২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাংলাদেশের সংবিধান : শুরু থেকেই বিতর্ক

বাংলাদেশের সংবিধান : শুরু থেকেই বিতর্ক - ফাইল ছবি

[প্রথম কিস্তি]

জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের পরিধি এবং তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কত দিনের মধ্যে সম্পাদন করতে পারবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের মতো রাজনৈতিক দলগুলোরও সক্রিয় চিন্তা আছে। ফ্যাসিবাদ-উত্তর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের কথাও ব্যাপকভাবে জনচাহিদার মধ্যে চলে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধনের প্রসঙ্গ এসে যায়।

বলাবাহুল্য, দেশের সংবিধান নিয়ে সূচনাতেই বিতর্কের শুরু এবং আজো তা অব্যাহত। তাই সংবিধান নিয়ে ধারাবাহিক কিছু ভাবনা ও ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরব।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন । স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন সরকার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতিকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে আসেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার কথা বলা হয়। রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক প্রধান হন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

সংবিধান প্রণয়নের পটভূমি
বাংলাদেশের সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ জারি করা গণপরিষদ আদেশ। সেটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর ধরা হয়। এ আদেশ অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনগুলোয় বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত সব প্রতিনিধিকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৩০ জন। তখন কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন যে, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন যুক্তিসঙ্গত নয়; কারণ তারা অবিভক্ত পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির কোনো ম্যান্ডেট তাদের ছিল না। যাই হোক, গণপরিষদ শুধু সংবিধান রচনার অধিকার পায়। অন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তাদের ছিল না। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এতে ৩৪ জন সদস্য (৩৩ আ’লীগ+১ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) ছিল। কমিটি ৭৪টি বৈঠকে বসে এবং ছয় মাসের মধ্যে কমিটি কাজ শেষ করে। কমিটি বিভিন্ন মহল থেকে ৯৮টি সুপারিশ পায়। কমিটির আহ্বানে তেমন সাড়া ছিল না। কারণ কোনো প্রশ্নমালা ছিল না। বিরোধী দলগুলোও উৎসাহী ছিল না। সংবিধানের বাংলা পাঠ প্রণয়নে কমিটিকে সাহায্য করেন সৈয়দ আলী আহসান, ড. মাজহারুল ইসলাম ও ড. আনিসুজ্জামান। একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ সংবিধান প্রণয়নে সাহায্য করেন। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান বিল গণপরিষদে পেশ করা হয়।

সংবিধান প্রণয়নে বিতর্ক
সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তি উপস্থাপন করে যে, গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের কোনো বৈধতা নেই। কারণ গণপরিষদ সদস্যদের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেট জনগণ দেয়নি; বরং তারা ইয়াহিয়া খানের দেয়া শর্তানুযায়ী ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’-এর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো বা তাদের নির্বাচনী বক্তৃতায় কোথাও স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো ধারণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগণকে দেয়া হয়নি। সুতরাং পাকিস্তানের জন্য নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির কোনো অধিকার রাখেন না। তারা দাবি করেন, সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটে তা অনুমোদিত হতে হবে। তাদের দাবি ছিল, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এ সময় মওলানা ভাসানী ছয়টি দলের সমন্বয়ে ‘সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করেন। সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর ভাসানী বলেন, ‘একটি বাজে গণপরিষদ কর্তৃক জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া সংবিধান বাতিল করে সরকারের ভেতরের ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন খসড়া সংবিধান তৈরির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও কৃষক-শ্রমিক সমাজবাদী দল অভিমত প্রকাশ করে, এ সংবিধানে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের অভিপ্রায় কাগুজে বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। এ সময় সোভিয়েতপন্থী ন্যাপ নেতারা, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) ও ছাত্র ইউনিয়ন মৃদু সমালোচনা করে আক্ষেপ প্রকাশ করে, এ গণপরিষদের কাছে পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক সংবিধান আশা করা যায় না। আওয়ামী লীগ দাবি করে, প্রণীত সংবিধান একটি উত্তম সংবিধান এবং গণপরিষদও বৈধ।

বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্য থেকে স্বল্পসংখ্যকই সাংবিধানিক বিতর্কে অংশ নেন। রাজনৈতিক দলের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোর অনুপস্থিতির ফলে সংবিধান সম্পর্কে তাদের কোনো অভিমত প্রকাশিত হয়নি। খসড়া সাংবিধানের ওপর জনমত গ্রহণ বা যাচাইয়ের তেমন কোনো সময় ও সুযোগ দেয়া হয়নি। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধানের ওপর পরামর্শ আহ্বান করেছিল। কিন্তু জনগণ তাতে তেমন সাড়া দেয়নি। কমিটি জনমত যাচাইয়ের জন্য কোনো প্রশ্নমালা জারি করেনি এবং সময়ও দিয়েছিল মাত্র তিন সপ্তাহ। আবার গণপরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদেরও সংবিধানের ওপর আলোচনার তেমন সুযোগ দেয়া হয়নি। মোট ৪০৪ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৫ জন আলোচনার জন্য নাম দিয়েছিলেন। এর মধ্যে মাত্র ৪৮ জনকে সুযোগ দেয়া হয়। এদের এক-তৃতীয়াংশই ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। আবার ৪৫ জনই আওয়ামী লীগের।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণের নেপথ্যে
১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ মূলনীতিগুলো সংবিধানের ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১১ অনুচ্ছেদে নিম্নলিখিতভাবে বর্ণিত হয়েছে :

জাতীয়তাবাদ : সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯-এ বলা হয়েছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সঙ্কল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।

সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি : সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১০-এ বলা হয়েছে, মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থেকে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার : সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১-তে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা : সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২-তে বলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য- ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা; খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান; গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার; ঘ. কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে।

এ ছাড়াও সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৩ থেকে অনুচ্ছেদ ২৫ পর্যন্ত আরো বেশ কিছু রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি উল্লেখ করা হয়ছে। এর মধ্যে রয়েছে মালিকানা-ব্যবস্থা, কৃষক ও শ্রমিকের শোষণ থেকে মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, সুযোগের সম অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম, নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা, জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও শ্রদ্ধা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৫-তে বলা হয়েছে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এসব নীতি হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এসব নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র- ক. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের চেষ্টা করবে; খ. প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে এবং গ. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে।

বাকি অংশ আগামীকাল
লেখক : গবেষক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব


আরো সংবাদ



premium cement
সংস্কারের কাজ দৃশ্যমান হলেই নির্বাচন হবে : মাহফুজ আলম সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার প্রাথমিক দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের : ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ‘রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো দল বা গোষ্ঠির নয়’ রোহিঙ্গারা এনআইডি নেয়ার অপচেষ্টা চালালে ইসিকে জানানোর আহ্বান আলিফের পরিবারকে এক কোটি টাকা দেবে শামসুল হক ফাউন্ডেশন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যারাই যাবে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে : জামায়াত আমির এক সপ্তাহ পর বেনাপোল থেকে দূরপাল্লার পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত সমন্বয়কদের ওপর হামলা হালকাভাবে দেখছে না সরকার কমছে ৪৭তম বিসিএসের আবেদন ফি গাজীপুরে কোরআন অবমাননার অভিযোগে কলেজছাত্র গ্রেফতার অযাচিত অস্থিরতা নয়, দায়িত্বশীল হোন

সকল