১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

এখন দরকার কারিকুলাম ও মূল্যায়নে সংস্কার

-

শিক্ষা হলো শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের একটি প্রক্রিয়া। যেটি সারা জীবন ধরে চলতে থাকে। অর্থাৎ শিক্ষা হলো জীবনের সাথে যুক্ত ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সুতরাং শিক্ষা হলো এমন একটি বিষয় যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন বিকাশের সমস্ত দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। যেমন- সৃজনশীলতার বিকাশ, মূল্যবোধের বিকাশ, নৈতিক বিকাশ, চারিত্রিক বিকাশ, আধ্যাত্মিক বিকাশ, সামাজিক বিকাশ প্রভৃতি।

ইংরেজি শব্দ কারিকুলামের বাংলা পরিভাষা শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম, পাঠক্রম ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে কারিকুলাম শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে শিক্ষাক্রম ব্যবহার করা হয়েছে। এক কথায় আমরা বলতে পারি, কারিকুলাম হচ্ছে শিক্ষার সংবিধান।

বিশ্বব্যাপী জাতীয় শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য ও মতবাদ সম্পর্কে নানাবিধ ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য অনেক ধারণার মধ্যে একটি হলো :

‘জাতীয় পাঠ্যক্রম প্রতিটি গ্রেডে অর্জন করা জ্ঞান এবং দক্ষতার ন্যূনতম মানগুলো নির্দিষ্ট করে এবং সব বিষয়ে উচ্চ, অর্জনযোগ্য মান নির্ধারণ করে।’

একটি শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি হঠাৎ করে শতভাগ পরিবর্তন পৃথিবীর কোনো দেশই করে না। পরিবর্তন আনতে হয় সাম্যাবস্থা বজায় রেখে একটু একটু করে যাতে ভুল হলেও ক্ষতি কম হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে স্বৈরাচার সরকারের হাতে ছিল তার প্রধান প্রমাণ হলো একসাথে শতভাগ পরিবর্তন করা। বিগত সরকার আমাদের দেশে যে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে তা পৃথিবীর বেশ কিছু উন্নত দেশে চালু আছে। নতুন কারিকুলাম নিঃসন্দেহে ভালো কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা বিবেচনায় না এনে হুট করে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, বাস্তবায়নের আগে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সব স্টেকহোল্ডারের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি।

আমরা জানি, নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা শিখবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মধ্য দিয়ে। এ ধরনের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে নিম্নের স্কুলভিত্তিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে হবে-

বাজেটে বরাদ্দ : ইউনেস্কোর পরামর্শ মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত। উন্নত দেশগুলো মোট জিডিপির ৬ থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করে থাকলেও আমরা ব্যয় করি ২ শতাংশের নিচে।

অবকাঠামো উন্নয়ন : গ্রাম-শহরকে পার্থক্য না করে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য পরিকল্পনামাফিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে।

স্তর অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পৃথকীকরণ : প্রাথমিক বিদ্যালয়-প্রথম শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়-সপ্তম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়-দশম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ বেশ কিছু উন্নত দেশে এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি ‘৬-৩-৩-৪’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষা ছয় বছরের, জুনিয়র হাইস্কুল তিন বছরের, সিনিয়র হাইস্কুল তিন বছরের এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চার বছর। সেই দেশগুলোতে জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা বাধ্যতামূলক এবং কোনো কোনো দেশে তা বিনামূল্যে পড়ারও সুযোগ রয়েছে।

ডিজিটাল ক্লাসরুম : দেশের সব প্রতিষ্ঠানের সব ক্লাসরুম ডিজিটাল ক্লাসরুমে রূপান্তরিত করতে হবে।

লাইব্রেরি সুবিধা : বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই লাইব্রেরি সুবিধা নেই। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে সেগুলোতে পর্যাপ্ত দেশী-বিদেশী বই নেই। প্রত্যেক বছর সরকারিভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক বই সরবরাহ করতে হবে।
বিজ্ঞানাগার : বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই বিজ্ঞানাগারের কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও তার জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ নেই। এ ধরনের অসুবিধা দূর করার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে ল্যাবরেটরি ভবন তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের বিভিন্ন ল্যাবের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে।

কম্পিউটার ল্যাব : ডিজিটালের তকমা লাগানো এ দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই কম্পিউটার ল্যাব সুবিধা নেই। দু’-চারটি কম্পিউটার থাকলেও তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে বা সেগুলো অনেক পুরোনো আমলের। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কমপক্ষে দু’টি আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনপূর্বক ইন্টারনেট সংযোগ দিতে হবে।

ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব : উন্নত দেশগুলোর কারিকুলাম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নিজ মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্য একটি বিদেশী ভাষা শিখছে। বিষয়টি বিবেচনায় এনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব স্থাপন জরুরি।

যুগ তথা দেশ-বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী বিষয় নির্ধারণ : নতুন কারিকুলামে গতানুগতিক বিষয় তো থাকবেই। এ ছাড়াও যুগ তথা দেশ-বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের বিষয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মানবসম্পদের দেশ। এ দেশ থেকে প্রতি বছর বহু লোক কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যান, যার বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণীর। নতুন কারিকুলামে সিনিয়র হাইস্কুল (দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী) পর্যায়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষা রয়েছে। এই বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়গুলো এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা সিনিয়র হাইস্কুল থেকে বেরিয়ে দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। উন্নত দেশগুলোতে সিনিয়র হাইস্কুলগুলো সব স্পেশালাইজড। সিনিয়র হাইস্কুলগুলো নির্দিষ্ট বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের স্পেশালাইজড হিসেবে গড়ে তোলে। ফলে শিক্ষার্থীরা সিনিয়র হাইস্কুল থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। উল্লেখ্য যে, উন্নত দেশগুলোতে সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় না। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। বাস্তবতার নিরিখেই আমাদেরও সিনিয়র হাইস্কুলগুলো সব স্পেশালাইজড করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ, জাতি হিসেবে আমরা আর শ্রমিক হয়ে থাকতে চাই না।

বিষয়-ভিত্তিক বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকরণ : কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগেই বিষয়ভিত্তিক বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে হবে। এতদসঙ্গে পাণ্ডুলিপিগুলোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বানান সংশোধনসহ সব ধরনের কাজ দেশসেরা লেখকদের দ্বারা শেষ করতে হবে। এরপর বিষয়-ভিত্তিক একাধিক শিক্ষক দিয়ে নানাভাবে পাণ্ডুলিপিগুলো দেখতে হবে বা রিসার্স করতে হবে। দুনিয়ার কোনো দেশের বইতেই সাধারণত ভুল থাকে না। অথচ আমাদের দেশে সরকারিভাবে ছাপানো এনসিটিবির বইগুলো ভুলে ভরা। ভুলগুলো দেখে মনে হয়, ভালো করে প্রুফ রিডিং করা হয়নি ও সময় দিয়ে পাণ্ডুলিপিগুলো প্রস্তুত করা হয়নি। ইদানীং ভুলের হাত থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য বইগুলোতে পরীক্ষামূলক সংস্করণ লিখছে। এ ছাড়াও ইংরেজি ভার্সনের বইগুলোর অনুবাদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশ নিম্নমানের।

মূল্যায়ন পদ্ধতি : যেকোনো কারিকুলাম বাস্তবায়নে মূল্যায়ন পদ্ধতি অতিব গুরুত্বপূর্ণ। যেটি কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগেই ঠিক করা উচিত ছিল। অথচ আমাদের দেশে মূল্যায়ন পদ্ধতি/নীতিমালা প্রণয়ন না করেই শিক্ষকদের দিয়ে জোর করে নতুন কারিকুলামের শিখন শেখানোর কাজ শুরু করে। ষান্মাসিক পরীক্ষার আগে তরিঘড়ি করে মূল্যায়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একজন শিক্ষককে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে হচ্ছে এবং গড়ে একজন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষককে শতাধিক ডাটা ইনপুট দিতে হবে। বিষয়টি খুবই সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়াও মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত নৈপুণ্য অ্যাপসটি কারিগরি ত্রুটিতে ভরা।
শিক্ষা উপকরণ : বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা উপকরণ শ্রেণিভিত্তিক সরকারিভাবে ক্রয়পূর্বক প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতে হবে এবং তা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আলমিরাহ বা সেলফও সরবরাহ করতে হবে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত : শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত একজন শিক্ষককে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার দিকে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২০ কে আদর্শিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুলপর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের একটি চিত্র তুলে ধরছি। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত নরওয়েতে যথাক্রমে ১:১১ এবং ১:১০, স্পেনে যথাক্রমে ১:১৩ এবং ১:১০, জাপানে যথাক্রমে ১:১৬ এবং ১:১২, ফ্রান্সে যথাক্রমে ১:১৮ এবং ১:১৩, যুক্তরাজ্যে যথাক্রমে ১:২১ এবং ১:১৬। বাংলাদেশে স্কুল ও কলেজগুলোকে একসাথে করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ : শিক্ষকদের নতুন কারিকুলামের বিস্তরণ, মূল্যায়ন ও বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সম্ভব হলে বিদেশেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। একটি ভালো প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ শেষ হয় তবুও প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালের হার্ডকপি পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় সফটকপি।
শিক্ষকের মান মর্যাদা বাড়ানো : একটি দেশের শিক্ষকের মর্যাদা বাড়লে সে দেশের শিক্ষার গুণগত মান যেমন বাড়ে, আবার ঠিক একইভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়লেও তা শিক্ষকের মর্যাদাকে বাড়ায়। বিষয়টি বিবেচনা করত শিক্ষকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন।

উপরিউক্ত বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন সাপেক্ষে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নযোগ্য নতুবা বাস্তবায়ন করা দুরূহ ব্যাপার। জোর করে বাস্তবায়ন করতে গেলে জাতি মেধাশূন্য হবে। বিষয়টি আমলে নিয়ে নতুন কারিকুলাম স্থগিত করে সংস্কার বা বাতিলের সুপারিশ করছি।

লেখক : শিক্ষক

 


আরো সংবাদ



premium cement