বিচার বিভাগ সংস্কার প্রসঙ্গে
- আবু জুহায়ের
- ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৫০
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পর রাষ্ট্র সংস্কার খুব জরুরি বলে সবাই উপলব্ধি করছেন। এ প্রসঙ্গে বিচার বিভাগের সংস্কারের বিষয়টিও সামনে এসেছে। ইতোমধ্যে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, বিচার বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, বিচার বিভাগের আশু সংস্কার প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টাও স্পষ্ট করেছেন, আইন, বিচার ও প্রশাসন বিভাগের সংস্কার করে তবেই নির্বাচন হবে। সিভিল সোসাইটির সম্মানিত ব্যক্তিরাও বলছেন, পুলিশ ও নির্বাহী বিভাগের পাশাপাশি বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার প্রয়োজন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও নানা কারণে বিচার বিভাগের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে। অতি সম্প্রতি বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার প্রদানে নজিরবিহীনভাবে ব্যর্থতার সঙ্কটে নিপতিত হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এবং অত্যাচারিত নিপীড়িত মানুষের আস্থার আশ্রয়স্থল বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগের আশু সংস্কার অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি সাবেক বিচারকদের ফোরাম বিচার বিভাগ সংস্কারে ১২ দফা পেশ করেছেন। কর্মরত বিচারকদের তরুণ অংশ স্বাধীন ও জনবান্ধব বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি বরাবর ১১ দফা উত্থাপন করেছেন। আইন বিষয়ক গবেষকরাও লিখে যাচ্ছেন। বিচারক, আইনজীবী ও আইনজ্ঞ এমনকি সাধারণ মানুষও একটি স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগের স্বপ্ন নিয়ে মতামত তুলে ধরছেন। এমনই প্রেক্ষাপটে একজন নাগরিক হিসেবে বিচার বিভাগ সংস্কারের একটি রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই।
বিচার বিভাগ সংস্কারে কিছু ক্ষেত্রে এই বিভাগের মূল ভিত্তিতেই মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার। এ জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করা আবশ্যক। এ লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে, যাতে বিচার বিভাগের তিনটি অংশে (অধস্তন আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ) কর্মরত কমপক্ষে তিনজন বিচারক এবং উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত এক বা একাধিক বিচারপতিসহ এবং অন্য নাগরিক সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত হতে পাারেন। তারা বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরবেন, যা দেশের মানুষের মতামত দেয়ার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এরপর উন্মুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদে চূড়ান্ত অনুমোদন এবং ছয় মাস মেয়াদে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা যেতে পারে। আমরা সংস্কার কার্যক্রমকে কয়েকটি মৌলিক ভাগে বিভক্ত করে উপস্থাপন করতে চাই।
১. সাংবিধানিক সংস্কার : বিচার বিভাগ মৌলিক সংস্কারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও পৃথকীকরণের জন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬ সংশোধনপূর্বক বিচার বিভাগ পরিচালনার জন্য যাবতীয় ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে অর্পণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিধিবিধান প্রণয়নপূর্বক রেজিস্ট্রার কার্যালয়কে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় ঘোষণা করতে হবে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগ বিলুপ্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরো বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে। আয় বিনির্মাণের লক্ষ্যে কোর্ট ফি’সহ আদালতে প্রাপ্ত অন্যান্য অর্থ জমা থাকবে। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইনজীবী প্রার্থীদের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক (কমপক্ষে ৩০টি দেওয়ানি/ফৌজদারি/সাংবিধানিক) মামলার নিষ্পত্তিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অধঃস্তন আদালতের প্রার্থী বিচারকদের ক্ষেত্রে বিচারিক কর্মকালের সর্বশেষ কমপক্ষে পাঁচ বছর বিচারকাজে নিয়োজিত থাকার শর্ত সংরক্ষণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিচার বিভাগের তিনটি অংশে (অধঃস্তন আদালত, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ) কর্মরত বিচারকদের অপসারণের জন্য কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সমন্বয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তৈরির বিধান সংযুক্ত করতে হবে। বিচার সহজলভ্য করার জন্য বিভাগীয় সদরে উচ্চ আদালতের আসন স্থাপন করে অনুচ্ছেদ ১০০ এর বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি বছর উচ্চ আদালতের বিচারকদের সম্পদ বিবরণী প্রধান বিচারপতি বরাবর জমা দেয়ার বিধান করতে হবে।
২. উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়ন : স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য মাসদার হোসেন মামলায় ইতোপূর্বে ১২ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়াও আপিল বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত গ্রেফতার, রিমান্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, তদন্ত, প্রসিকিউশন, হাজতিদের মর্যাদা সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট আইনসহ উচ্চ আদালতের রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। মোবাইল কোর্ট সম্পর্কিত পেন্ডিং আপিল মামলা নিষ্পত্তিপূর্বক নির্বাহী বিভাগের বিচারিক ক্ষমতা লাভের আকাক্সক্ষা দূর করতে হবে। তা ছাড়া মর্যাদা সম্পর্কিত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিক্রমে বিচার বিভাগের সাথে অন্যান্য বিভাগের ক্ষমতার মর্যাদাপূর্ণ ভারসাম্য আনয়ন করতে হবে।
২(১) : তদন্ত নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত করার জন্য স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২(২) : সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার জন্য স্বাধীন প্রসিকিউশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩. বিচারাধিকার : বিচার বিভাগের প্রতিটি স্তরে মামলা বা আরজি দাখিলের আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা, মীমাংসা বা সালিসি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য সরকারি আইনগত সহায়তার ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহার চালু করতে হবে।
৪. অবকাঠামো : সর্বস্তরের আদালতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাসংবলিত এজলাস, সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিস্তৃত কক্ষসহ আদালত ভবন প্রস্তুত করতে হবে। বিচারপ্রার্থীদের অসুবিধা লাঘবের জন্য পর্যাপ্ত বৈঠকখানা, নারী ও শিশুদের নিরাপদ কক্ষ, সাক্ষীদের বিশ্রামাগার স্থাপন করতে হবে। অধস্তন আদালতের কাঠামোর মধ্যে জেলাপর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি পৃথক অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তদারকির জন্য বিভাগীয় জজ নিয়োগসহ বিভাগীয় দফতর স্থাপন করতে হবে, যেখানে জেলা আদালতের বিশেষ আপিল বা রিভিশন শুনানির ব্যবস্থা থাকবে এবং জেলাপর্যায়ের বিচারকদের মধ্যে সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে স্থানীয়ভাবে বদলির ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্য সিনিয়র বিচারকদের বদলির ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে সংযুক্ত থাকবে। নবসৃজিত আদালতগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করতে হবে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যাবতীয় নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে।
৫. বিচারক/কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানোন্নয়ন : যেকোনো সংস্কার কার্যক্রম সফল করার জন্য বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মানোন্নয়ন অপরিহার্য। বিচারকদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধনের জন্য পর্যাপ্ত বেতনভাতা, দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ, দেশ-বিদেশে চিকিৎসা, পরিবহন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি বিচার বিভাগে ন্যস্ত করা এবং প্রয়োজনীয় সুবিধাদি প্রবর্তন করতে হবে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সার্বক্ষণিক পরিবহন সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য পৃথক পরিবহন পুল ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি বছর তাদের সম্পদ বিবরণী সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে জমা দেয়ার বিধান প্রবর্তন করতে হবে।
৬. বিজ্ঞ আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য বার কাউন্সিলকে রাজনীতিমুক্ত করে এর তত্ত্বাবধানে সারা দেশের বার অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের মধ্যে বিচারপ্রার্থীদের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতি বছর তাদের সম্পদ বিবরণী বার কাউন্সিলে জমা দেয়ার বিধান করতে হবে।
সর্বোপরি একটি মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বিকভাবে ন্যায়বিচারে সক্ষম একটি বিচার বিভাগ গড়ে তোলাই হবে এই সংস্কার কার্যক্রমের লক্ষ্য।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা