২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গণহত্যা ও হাসিনার পতন বড় শিক্ষা

গণহত্যা ও হাসিনার পতন বড় শিক্ষা - ছবি : সংগৃহীত

কোটা সংস্কার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি ছিল। আগে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা ছিল ৫৬ শতাংশ। আর মেধার ভিত্তিতে চাকরি হতো ৪৪ শতাংশ। এই অনুপাত কোনোভাবেই ইনসাফভিত্তিক ছিল না। নজিরবিহীন প্রাণহানি ও রক্তপাতের পর শিক্ষার্থীদের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের মুখে কোটাব্যবস্থার সংস্কারপূর্বক প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল পতিত স্বৈরাচার হাসিনার সরকার। তবুও শেষপর্যন্ত নিজেদের পতন ঠেকাতে পারেনি।

দলীয়করণের মাধ্যমে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বাগে রাখতে হলে বৈষম্যমূলক কোটা সিস্টেমের বিকল্প হয় না। কারণ কোটার সুযোগেই দলীয় লোকজন ও সমর্থকদের বৈধ উপায়ে চাকরি দেয়া যেত। অর্থনৈতিক সঙ্কটকালে তাদের খুশি রাখতেই আগের কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল সাবেক স্বৈরশাসক হাসিনার জন্য জরুরি ছিল। এ বিষয়টি প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের ২৩ জুলাইয়ের এক বিশ্লেষণেও উঠে আসে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘কোটাব্যবস্থা বাংলাদেশের ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়জুড়েই ছিল। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কোটা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিরা পায়, যাদেরকে শেখ হাসিনা প্রায়ই নিজের সমর্থকগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরেন। ২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা কোটাব্যবস্থা বাতিল করে পূর্ণ মেধাভিত্তিক করেন। কিন্তু হাসিনার দীর্ঘকালীন অনুগত আদালত পুরনো কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করে। ব্যাপকভাবে দেখা যায়, শেখ হাসিনা তার সমর্থকগোষ্ঠীকে পুরস্কৃত করতে কোটাব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন চাচ্ছেন। কারণ, চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে তার সমর্থকগোষ্ঠীকে তিনি এর বেশি কিছু দিতে পারছেন না।’

যাই হোক, শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন কোটা ইস্যুকে আদালতের মাধ্যমে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে। ঠিক যেভাবে আদালতকে ব্যবহার করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বিরোধী দলকে বছরের পর বছর নাচিয়েছিলেন। আর এ সুযোগে একদলীয় নির্বাচন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিরোধীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে হাইকোর্ট। এখানে আমার করার কিছু নেই। হাইকোর্ট যেভাবে রায় দিয়েছে, সরকার সেটাই বাস্তবায়ন করেছে।’ কোটা আন্দোলন নিয়েও শেখ হাসিনা একই সুরে বলেছিলেন, ‘কোটার বিষয়টি আদালতের কাছে চলে গেছে। কোর্টের বিষয়টি কোর্টেই সমাধান করতে হবে।’ এ দিকে আন্দোলন করে আদালতের রায় পরিবর্তন করা যায় না বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্টের সদ্যসাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। নৈতিকভাবে তার কথা ঠিক : আদালতের বিচার প্রক্রিয়া ও রায় কোনোভাবেই আন্দোলন বা এক্সটার্নাল কিছু দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়।

কিন্তু তার কথা তো ভূতের মুখে রাম নাম হয়ে গেল! কারণ, ২০১৩ সালে হাসিনার বানানো কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলে সেই রায় প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগে ভারত-প্রযোজিত গণজাগরণ মঞ্চ বসিয়ে তার ফাঁসির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি নেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে রাতারাতি আইন সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দেয়া হয়। কাদের মোল্লা আসলেই একাত্তরের কথিত সেই ‘কসাই কাদের’ কি না সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু এমনকি শতভাগ প্রমাণিত অপরাধীর ক্ষেত্রেও রায় হয়ে যাওয়ার পর আবার আইন সংশোধন করে কারো দাবি অনুযায়ী ফাঁসির রায় দেয়াটাই তো স্পষ্ট পরিকল্পিত জুডিশিয়াল কিলিং। এটি বিশ্বে নজিরবিহীন। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ যে ‘ভারত-প্রযোজিত’ তার প্রমাণ ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি টাইমস অব ইন্ডিয়ার লিড নিউজ, ‘ভারতের মদদে শাহবাগ আন্দোলন’।

যাই হোক, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কার, বাতিল নয়। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার না করে বাতিল করাটা ছিল ধূর্ত হাসিনার রাজনৈতিক চাল। কারণ সংবিধানে কোটার কথা উল্লেখ আছে বিধায় কোটাব্যবস্থা বাতিল করাটা সংবিধানবিরোধী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য পরে আদালতকে ব্যবহার করে সেটিকে পুনর্বহাল করার সুযোগ তখন রেখে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ঠিক সেটিই তারা করেছে।

আদালতের ওই রায় থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। সারা দেশে তারা অবরোধ কর্মসূচি দেয়। পুলিশের গুলিতে অগণিত শিক্ষার্থীর লাশ পড়ল। এতেও ছাত্র-জনতা দমেনি। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষও তাদের সাথে অংশ নেয়। তাদের আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে হাসিনার সরকার একপর্যায়ে দাবি মেনে আলোচনায় বসার আহ্বান জানায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ইস্যুটি আর কোটায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। রূপ নেয় স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধে। মুখ্য হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার পতন বা পদত্যাগ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেও আন্দোলন বন্ধ করা যায়নি। গণহত্যায় মেতে ওঠেন ক্ষমতালোভী রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা। অবশেষে এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এক ভয়ঙ্কর লৌহ মানবীর দম্ভের পতন দেখল সমগ্র বিশ্ব।

নতুন প্রজন্মের যারা একাত্তরের গণহত্যা দেখেনি, তারা বলেছে এবার বায়ান্ন, ঊনসত্তর ও ২৫ মার্চের কালরাত দেখেছে। মাথা উঁচিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনো জীবিত আছেন, একাত্তর দেখেছিলেন, স্বৈরাচার আইয়ুব খানকে মোকাবেলা করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ বলেছেন, বায়ান্ন ও একাত্তরেও তারা এমন সীমাহীন নৃশংসতা ও নারকীয় নির্মমতা দেখেননি! স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে যারা রাজপথে লড়াই করেছিলেন, তাদের অনেকেও বলেছেন, স্বৈরাচার হিসেবে হাসিনার কাছে এরশাদ শিশুতুল্য।

মনে রাখা দরকার, হাসিনার সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে কথিত ‘ইসলামী জঙ্গিবাদ’ মিশিয়ে পশ্চিমাদের একটা ধাপ্পা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আর সেটি উঠে আসে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ২৫ জুলাইর এক বিশ্লেষণে। দেশে কিছু ঘটলেই জামায়াত-শিবিরকে দোষারোপ করার অপরাজনীতি আমরা হরহামেশা দেখতাম। ঠিক সেভাবেই সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত টাইম ম্যাগাজিনকে বলার চেষ্টা করেন যে, সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতির নেপথ্যে জামায়াত জড়িত। সেকুলারদের সাথে নিয়ে তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান (তালেবান) হওয়া থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, টাইম ম্যাগাজিন আরাফাতের এই মুখস্থ বয়ান খারিজ করে দিয়ে লিখেছিল, ‘যখন হাসিনার অর্থনৈতিক রেকর্ড বিপর্যয়ের মুখে ধুঁকছে এবং তার পরিবার প্রকাশ্যে উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে, তখন আওয়ামী লীগ তার অন্যতম পুঁজি ইসলামী চরমপন্থা দমনের গল্পের আশ্রয় নিচ্ছে। এতদসত্ত্বেও চলমান অস্থিরতার পেছনে ইসলামী চরমপন্থীদের সক্রিয়তার যে দাবি আরাফাত করেছেন, তার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।’ এ ক্ষেত্রে মাস্টারস্ট্রোক হিসেবে টাইম ম্যাগাজিন ড. আলী রিয়াজের এই বক্তব্য তুলে ধরে : ‘পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন আদায় করতে এমন একটি বয়ান দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে যে, হাসিনা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যাতে করে তার নৃশংস ক্র্যাকডাউন নিয়ে সমালোচনা বন্ধ করা যায়। আওয়ামী লীগ আগেও এটি ব্যবহার করেছে এবং এখন আবারো চেষ্টা করছে।’

অন্য দিকে, শেখ হাসিনা চেষ্টা করেছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ অভিহিত করে ইস্যুটিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের পুরনো খেলায় রূপ দিতে। তার সেই পুরনো বিভাজনের রাজনীতি সফল হয়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে ‘রাজাকার’ বা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ নামক যেই কমন শত্রুর ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছিল হাসিনার সরকার, তা পাকাপাকিভাবে দাফন হয়ে যায়।

সেই ন্যারেটিভ ব্যবহার করে যাবতীয় অপকর্ম, জুলুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সব জায়েজ করার চেষ্টা করা হতো। জামায়াতকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মধ্য দিয়ে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন সবাই চুপ ছিল। জালিম হাসিনার সরকার আরো এগিয়ে যেতে পেরেছিল। তারপর ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মাটিতে রাতের আঁধারে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের জিগির তুলে হেফাজতে ইসলাম তথা কওমি মাদরাসাভিত্তিক আলেমসমাজকে নৃশংসভাবে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ঢাকার মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখন চুপ থাকলেও এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের অনেকের সন্তান প্রাণ হারায় পুলিশের গুলিতে। সময়ে সময়ে প্রত্যেকের চুপ থাকার পাপ ও নিয়তি একে একে সবাইকে গ্রাস করেছিল। যেন সবাইকে জালিমশাহীর জুলুমের স্বাদ পাইয়ে তারপর তার পতন ঘটালেন খোদা তায়ালা। এটি আমাদের সবার জন্য এক বড় শিক্ষা।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement