অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : শঙ্কা ও সম্ভাবনা
- জিয়া আহমদ এনডিসি
- ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৫:২৭
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ও পালানোর পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এমন এক সময় দেশের শাসনভার গ্রহণ করল, যার সাথে দেশটির ৫৩ বছরের ইতিহাসের কোনো সময়ের তুলনা চলে না। দুই বছর মেয়াদি সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর একটা নিখুঁত পরিকল্পনা ও তার চমৎকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত একটি ইঞ্জিনিয়ারড নির্বাচনের মাধ্যমে ভারত-আমেরিকার যৌথ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর গত প্রায় ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এই দেশে স্বৈরাচারী কায়দায় শাসন-শোষণ চালিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে এই স্বৈরাচারী সরকার দেশের শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংসের শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো এই সরকারের সময়কালে দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না।
সমালোচনা বন্ধের জন্য অনানুষ্ঠানিক শাস্তির (যেমন গুম, খুন ইত্যাদি) বাইরেও আনুষ্ঠানিকভাবে কুখ্যাত ৫৭ ধারা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রভৃতি কালাকানুন প্রণয়ন ও তার অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মানুষ তো বটেই, এমনকি শিশুদেরও কোনো ছাড় না দিয়ে কোনোরকম বিচার ছাড়াই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাবন্দী রেখে শাস্তি দিয়েছে। এসবের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তা ও লেখক মুশতাক আহমেদকে কারাগারে নির্মম অত্যাচার করে মৃত্যু নিশ্চিত করা। মোশতাকের দোষ কী ছিল? তিনি স্বৈরাচারী হাসিনার পুত্র জয়ের বন্ধু চৌধুরী নাফিজ সরাফতের ব্যাংক লুটের কাহিনী নিয়ে কার্টুন করেছিলেন। আর আমাদের উচ্চ আদালত এত দলদাসে পরিণত হয়েছিল যে, ছয়বার জামিনের আবেদন করেও তার জামিন মেলেনি।
এই যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করল, তারা শপথ নিলেন যে, তারা ‘বিদ্যমান সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’। কোন সংবিধান এটি? এটি কী সেই সংবিধান যার ২৬টি অনুচ্ছেদ (১৫৩টির মধ্যে) একজন মানুষ ও তার পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সংযোজন/সংশোধন/পরিবর্তন করা হয়েছে? যে সংবিধান থেকে রূঢ়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তো বটেই, সব মানবাধিকারের অনুচ্ছেদগুলো হয় মুছে ফেলা হয়েছে; নয়তো নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা যারা হলেন, তাদের মধ্যে বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছেন। মোহাম্মদ ইউনূস ও ৪-৫ জন মানুষ ছাড়া আস্থায় নেয়ার মতো মুখ কমই দেখছি। তার পরও তাদের অভিনন্দন জানাই এবং সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি। বিশ্বাস করি, ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতা সরকারকে সফলতা এনে দেবে।
অবৈধ সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে পুলিশ বাহিনীর প্রায় সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই আওয়ামী লীগের ক্যাডার বনে গিয়েছিলেন, যারা গত ১৫ বছর স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করেছেন; বিনিময়ে অবাধ লুটপাটের সুযোগ পেয়েছেন। এর অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে বেনজীর, হারুন, আসাদুজ্জামান, মনিরুল অন্যতম নিকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত এই গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে ভারত। তারা তাদের সাত রাজ্যের অখণ্ডতার নিরাপত্তা তো বটেই, এ ছাড়াও তারা যেসব অবৈধ সুযোগ-সুবিধা এতদিন ভোগ করেছে, তা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের ‘গোদি মিডিয়া’সহ বাংলাদেশে পতিত স্বৈরাচারের উচ্ছিষ্টভোগীদের নিয়ে একটি সাইবার যুদ্ধ শুরু করেছে। এরা নিত্যনতুন গুজব ছড়াচ্ছে।
সিভিল প্রশাসনে গত ১৫ বছরে যাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, তারা সবাই আওয়ামী পরিবারের সদস্য। ফলে কর্মরত সচিবদের বাধ্যতামূলক অবসর দিলেও নতুন সচিব নিয়োগের জন্য দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা পাওয়া দুষ্কর হবে। তার পরও, খোঁজখবর নিয়ে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে নতুন প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে। সিভিল প্রশাসনের জন্য অবিলম্বে একটি বিসিএস পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পরিবারের বাইরের শিক্ষিত যুবকদের প্রশাসনে আনতে হবে, বিশেষত সেসব তরুণকে যারা শুধু আওয়ামী লীগ পরিবার থেকে না আসার কারণে বিসিএসের সর্বশেষ পর্যায়ে এসেও বাদ পড়েছিলেন।
অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতিরা যখন নিজেদের ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন, তখন বিচার বিভাগ নিয়ে আর কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। এই গণধিকৃত বিচারক শাহীন, রহিম আর জমাদারদের অনতিবিলম্বে বহিষ্কার করা ও আইনের আওতায় আনা দরকার। আর নিম্ন আদালতে বিচারকরা ‘পুলিশ বাদী’ গায়েবি মামলায় শুধু পুলিশের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলনকারীদের যখন বছরের পর বছর সাজার রায় দেন, তখন দুঃখের মাঝেও হাসি আসে। তারা তো আইন পড়ে এসেছেন। মানুষের ন্যূনতম অধিকারটাও তারা সংরক্ষণ করবেন না? বিচারক পদ তা তো শুধু একটা চাকরি না, মানুষের অধিকার রক্ষা এই পেশার অন্যতম একটি বিশাল দায়িত্বও বটে। কিন্তু রাস্তার ধারের ল’কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে পাস করা ও দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এসব আবর্জনার কাছে মানবিকতা ও মৌলিক অধিকার হাস্যরসের বিষয়।
গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। অশুভ ও নকলবাজ লেখক জাফর ইকবালের নেতৃত্বে দেশের স্বার্থবিরোধী একটি চক্র বাংলাদেশকে ভারতের ওপর চিরনির্ভরশীল রাখার অশুভ চক্রান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য এ দেশের শিক্ষার্থীদের ওপর নানা পরীক্ষার নামে একটি মূর্খ প্রজন্ম তৈরির চেষ্টা অবিরাম চালিয়ে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে রক্ষার জন্য অবিলম্বে একটি ছোট আকারের ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে এ দেশে পূর্বে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত শিক্ষাপদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন এবং আধুনিক ও উন্নত মানের সিলেবাস তৈরি করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও আইটিবিষয়ক শিক্ষার উপর, যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা নতুন মিলেনিয়ামের যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশে যদিও যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, তার পরও আমাদের প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য আমদানি করতে হয়। এই আমদানির একটা বড় অংশই আসে ভারত থেকে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য বিকল্প থেকে খাদ্য আমদানির উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রায় সব বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বৈরাচারী হাসিনার ব্যক্তিগত টাকশালে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দখল করে এর মূলধনসহ সব গচ্ছিত অর্থ লোপাট ও বিদেশে পাচার করেছে সরকার ও তার ওলিগার্করা। এই অপকর্মের তদন্ত ও প্রতিবিধানের কাজ ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি। এই সরকারের পক্ষে তাদের কার্যকালে সব সমাধান করা সম্ভব মনে করি না। এ বিষয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের সমন্বয়ে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা এই চুরি ও অর্থপাচারের বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন ও প্রকাশ করবে, যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে কারা আমাদের কত পরিমাণ অর্থ লুট ও বিদেশে পাচার করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে খুব সংবেদনশীল। গত ৫ আগস্টের পর সিন্ডিকেটের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন সবজির দাম কমে এসেছে। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না । দ্রুতই নতুন আর একদল লোক এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসবে, যার আলামত আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। সে কারণে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সৎ ও দক্ষ নতুন কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করে এই প্রতিষ্ঠানটিকে কর্মচঞ্চল করতে না পারলে, দেশের সম্পদ লুটকারীদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে না। রেল সংযোগসহ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের পদ্মা সেতুর প্রকৃত ব্যয় কিভাবে ৬০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়? গত ষোলো বছরে বাস্তবায়িত সব মেগা প্রকল্পের ব্যয় ও এর বাস্তবায়নকারীদের ওপর একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা জরুরি।
উপরে উল্লিখিত কাজগুলো খুবই কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। দেশের জনগণ যে পরিমাণ সময় এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিতে প্রস্তুত, তার মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমি ১৯৯০-৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমকে অনুসরণ করার পরামর্শ দেব।
সাহাবুদ্দীন সাহেবের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন, যারা সেক্টর ওয়াইজ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় রিফর্মের তালিকা ও কর্মপদ্ধতি বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ৫ ভলিউমের একটি সেট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।
সবশেষে আমার পরামর্শ হলো, যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আখেরে লাভ তো হবেই না, বরং গণঅভ্যুত্থানের ফলে সব অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা