পুলিশকেই নিজের ভাবমর্যাদা ফেরাতে হবে
- ড. ইমতিয়াজ আহমদ
- ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৩৩
৫ আগস্ট দেশ নতুন করে স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ওপর নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগণের বুকে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও পুলিশকে একাকার করে ফেলে বিক্ষুব্ধ মানুষ। আওয়ামী লীগের নামাঙ্কিত ও মালিকানাধীন স্থাপনা এবং পুলিশের স্থাপনায় একইভাবে আক্রমণ চালানো হয়। পুলিশ বক্স, ফাঁড়ি ও থানা লাইন এমনকি সদর দফতরেও হামলা হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, পুলিশের মৃত্যুতে মানুষ আনন্দ করেছে। ফেসবুকে হা হা হা রিঅ্যাক্ট দিয়েছে। কারণ এবারের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবার কাছে পুলিশের অবস্থান বা ভূমিকা ছিল শত্রুপক্ষের মতো। ফিলিস্তিনে কোনো ইহুদি সেনার মৃত্যুতে মানুষ যেভাবে আলহামদুলিল্লাহ বলে, ঠিক তেমনটিই ঘটেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত পুলিশের ক্ষেত্রেও। কিন্তু এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিরা নিপীড়ক ও ভিন্ন জাতির। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ তো ভিনদেশী বা ভিন্ন জাতির নয়। আন্দোলনকারীরা যেমন এ দেশের সন্তান, তেমনি পুলিশও এ দেশেরই সন্তান। তাহলে কেন এমন হলো? নাকি তারা, অনেককে যেমনটি বলতে শোনা যায়, এ দেশের নয়? ছদ্মবেশে পুলিশের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে কারা এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি করেছে? যদি বাস্তবে এমনটি হয়েই থাকে, তাহলে অবিলম্বে তদন্ত হওয়া উচিত।
হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এতটাই অসহায় হয়ে পড়ে যে, টানা তিন দিন পুলিশের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকে। থানাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। কাজে যোগ দিতে বলার পরও নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে অনেক পুলিশ সদস্যই কাজে যোগ দিতে পারেনি।
ছাত্ররা অত্যন্ত শান্তভাবে অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছিল। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ হামলা চালিয়ে সেই আন্দোলনকে রক্তাক্ত করে। প্রতিবাদে আন্দোলনকারী ছাত্ররা ১৬ জুলাই সারা দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাসিনার পালানোর পরও গোপালগঞ্জসহ বেশ কিছু স্থানে আওয়ামী লীগ যেভাবে রামদা উঁচিয়ে মিছিল করেছে, ছাত্রদের কারো হাতে তেমন অস্ত্র ছিল না। কারো কারো হাতে ছিল শুধু একটি লাঠি। সেই লাঠিওয়ালাদের একজন আবু সাঈদকে পুলিশ আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই সরাসরি বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আবু সাঈদ যেন ভাবতেই পারেননি এ দেশেরই সন্তান পুলিশ তাকে এভাবে গুলি করবে। একদম কাছ থেকে গুলি করে শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে যখন পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে টেনে ফেলা হলো, তখন মনে হচ্ছিল এ যেন ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিদের অভিযানের কোনো দৃশ্য। কী দোষ ছিল মীর মুগ্ধের? তিনি তো আন্দোলনে ছিলেন না। পুলিশ বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো স্লোগানও দেননি তিনি।
তবে স্লোগান না দিলেও তার অন্তিম বাক্যগুলো ইতিহাসের পাতায় বোমাস্বরূপ হয়ে থাকবে। মীর মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তাদের জন্য পানি-বিস্কুট নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যে সামনাসামনি পড়ে যাওয়া নিরস্ত্র মাওলানা খুবাইবকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। বলতে গেলে এ দাস্তান অনেক লম্বা হয়ে যাবে। শুধু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেই পুলিশ ভাবমর্যাদা হারিয়েছে তা নয়; বরং ২০১৩ সালে হেফাজত দমন, যুদ্ধাপরাধীদের ট্রাইব্যুনালের সময় জামায়াত-শিবির নির্মূলসহ বিগত ১৫ বছরে নানা আন্দোলনের সময় পুলিশের ভূমিকায় মানুষের মনে একের পর এক ক্ষোভ জমা হয়েছে।
এটিও সত্য যে, সব পুলিশ খারাপ নয়। কিছু উচ্চাভিলাষী পুলিশ ব্যক্তিস্বার্থে গোটা পুলিশ বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। শেখ হাসিনা সরকার পুলিশের মধ্যে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করেছে। অতি উৎসাহী পুলিশের একটি অংশ দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে পুলিশকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে পুরো বাহিনীকে বিতর্কিত করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন আন্দোলন ও প্রতিপক্ষ দমনে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ ও আইনবহির্ভূতভাবে গুলি করে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রেও অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে। মূলত তারাই পুলিশের ভাবমর্যাদা এমন তলানিতে নিয়ে গেছেন। ফলে বহু পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেয়ার সাহস পাননি। যারা যোগ দিয়েছেন তারাও ইউনিফর্ম পরে মাঠে নামতে ইতস্ততবোধ করেছেন।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ দমনে পুলিশ অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। নবনিযুক্ত আইজিপি মো: ময়নুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পরে বলেন, আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং এদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান পুলিশের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝখানে পুলিশের অবস্থান। পুলিশ জনগণের বন্ধু। জনগণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কাছে ছুটে যায়। পুলিশ থানায় ছিল না বলে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে, রাত জেগে পাড়া-মহল্লা পাহারা দিয়েছে। পুলিশ থানায় ফিরে আসায় জনগণ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। পুলিশের লোগো ও ইউনিফর্ম পরিবর্তন হবে। তবে এটিই যথেষ্ট নয়। মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, পুলিশ জনগণের বন্ধু। কোনো দলীয় সরকার যেন তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে পুলিশকে ব্যবহার করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশকে আইনের ভেতরে থেকে কাজ করতে হবে। হারানো ভাবমর্যাদা পুলিশকেই পুনরুদ্ধার করতে হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা