বিপ্লবের পর এখনই যা করণীয়
- খন্দকার হাসনাত করিম
- ২০ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৩১
বাংলাদেশের দুর্জ্ঞেয় মহা-তারুণ্য অর্জন করেছে দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লবের দেশ-পরিবর্তনকারী তথা যুগান্তকারী মহা-বিপ্লবের শিরোপা। বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটিয়েছে তারা! সালাম তোমায়, হে বাংলাদেশী তারুণ্য।
এই মহাবিপ্লব থেকে শেখার আছে গোটা জাতির, গোটা জগতের। কষ্ট লাগছে কোটা আন্দোলন তথা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সেই জানবাজ তরুণ কিশোরদের জন্য, যারা দেখে যেতে পারল না ছাত্র-জনতার এই ঐতিহাসিক বিজয়। গোটা জাতি আজ তাদের রূহের মাগফিরাত কামনায় শামিল। এখন মনে রাখা দরকার, পরিপূর্ণ বিজয় অসমাপ্ত। কারা মানবতার শত্রু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করল তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি নিতে হবে। স্বৈরাচারী ভেগেছে; কিন্তু স্বৈরাচারের বীজ রয়ে গেছে। বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের কুশীলবরা চক্রান্ত শুরু করেছে। বাংলাদেশের প্রমাণিত এবং পরীক্ষিত দুশমন ভারত ষড়যন্ত্রের জালবিস্তার থেকে নিবৃত্ত হয়নি। তারা স্বৈরাচারের সুরক্ষা দিয়েই চলেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আগস্ট মহা-জাগরণে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখতে হলে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের মূল উৎপাটন করে একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের এখনই সময়। সেজন্য বীর ছাত্র-নেতাদের মতো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে; গণদুশমন, লুটেরা ও উৎপীড়কদের আইনের সামনে দাঁড় করাতে হবে; তাদের পাচার করা ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে ফেরত এনে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণভার থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে হবে; ইসলামী মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের ওপর দেশকে আবার দাঁড় করাতে হবে; স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী লেজুড় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে; কোটা আন্দোলনের বীর শহীদদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; সমন্বয়কারী বীর ছাত্রনেতাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; সুরক্ষা দিতে হবে সংখ্যালঘুদের, ব্যাংক লুটেরা এবং বাণিজ্য-সিন্ডিকেটগুলো গুঁড়িয়ে দিতে হবে; বদলাতে হবে স্বৈরাচারী সংবিধান; সেক্টর ভাগ করে সংস্কারের জন্য এবং স্বৈরাচারের বিষবৃক্ষ উৎপাটনে গঠন করতে হবে টাস্কফোর্স এবং নজরদারির কাঠামোগত ব্যবস্থা; নতুন সংবিধান প্রণয়নকালে মনে রাখতে হবে, বিপ্লবের সাফল্যই আইনের ভিত্তি রচনা করে।
তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে পিলখানা হত্যাকাণ্ড; ২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যাসহ প্রতিটি আইনবহির্ভূত খুন, গুম, কারাদণ্ড এবং গোয়েন্দা বিভাগে দুর্বিষহ নির্যাতনের; অপরাধীদের সোপর্দ করতে হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। স্বৈরাচার কর্তৃক নিয়োজিত রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে; প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টাকেই রাষ্ট্রপতি করতে হবে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে একাধারে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব দিতে হবে। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০২৪-এর সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির বিচার করতে হবে। তদন্ত করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার লুট করা কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মতো অপরাধ; গণকবরগুলো শনাক্ত করে খুন করে লাশ গুম করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের। এগুলো করার জন্য প্রয়োজন ছাত্র-সেনা-জনতার অটুট ঐক্য ও সোচ্চার কণ্ঠ। সেদিকেই আজ জাতি তাকিয়ে আছে।
গোটা জাতি আজ তাকিয়ে আছে এই নতুন তারুণ্যের দিকে। স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর সরাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। নতুন তারুণ্য সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। এবারের তরুণ-কিশোর জাগরণ যে বার্তা দিয়ে গেছে তা হলো- দুঃশাসন রুখে দাঁড়ানোর বার্তা। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত, রাজনৈতিক ঐক্য। লাখ লাখ কোটাবিরোধী তরুণের মধ্যে বহু রাজনৈতিক নীতি আদর্শ ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে সেসব রাজনৈতিক আদর্শ সরিয়ে রেখে তারা দেশকে আপদমুক্ত ও রাষ্ট্রকাঠামো আমূল পরিবর্তনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। খেয়াল করেছি, ছাত্ররা তাদের লড়াইতে শুধু তাদের বিবেকবান শিক্ষকদেরই শামিল করেনি, তাদের পরিবার ও অভিভাবকদেরও সফলভাবে শামিল করেছে। শামিল করেছে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণকে।
সেই সাথে আমাদের সেনাবাহিনীও দেশপ্রেম এবং জনসংহতির প্রমাণ রাখল। তারা ব্যারাক ত্যাগ করে ছাত্র-জনতার ন্যায্য সংগ্রামের সাথে নৈতিক ও আদর্শিক একাত্মতা প্রদর্শন না করলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার গোপালী পুলিশ, পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ভারত থেকে আনা ভাড়াটিয়া বাহিনী আরো যে কত হাজার বঙ্গমাতার কোল খালি করে হলেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অপচেষ্টা করত, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
হাসিনা সীমালঙ্ঘন করেছিল। গণহত্যার জন্য হাসিনার বিরুদ্ধে দেশে ও যুগপৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শরণাপন্ন হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর সর্বসম্মত গণদাবি। ছাত্ররা বুকের রক্ত ঝরিয়ে দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করেছে, ঘরের খেয়ে রাস্তায় নেমে ময়লা সাফ করেছে, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাদের এই দেশপ্রেম আমরা কোনো দিন উপলব্ধি করিনি।
ভেবেছি তারা টিকটক, ফেসবুক, এক্স, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব জেনারেশন। আমরা বুঝতেও পারিনি তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং দ্রোহের কথা। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অফিসে বা কাজে না গিয়ে এই বয়সেও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। দেখেছি তাদের মনোবল, দেশপ্রেম এবং ভেদাভেদহীন সংগ্রামী তারুণ্য। গানের সুরে সুরে তারা সারা দেশে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের সংগ্রাম। এক দিকে পুলিশ, এক দিকে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ পেটোয়া বাহিনী আর এক দিকে স্লোগানে ফেটে পড়া শিক্ষার্থীরা। এই রণক্ষেত্রের মধ্যেও যখনই জোহর, আসর কিংবা মাগরিবের আজান শুনেছে তাদের অনেকে স্লোগান থামিয়ে আজান দিয়ে রাজপথে নামাজের কাতার বানিয়েছে। এ যে এক নতুন বাংলাদেশ! এরাই আজ ও আগামীর বাংলাদেশের সংগ্রামী প্রতিচ্ছবি। এরাই পারবে বিশ্বকে অবাক করে এক ঐক্যবদ্ধ নতুন বাংলাদেশ উপহার দিতে।
সেই নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের শত্রুপক্ষকে শনাক্ত করতে হবে। সেই শত্রুপক্ষের মধ্যে রয়েছে হাসিনাকে আশ্রয়দাতা ও মদদদাতা ভারত এবং তাদের ক্রীতদাস আওয়ামী লীগ, তাদের প্রত্যেকটি অঙ্গসংগঠন, বুদ্ধিজীবী, দলদাস সাংবাদিক ও গণমাধ্যম, সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী নামধারী আওয়ামী উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে আওয়ামী অফিসার ও ট্রেড ইউনিয়ন। রয়েছে ‘গোপালী’ নরপশু পুলিশ, কূটনীতিক, দলদাস শিক্ষক নামের কলঙ্কিত কুলাঙ্গার, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কূপমণ্ডূক লাঠিয়াল বাহিনী, ব্যাংকার নামধারী লুটেরা ও তাদের ভাগিদার ব্যবসায়ী নামধারী জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায় বল্লভরা। তাই এই গণবিপ্লব যেন কোনো প্রকারেই বেহাত না হয়ে যায়, সেজন্য তারুণ্যকে চোখ কান খাঁড়া রাখতে হবে। জনতার হাতেই এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তেছে। দেশটা কারো বাপের নয়। এ দেশ জনগণের। জনগণকেই বেছে নিতে হবে কাদের দ্বারা তারা শাসিত হতে চায়। তবে তার আগে দেশকে আওয়ামী স্বৈরাচারমুক্ত করতে হবে। উপড়ে ফেলতে হবে স্বৈরাচারের বীজ। গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে স্বৈরাচার যেন আর কখনোই এ দেশে মাথাচাড়া দিতে না পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা