২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিচারপতির সেদিন ও এদিন

বিচারপতির সেদিন ও এদিন - ফাইল ছবি

২০০৩ সাল। আমি তখন ডিএমপির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক-নর্থ। পুরো ঢাকায় তখন মাত্র দু’জন ডিসি ট্রাফিক ছিলেন- নর্থ আর সাউথ। ফার্মগেট পড়েছিল উত্তর ডিভিশনে। আমার অভ্যাস ছিল সকাল ৭টায় রমনা পুলিশ কমপ্লেক্সের সরকারি বাসা থেকে বেরিয়ে পুরো উত্তর ঢাকার প্রধান প্রধান রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের ডিউটি তদারকি করে মোহাম্মদপুরে নিজের অফিসে ঢোকা এবং দাফতরিক কাজ শুরু করা।

সেদিন অত্যন্ত ব্যস্ত ট্রাফিক ক্রসিং ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ ধরে সবে অফিসে এসে বসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেট থেকে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ওবায়েদ ফোন করে জানান, একজন বিচারপতি তাকে এবং সেখানকার তিন পুলিশ সার্জেন্টকে হাইকোর্টের ফ্ল্যাগওয়ালা গাড়ির কাছে ডেকে উচ্চস্বরে বকাঝকা করছেন, বলছেন- তিনি নিজ ক্ষমতাবলে রাস্তাতেই কোর্ট বসাচ্ছেন এবং তাদের সাজা দেবেন। কি অপরাধ? সার্জেন্টদের কেউ তার গাড়ি লক্ষ করে স্যালুট করেনি। ওবায়েদ সাহেব আমাকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। আমি রওনা হলাম।

অফিস শুরুর সময়, রাস্তায় বেশ জ্যাম। ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখি মাননীয় বিচারপতি চলে গেছেন। ঘটনা শুনলাম সবিস্তারে।

বিচারপতি মানিক (যাবার সময় তার ড্রাইভার পরিচয় বলে যায়) ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে ফার্মগেট হয়ে হাইকোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। তিন সার্জেন্ট গলদঘর্ম হয়ে ট্রাফিকের পিক আওয়ারে দাঁড়িয়ে সিগন্যাল দিচ্ছিলেন সেখানে। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে কালো রঙের ছোট্ট ফ্ল্যাগ লাগানো গাড়িটি তারা কেউ লক্ষ করেনি, স্যালুটও করেনি। বিচারপতি তার গাড়িটি হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে নিয়ে থামালেন। ড্রাইভারকে দিয়ে কর্মরত সার্জেন্টকে ডাকলেন। সার্জেন্ট গাড়ির কাছে আসার পর রাগতস্বরে জানতে চাইলেন, তাকে স্যালুট করা হয়নি কেন। সার্জেন্ট হতভম্ব, ব্যস্ত রাস্তায় এমন প্রশ্ন কেউ কখনো করেনি। তবু মাফ চাইলেন। বিচারপতি আরো ক্ষেপে গেলেন। তিনি এখানে যারা ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের কাজ করছেন সবাইকে তার গাড়ির কাছে ডেকে আনতে বললেন। যথারীতি ইন্সপেক্টর ওবায়েদের নেতৃত্বে তিন সার্জেন্ট এসে হাজির হলেন। ওদিকে পুরো ক্রসিংয়ে অস্বাভাবিক ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হলো। তিনি তোয়াক্কা করলেন না। পুলিশ কেন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জানে না, কেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুলিশ একাডেমির ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় না, কেন পুলিশ চোখ-কান খোলা রাখেনি, এসব নিয়ে অস্বাভাবিক রেগে গিয়ে বকাঝকা করলেন তিনি। বারবার ক্ষমা চাওয়াতেও তিনি ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বললেন, হলিক্রসের সামনের রাস্তাতেই তিনি কোর্ট হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন এবং এখানেই তিনি অফিসারদের শাস্তি দেবেন।

তারপর তিনি অফিসারদের নামধাম লিখে নেন, ডিসি ট্রাফিক হিসেবে এই অধমের নামও নিয়ে যান। সেদিন বিকেলেই ফার্মগেট পুলিশ বক্সে সমন এলো, তিন সার্জেন্ট ও ইন্সপেক্টর যেন পরদিন হাইকোর্টে বিচারপতি মানিকের এজলাসে হাজির হন। সকালে যথারীতি অফিসাররা হাইকোর্টে হাজির হন। তাদের দেখে হাইকোর্টে সাংবাদিক এবং অ্যাডভোকেটদের ভিড় লেগে যায়। সবাই উৎসুক, ঘটনা জানার জন্য। অ্যাডভোকেট মামুন নামের একজন বিনা পারিশ্রমিকে পুলিশের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি এজলাসে পুলিশের পক্ষে লড়েন। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি মানিক তিন সার্জেন্টের প্রত্যেককে ২০০ টাকা করে জরিমানা করেন অনাদায়ে তিন মাসের জেল দেন। ইন্সপেক্টর ওবায়েদকে বন্ড দিতে বলা হয়, এমন অপরাধ আর তিনি করবেন না মর্মে। তারা জরিমানা ও বন্ড দিয়ে মুক্তি পান।

আমি তার পরদিন সমন পাই হাইকোর্টে সশরীরে হাজির হওয়ার। আমিও হাজির হই। আমাকেও ঘিরে ধরেন কোর্টের উৎসুক মানুষজন। নানান প্রশ্ন। রীতিমতো ভড়কে গেলাম। ভিড় ঠেলে কেউ একজন আমাকে নিয়ে যায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা)। তিনি সব শুনে বিচারপতির এই কর্মের জন্য বিরক্তি প্রকাশ করেন। আমাকে বলেন, আপনি ভয় পাবেন না। এজলাসে হাজির হয়ে শুধু বলবেন, এই ঘটনার জন্য আমি ক্ষমা চাই। বললেন, কোর্টে এর বাইরে কিছু বললে ঝামেলা বাড়তেই থাকবে। কক্ষে উপস্থিত একজন অ্যাডভোকেট সাহেবকে বললেন, আমাকে এজলাসে নিয়ে গিয়ে যথাযথ সহায়তা দিতে।

সেই আমার প্রথম কোনো বিচারকের সামনে হাজির হওয়া। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে শিখিয়ে দিলেন, কিভাবে কোর্টে ক্যাপ খুলে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এবং বিচারপতির কথার পর কিভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয়। তাই করেছি সেদিন। বিচারপতি মানিক আমাকে সতর্ক করে দিলেন, আমার অধীনস্থ পুলিশ সদস্যরা যেন ভবিষ্যতে কোনো বিচারপতিকে স্যালুট করতে ভুলে না যায়। আমি মুক্তি পেলাম। সেদিনই তিনি কোর্টে নির্দেশ দিলেন, আইজিপির কাছে যেন ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়, অধীনস্থদের যেন আইজিপি বলে দেন বিচারপতিকে যেন অবশ্যই স্যালুট করা হয় এবং পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে যেন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স এবং বিচারকদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের বিষয় পড়ানো হয়।

তখন আইজিপি ছিলেন শহুদুল হক (টকশো কাঁপানো দলকানা আইজিপি শহীদুল হক নন)। শহুদুল হক সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর হিসেবে ১৯৭৭ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও দৃঢ়চেতা অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেহেতু তাকে জিয়াউর রহমান পুলিশে এনেছিলেন তাই আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে তাকে আবার পুলিশে ফিরিয়ে এনে চুক্তিভিত্তিক আইজিপি পদে অধিষ্ঠিত করে। জনাব হক হাইকোর্টের ব্যাখ্যা তলব দেখে বিস্মিত হন। তিনি তার উত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নেন।

ভুক্তভোগী হিসেবে আমাকেসহ আরো দু’জন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারকে আইজিপি মহোদয় ডাকেন তার দফতরে। অন্য দু’জন ছিলেন অ্যাডিশনাল আইজিপি শাহ জামান রাজ ও অবসরপ্রাপ্ত আমন্ত্রিত অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রয়াত কুতুবুর রহমান। আমি ইতোপূর্বে আমাকে দেয়া অ্যাটর্নি জেনারেলের পরামর্শ মনে করে ঘটনার জন্য সবার সাথে সুর মিলিয়ে আদালতের কাছে ক্ষমা চাওয়াই ভালো হবে মর্মে মতামত দিলাম। কুতুবুর রহমান সাহেব বললেন ভিন্ন কথা। তার মতে, রাস্তায় কর্তব্যরত অবস্থায় স্যালুট দেয়ার কোনো বিধান নেই। যার বিধান নেই তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জনাব রাজও একই মত রাখলেন। পরে জনাব হক আরো কয়েকজন ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করেন বলে শুনেছি। এর ক’দিন পর আইজিপি শহুদুল হক ক্ষমা না চেয়েই নানান যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন হাইকোর্টে।

অত্যন্ত ক্ষুণ্ন হলেন কোর্টের বিচারপতি। ব্যাখ্যা অগ্রহণযোগ্য ধরে নিয়ে আইজিপিকে ছয় মাসের বিনাশ্রম জেল দেয়ার রায় দিলেন। ছয় মাসের জেল মানেই সরকারি দফতরের পদ হারানো। রায়ের দিন জনাব হক বিদেশে সফরে ছিলেন। এরপর যখন ফিরলেন এয়ারপোর্টে আইজিপির ফ্ল্যাগবিহীন গাড়ি গেল তাকে আনতে। শুধু আইজিপির স্টাফ অফিসার ছিলেন তাকে রিসিভ করতে। তিনি নেমে বললেন, Everyone seems to be very hostile. I should not be there anymore. তিনি সোজা অফিসে গিয়ে তার দরকারি ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে আইজিপি পদে ইস্তফা দিয়ে চলে গেলেন। ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের কেউ তার পক্ষে দাঁড়ায়নি। আদালতের আদেশ, সরকারের কিছু করার নেই, সাফ জানিয়ে দেয়া হলো। অনেকটা অপমানিত হয়েই তিনি পদ ছাড়লেন। তারপর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে শাস্তি মওকুফের আবেদন জানান এবং রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করেন।

দলকানা বিচারপতি মানিকের বিতর্কিত কথাবার্তা আর আপত্তিকর আচরণ সম্পর্কে দেশবাসী অবহিত। টেলিভিশনে তার অভিনব বাতচিত আর সেই এজলাসে দেখা চেহারাসুরত মনে করে আমি হা হয়ে থাকতাম। একেই কি বলে বিচারপতি? ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আমি ৮-৯ বছরের শিশু। তবু তার বেশ কিছু স্মৃতি মনের আঙিনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের গ্রামের বাড়ির উঠানে প্রতি সন্ধ্যায় চাটাই বিছিয়ে অনেক গ্রামবাসী গোল হয়ে বসে যেত রেডিও শুনতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ আর উদ্দীপক গান ছিল সবার প্রিয়। একটা গান ছিল, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা/আজ জেগেছে এই জনতা।’ সেই বিচারপতি বলতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথা চরম ঘৃণিত ইয়াহিয়া খানকেই আমরা কল্পনা করতাম।

বিচারপতি মানিকের আজকের এই করুণ পরিণতি দেখে ইউটিউবে সেই পুরনো গানটি আবার বার কয়েক শুনলাম। মনের মধ্যে সেই পুরোনো উদ্দীপনা, সেই পুরনো আস্বাদ টের পেলাম।
স্যালুট জানাই দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদের।

লেখক : সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা


আরো সংবাদ



premium cement