২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জিয়াউর রহমান : সমরনায়ক থেকে গণতন্ত্রী

জিয়াউর রহমান : সমরনায়ক থেকে গণতন্ত্রী - ফাইল ছবি

জিয়াউর রহমানের মত ক্ষণজন্মা পুরুষ বিশ্বে খুব কমই জন্ম নিয়েছেন। তিনি এমন এক সেনানায়ক ছিলেন যার আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতির মহাক্রান্তিকালে জাতিকে মুক্ত করতে গর্জে উঠেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। একজন সাহসী রাজনৈতিক নেতার মতোই নিজের জীবন, স্ত্রী-সন্তানের নিরপত্তার কথা না ভেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়; ২৬ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিশাহীন জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দিয়েছিলেন। নিজে যুদ্ধ করেছেন, সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশেষে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।

পরে এই সেনানায়ক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাজনীতির মাঠেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ শাসন করেছেন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়কের মতোই। একটি অস্থিতিশীল, অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত দরিদ্রতম রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিবের আমলে তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাবপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জেড’ ফোর্সের এই অধিনায়ক রাজনীতিতে না এলেও পারতেন। কিন্তু সময় ও রাষ্ট্রের প্রয়োজন তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। আবার তিনি একজন সেনাশাসক হয়েও রাষ্ট্র চালাতে পারতেন। সেটিও তিনি করেননি। তিনি স্বাধীনতার মূল স্পিরিট ধারণ করে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিলুপ্তকৃত গণতন্ত্র পুনর্জীবন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেন। পরে তিনিও একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। তার রাজনৈতিক দল ‘বিএনপি’ সূচনাকালীন সময় থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আছে।

জিয়াউর রহমান ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে থাকবেন। কারণ, তিনি সমরনায়ক হয়েও রাজনৈতিক দল গঠন করে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বিশ^ দরবারে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল।

একটি কুচক্রীমহল বলে থাকে, জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তাদের মনে রাখা দরকার, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাজপথে দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত চাহিদার অন্তর্নিহিত এক ফসল। পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের ধারা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী রাজনৈতিক দল বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার বলিষ্ঠ দল। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সেই ঝাণ্ডা বহন করে স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্র অক্ষুণœ রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক শুরুর প্রেক্ষাপট জনগণকে কেন্দ্র করে। মূলত জিয়াউর রহমানকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন এদেশের সিপাহি-জনতা। যে কারণে জিয়াউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাকে ব্যক্তিতন্ত্রের মন্ত্রে আবদ্ধ করলে জনগণ কিছুতেই তা বরদাশত করবে না। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ তথা জনগণ তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে যথার্থভাবে, যা ছিল স্বাধীনতার চেতনার মূল চাওয়া। তাই রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য গণতন্ত্রায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই এক নতুন রাজনৈতিক দলবিধি (Political Parties Regulations 1976) প্রণয়ন করেন এবং ‘রাজনৈতিক দলবিধি’ জারি করে ২৩টি রাজনৈতিক দলকে অনুমোদন করে গণতান্ত্রিকতার পথে প্রবেশ করেন। বিদেশী সাহায্য ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত জাতীয় স্বার্থভিত্তিক এবং প্রতিটি অঙ্গ-সংগঠনসহ রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি দেন। গণতান্ত্রিক পরিসরকে বৃহত্তর করার জন্য ১৯৭৪ সালের আদম শুমারির ওপর ভিত্তি করে জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের জন্য পুরো দেশকে বিভক্ত করা হয়। শুধু রাজনৈতিক দল গঠন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জনসাধারণের সুখ ও সমৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় সংহতি সুদৃঢ়করণ ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচিকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যা ছিল সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মূলমন্ত্র।

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় দেশে গণতন্ত্র ছিল না, জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ ছিল না, সংবিধানও স্থগিত ছিল, আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু ছিল না, সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছিল বহুধাবিভক্ত এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল না, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিল হতাশা এবং আদর্শের দ্বন্দ্ব। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমান দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন। রাজনীতি করে দেন উন্মুক্ত, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন খুব দ্রুত সময়ে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত না করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন।

একটি আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯ দফার মাধ্যমে দেশের কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নই শুধু নয়; জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করার প্রথম প্রচেষ্টাও তিনিই নিয়েছিলেন। কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যান জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। তখন ভারত ছিল বৈরীভাবাপন্ন। চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রগুলো তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্নমুখী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়নি। জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক সফলতার মাধ্যমে ভারতের খবরদারি থেকে যেমন রাষ্ট্রকে বের করে আনতে সফল হয়েছিলেন তেমনি পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চীনের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি এনেছিলেন। তার কূটনৈতিক কৌশলের সুফল হিসেবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হয়, জোট নিরপেক্ষ গ্রুপের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন, চীনের সাথে সৎপ্রতিবেশীমূলক সম্পর্ক স্থাপন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করা ছিল তার অন্যতম অর্জন।

জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে চীনের সাথে সম্পর্ক এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে। তিনি নিজে ১৯৭৭ সালের জুন মাসে চীন সফর করে চীনকে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন করেন। তার উদ্যোগে ১৯৭৭-৭৮ সালে বার্মার সাথে বাংলাদেশের বৈরী সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি নে উইন বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশ ও বার্মা সীমান্ত চুক্তি এবং ঢাকা-রেঙ্গুন সহযোগিতা চুক্তি করেন। ১৯৭৯-৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়ার জাপান, উত্তর কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফর এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্নমুখী বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক চুক্তি দূরপ্রাচ্যের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তোলে। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে ‘সার্ক’ গঠনের (রিজিওনাল কো-অপারেশন ইন সাউথ এশিয়া) প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই এই অঞ্চলের সাতটি রাষ্ট্র নিয়ে ‘সার্ক’ গঠিত হয়।

এককথায় বলা যায়, বৈদেশিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে তিনি অত্যন্ত সফল ছিলেন। অন্য দিকে যে সব কার্যক্রম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে, জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দান করে, নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে সামাজিক প্রয়োজন প্রতিফলিত হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় সেই সব বিষয়ে তিনি ব্যাপক কার্যক্রম চালু করে সফল হন।

জিয়াউর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতি যখন উন্নয়নের পথে হাঁটছিল, মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগের উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়েছিল ঠিক তখনই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কিছু সেনাসদস্যের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শহীদ হন। দেশ হারায় একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক, একজন মহান নেতা এবং আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে।

লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ


আরো সংবাদ



premium cement
‘রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো দল বা গোষ্ঠির নয়’ রোহিঙ্গারা এনআইডি নেয়ার অপচেষ্টা চালালে ইসিকে জানানোর আহ্বান আলিফের পরিবারকে এক কোটি টাকা দেবে শামসুল হক ফাউন্ডেশন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যারাই যাবে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে : জামায়াত আমির এক সপ্তাহ পর বেনাপোল থেকে দূরপাল্লার পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত সমন্বয়কদের ওপর হামলা হালকাভাবে দেখছে না সরকার কমছে ৪৭তম বিসিএসের আবেদন ফি গাজীপুরে কোরআন অবমাননার অভিযোগে কলেজছাত্র গ্রেফতার অযাচিত অস্থিরতা নয়, দায়িত্বশীল হোন সুখী : দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধন বেসরকারি স্কুল-কলেজে সাত পদে এনটিএসসির অধীনে নিয়োগ

সকল