব্যবহারের অনুমতি ভারত কখনো বাংলাদেশকে দেয়নি। ভারতের এসব দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ঐতিহাসিকভাবে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলেমিশে একসাথে বসবাস করছেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করছেন।

সুখে-দুঃখে একে অপরের অংশীদার তারা। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সব এ দেশে নিরাপদ। অথচ ভারত সবসময় বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে, যা কখনো প্রমাণিত হয়নি। ভারতের একশ্রেণীর মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ সবসময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে এর পক্ষে সাফাই গায় এবং প্রচার-প্রপাগান্ডা চালায়। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এ দেশে প্রায় ৯ শতাংশ হিন্দু বসবাস করে। এ দেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং চাকমা, মারমা, গারো, মুরংসহ বিভিন্ন উপজাতি একসাথে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করেন। এখানে এক দেশ এক জাতি, আমরা সবাই বাংলাদেশী। অথচ ভারত সব বাংলাদেশীর স্বার্থে কথা না বলে সব সময় শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থে কথা বলে। দিল্লির এ আচরণ ভারতকে সর্বজনীন না করে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত নিজেকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ে প্রতিনিধি করেছে। ভারতের এসব আচরণ এ দেশের সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না। এমনকি হিন্দুদের বিরাট একটি অংশও আজ ভারতের এই নীতি সমর্থন করে না। এই বাস্তবতা ভারতকে বুঝতে হবে।

বাংলাদেশ বরাবর ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সুস¤পর্ক চায়। এর জন্য ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারত বিরাট রাষ্ট্র ও স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব বেশি। এত দিন পর্যন্ত ভারত সবসময় আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক রেখেছে, বাংলাদেশের আপামর জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখেনি। কথাটি সত্য বলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সাথে সাথে সে সম্পর্কও ভেঙে পড়েছে। সুতরাং ভারতকে এ নীতি পরিহার করতে হবে। কোনো বিশেষ দল এবং কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি নয়, ভারতকে বাংলাদেশ এবং এ দেশের আপামর জনগণের সাথে সম্পর্ক করতে হবে। তা না হলে সম্পর্ক কখনো টেকসই হবে না।

দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা দুর্বল ও অর্থনৈতিক ক্ষতি করে আমরা ভারতের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি না। ভারতকে মনে রাখতে হবে, অভিন্ন নদীর পানিতে আমাদের যে অধিকার রয়েছে তা আমাদের দিতে হবে। সীমান্তে হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা না বলে সব বাংলাদেশীর স্বার্থে কথা বলতে হবে দিল্লিকে।
ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও প্রভুত্ব আর নয়। ভারতের দাসত্ব করতে এ দেশের মানুষ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হননি। স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখে ভারত-বাংলাদেশ হতে হবে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের জনগণ একপক্ষীয় সম্পর্ক চায় না। এই বাস্তবতা ভারত সরকার এবং সেদেশের শাসকশ্রেণী যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, তত দিল্লির জন্য মঙ্গল।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
হিন্দু পল্লীতে আগুন : মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন নাইক্ষ্যংছড়িতে আ’লীগের দুই নেতা কারাগারে লজ্জায় ডুবলো শ্রীলঙ্কা, মাত্র ৪২ রানে অলআউট সাবেক এমপি রশীদুজ্জামানের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হজযাত্রী নিবন্ধনের সময় বাড়লো ‘সমাবর্তন ছাড়াই মূল সনদপত্র পাবে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা’ রাজশাহীতে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সিকাণ্ডে গ্রেফতার ৩ চিন্ময়ের গ্রেফতারে কুমিরের কান্না কাঁদছে শেখ হাসিনা : রিজভী কাউনিয়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে ব্যবসায়ী নিহত মুন্সিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের স্বীকৃতি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত শ্রম কমিশনের অগ্রাধিকার

সকল