২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অচিরেই নির্বাচন নয়

অচিরেই নির্বাচন নয় - নয়া দিগন্ত

১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর খন্দকার মোশতাক ওই বছর শবেকদরের রাতে এক বেতার ভাষণে বলেন, দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। খন্দকার মোশতাকের এই তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণ ছিল, তিনি ভেবেছিলেন, সদ্য বিদায়ী সরকারের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ মানুষ হয়তো তাকেই ভোট দেবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, খন্দকার মোশতাকের ওই নির্বাচন প্রায় সাড়ে তিন বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন তিনি আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের ক্যুর পরে বিচারপতি সায়েম প্রেসিডেন্ট হলে তিনিও ওই ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। নির্বাচনের জন্য নতুন ভোটার লিস্ট ছাপার কাজও প্রায় সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন এমন এক ব্যক্তি যার কথার উপরে প্রেসিডেন্ট সায়েম তো দূরের কথা উপসামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমানেরও কথা বলার জো ছিল না। মওলানা ভাসানী বললেন, ‘এই মুহূর্তে দ্যাশে কোনো নির্বাচন হইতে পারে না।’

১৯৭৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসা শেষে লন্ডন থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে তখনকার বিমানবন্দরে তিনি বলেন, ‘জনগণ এ মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। মুসলিম লীগ নেতারা এবং সত্তরের নির্বাচনে যারা একটা সিটও পায় নেই তারা এই নির্বাচনের জন্য পাগল হয়েও গিয়েছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘সরকার আগে দুর্নীতিবাজ, অবাঙালিদের বাড়ি দখলকারী, অস্ত্রধারী, চোরাকারবারিসহ সব কুকর্মের হোতাদেরকে গ্রেফতার করুক এবং তাদের বিচার করা হোক।’ তার এই সময়োচিত সতর্কবাণী উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট সায়েম নির্বাচনের ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে চাইলেন। মওলানা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হুঙ্কার ছেড়ে বলেন, ‘সায়েম নির্বাচন করতে চাইলে আমি তার পিঠের চামড়া তুলে দেবো।’ জিয়াউর রহমান এমন দোটানা অবস্থায় এক দিন রাজধানীর বড় কোনো এক হাসপাতালে মওলানার সাথে দেখা করলে তিনি বলেন, ‘তুমি কালকের পোলা, আমারে রাজনীতি শিখাও।’ মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ডেও জাতীয় প্রয়োজনে জরুরি মুহূর্তে প্রায় ছয় বছর নির্বাচন বন্ধ ছিল।

আজ আমাদেরও এই মুহূর্তে একটি দলের গত ১৫ বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপের শাসনের ফলে মহাদুর্দশাগ্রস্ত এ দেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ নেই।’ ভাসানী বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে নির্বাচন করা যাবে না। ভোটপ্রার্থীও হওয়া যাবে না। এ জন্য সরকারের কাছে দরখাস্তও করা যাবে না। তাহলে আবার মহাদুর্নীতিবাজ, ব্যাংক ডাকাত, ঘুষখোর, অর্থপাচারকারী, চোরাকারবারি, কমিশন এজেন্ট, খাসজমি, গরিবের জমি, হিন্দুর জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, গাড়ি দখলকারীরা তাদের অর্জিত অর্থ দ্বারা আবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবে।’

মওলানা আরো বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে ভোট না হলে দেশ নষ্ট হয়ে যাবে না। টাকা দিয়ে ভোট কেনা বন্ধ করতে হবে। আগে যেসব লোক দাগি, মার্কামারা, পাপী, তাপী তাদের গ্রেফতার করে এবং বিচার করা হোক। নির্বাচন এলেই হাটে, মাঠে, গ্রামগঞ্জে, নগর-বন্দরে, অফিস-আদালতে সর্বত্র শুরু হয় টাকার ছড়াছড়ি। এখন যে অবস্থা, উপযুক্ত খরচা না দিলে কোনো ক্যানভাসার কাজ করতে রাজি হবে না। তা সেই ক্যানভাসার ক্যান্ডিডেটের শালা হোক, বোনাই হোক বা মামাতো, খালাতো ভাই হোক, আর দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হোক না কেন। যারা এ দেশে ভোটের বাজারে ঘুষ খাওয়ার অভ্যাস সৃষ্টি করেছে তাদের এই অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। মওলানা আরো বলেছিলেন, দেশের মানুষ অত্যন্ত গণতন্ত্রপ্রিয়, স্বাধীনতাপ্রিয়। স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচা যাবে না তা তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। অথচ গত ১৫ বছর গণতন্ত্র নির্মূল করে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যারা এ কাজ করেছিল তারাই আজ নির্বাসনে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব নির্বাচন। সেই নির্বাচন দুই মাসের মধ্যেই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন, নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে জনবিরোধী শক্তি ও বিদেশী এজেন্টরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

ঢাকা এয়ারপোর্টে মওলানার বিবৃতির পরদিন খন্দকার মোশতাক, খান এ সবুর, জেনারেল ওসমানী এক বিবৃতিতে মওলানাকে আজীবন জ্বালাও-পোড়াও, ঘেরাও আন্দোলনের উৎগাতা বলে অভিহিত করেন। পরের দিন জেনারেল ওসমানী তার লিখিত বিবৃতিতে জানান, মওলানা সম্পর্কে তার বক্তব্যে কোনো ধৃষ্টতামূলক শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। মওলানা সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্যের যোগ্য ব্যক্তি তিনি নন। এখানে উল্লেখযোগ্য, সাংবাদিকরা একবার প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, শুনি দেশে ১৫৭টি দল আছে (বর্তমানে আরো বেশি)। এত ছোট দেশে, এত রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোথায় আছে? কোন কোন দল নিয়ে সরকার গঠন হবে?

আজ ২০২৪ সালে এ মুহূর্তে আইন ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে প্রকাশ্যে অস্ত্রধারী, দুর্বৃত্তদের দমন, রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি, রফতানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি, সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি সরকারের সর্বপ্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তা না করে নির্বাচন নির্বাচন করে গদি দখলের প্রতিযোগিতায় জাতিকে উদ্বুদ্ধ করলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হবে। সাথে সাথে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দেবে। তাই দেশে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না।

এটিই আজ জনগণের সর্বাগ্রের দাবি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার ব্যবস্থা করাই এখন প্রথম জরুরি কর্তব্য। এ মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে মানুষ আবার বিশৃঙ্খলা ও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ফিরে যেতে চায় না। বাংলাদেশের শত্রুরাও এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকবে না।

আবার মওলানার কাছে ফিরে যেতে হয়। ভাসানী জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি সায়েমের মতো চেয়ারে বসে থেকো না। সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখো।’ কথা রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই মহান নেতার আহ্বানে ইতিহাস গড়ার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর। তিনিও চারণের মতো বাংলাদেশ ঘুরতে লাগলেন। উপরে আল্লাহ, নিচে জনগণ এই অবিচল আস্থা নিয়ে সৎ ও নির্ভীক শাসনের এক সক্রিয় কর্মকাঠামো ও কর্মজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন জিয়া। এতে তার ব্যক্তিগত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির লেশমাত্র ছিল না বলেই সমাজের বিশাল দিগন্ত থেকে সৃজনশীল জনগণ সাহসের সাথে প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাসে এগিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছিল তার পাশে। এমন জাগরণ রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি।

আজ দেশ ও জাতির বেদানার্ত পরিবেশে জিয়ার মতো একজন নেতার বড়ই প্রয়োজন। তিনি তার জাতিকে উন্নততর জীবন উপহার দিয়েছিলেন। তলাবিহীন দেশটিকে উৎপাদন ও উন্নয়নে ভিন্ন এক অবস্থানে উঠিয়ে এনেছিলেন। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে- ‘গালিয়াতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বনি ইসরাইলিরা মুসা আ:-এর পরে আগত নবী সামিউল আ:-এর কাছে গিয়ে বলেছিলেন; হে নবী তুমি মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রয়োজনে এমন একজন নেতার জন্য প্রার্থনা করো যেন তার পেছনে আমরা যুদ্ধ করতে পারি।

আজ বাংলাদেশবাসীও মহান আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে প্রার্থনা করছে, হে আল্লাহ, তুমি আমাদের এমন একজন নেতা দাও, যে নেতার পেছনে আমরা দেশ গড়তে পারি, যুদ্ধ করতে পারি।

লেখিকা : আইনজীবী


আরো সংবাদ



premium cement