অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করণীয়
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৩৮
অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দায়িত্ব দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন। পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য সচল করা। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। আমদানি-রফতানিতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। নতুন বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত গণ-আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে নতুন প্রজন্ম যে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে তাকে সবাই বলছেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এ দ্বিতীয় স্বাধীনতার সুফল অর্জনে সরকারকে কাজ করতে হবে। যদিও সরকারের মেয়াদ কতদিন তা এখনো পরিষ্কার নয়, তবুও যেহেতু এটি অন্তর্বর্তীকালীন তাই তারা আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজগুলো সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বচ্ছতার সাথে করবেন এটাই প্রত্যাশিত।
অর্থনীতিতে অনেক ক্ষত তৈরি হয়েছে। কার্পেটের নিচে অনেক ময়লা। উল্টালেই দুর্গন্ধ বের হবে। সব ময়লা দূর করতে হলে আগে আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা দরকার।
অর্থপাচার রোধ করতে হবে। কালোবাজারি ও খেলাপি গ্রাহকদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। দেশপ্রেমিক ও অভিজ্ঞ চৌকস অফিসারদের উপযুক্ত পদে বসাতে হবে।
ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা, ব্যাংকিং কমিশন গঠন, আমদানি-রফতানির পরিবেশ স্বাভাবিক করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিকে নজর দেয়া, রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা আনা, বাজারে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রাথমিক কাজ।
এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন সেক্টরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। পরিশেষে একটি অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এসব কাজ করতে প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট সময়। প্রয়োজন জনগণের সহযোগিতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিক সহযোগিতা। অর্থনীতির যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা এত সহজে কাটবে না এর জন্য তাৎক্ষণিক, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এ জন্যই দেশের পেশাজীবী। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও অভিজ্ঞ সচিবদের সাথে মতবিনিময় করা যেতে পারে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা রয়েছে। মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জগুলো হলো :
আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার : আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি হলো বৈষম্যের অবসান। এ বৈষম্য দূর করতে হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথমে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রত্যেক থানায় ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে থানার ওসিসহ কমিটি গঠন করতে পারেন। এলাকার চাঁদাবাজ, চোর, মাস্তানরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। দেশপ্রেম, জবাবদিহিতা ও রিওয়ার্ড অপরাধ দমনের উৎসাহ হিসেবে কাজ করতে পারে। সরকারের একটি বড় কাজ হচ্ছে ১৫ বছরের যারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, হত্যা, খুন-গুম ও এসবের নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনা।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার : অর্থনীতির অবস্থা টালমাটাল। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাতে দুর্নীতি হয়েছে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা এতদিন আড়ালে ছিল। এগুলো এখন পর্যায়ক্রমে বের হচ্ছে, সরকারের উচিত অর্থনীতির ক্ষতগুলো চিহ্নিত করে কোন কোন সেক্টরে বেশি ক্ষতি হয়েছে তা জরুরিভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা করা।
ব্যাংকিং খাতে সংস্কার : ব্যাংকিং খাত হলো অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বিগত সরকার এই মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট বিরাজ করছে। আছে মানুষের আস্থার সঙ্কট। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যাংকিং খাতে অনতিবিলম্বে সুশাসন ফিরিয়ে আনা। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। দুর্বৃত্তদের ব্যাংকের বিভিন্ন পদ থেকে বিদায় করা। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য স্বাভাবিক করা। বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা। গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতি নজর দেয়া উচিত। তৈরী পোশাক ও এ খাতে সাপ্লাই চেন ঠিক করা। পত্রিকা থেকে জানা গেছে, সাড়ে ১৫ বছরের সরকারের ঋণ সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। পাচার হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পাচার হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। সমস্যাগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করা উচিত। আশা করা যায়, রিজার্ভ এখন থেকে বাড়বে, তবে বিগত দিনগুলোতে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তা যাতে না হয় সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতির আর একটি সমস্যা হলো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে রাজস্ব আদায় না হওয়া। কোনো বছরই রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয় না। কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে সরকারি ও বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়। অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বিগত সরকারের বাজার সিন্ডিকেট, সড়কে চাঁদাবাজি, অবৈধ দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীর অধিক বিস্তার ছিল। বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সড়কে চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবস্থায় গতিশীলতা এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। কঠোর হস্তে দমন করতে হবে চাঁদাবাজদের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর ২০২৩-২৪ শেষ করেছে সরকার। বিদেশী ঋণের কিস্তির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও নেতিবাচক ধারায় রয়েছে অনেক দিন ধরে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সঙ্কুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী কন্ট্রাক্টরদের অর্থ এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে বিদেশী এয়ারলাইনগুলোর পাওনাও বকেয়া আছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিলও অনেকটা বকেয়া পড়েছে। এগুলো তো শোধ করতে হবে। আর শোধ করতে গেলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে।
বছর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৩ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বাংলাদেশকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আমদানি-রফতানি ও রেমিট্যান্স আহরণে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল তা পুনরুদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাবে অনেক গরমিল। এতে অর্থনীতির অনেক হিসাবই পাল্টে যাবে। প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও পরিবর্তন আসবে। আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে হলে বৈদেশিক বাণিজ্যের সমস্যা দূর করতে হবে। অর্থপাচার রোধ করতে হবে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে হবে।
এত দিন দেশ চলে আসছিল স্বৈরতান্ত্রিক ধারায়। গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার কাজটি কঠিন। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে নতুন সরকার সফল হবে।
মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন ও ভোটাধিকার হরণের কারণে ক্ষুব্ধ ছাত্র ও জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে হাসিনা সরকারকে বিদায় দিয়েছে। ফলে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাই হবে এই সরকারের মূল লক্ষ্য। বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা