২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দুর্নীতি রোধে নিজেকে সৎ হতে হবে

দুর্নীতি রোধে নিজেকে সৎ হতে হবে - ফাইল ছবি

কিছু শীর্ষস্থানীয় সরকারি আমলার লাগামহীন দুর্নীতির খবরে দেশ এখন বেশ সরগরম। চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা ও সমালোচনা। এদের সম্পত্তির পরিমাণ এত বেশি যে, তা চাকরির বেতন দিয়ে নয়; বরং লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমেই কেবল অর্জন করা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে পুকুরচুরি নয়, রীতিমতো সাগরচুরি হয়েছে। তাই সবাই আজ একবাক্যে তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন। একই সাথে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলের দাবিও জানাচ্ছে সবাই।

দুর্নীতি হচ্ছে দেশ ও জাতির জন্য একটি ক্যান্সার। ক্যান্সার যেমন মানবদেহের সব কিছুকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনি দুর্নীতিও একটি জাতির সব সম্ভাবনাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। দুর্নীতির সীমা-পরিসীমা অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। ঘুষ, চুরি, আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি- সবই দুর্নীতি। ঘুষ ছাড়া একজন কর্মকর্তা কাজ করেন না এটি যেমন দুর্নীতি, তেমনি কলমের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কাউকে কিছু দেয়াটাও দুর্নীতি। অকারণে ফাইল আটকে রাখা ও ঘুষের বিনিময়ে সেই ফাইল অনুমোদন করাটা মস্তবড় দুর্নীতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করাটাও দুর্নীতি। ন্যায়বিচার না করা ও বিচারকে বিলম্বিত করাও দুর্নীতি। অন্যায়ভাবে টেন্ডার আয়ত্ত করা, ওজন ও পরিমাপে কম দেয়াও দুর্নীতি। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয়া ও কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করাও দুর্নীতি। দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া এবং অবহেলা, অপরকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও দুর্নীতি। যথাযথ ট্যাক্স না দেয়া এবং ট্যাক্স যথাযথ আদায় না করাও দুর্নীতি। সত্য কথা না বলা, মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা রিপোর্ট করাও দুর্নীতি। টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা এবং এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অযোগ্যদেরকে নিয়োগ দেয়াটাও মহা দুর্নীতি। ওয়াদা পালন না করা, আমানতদারিতা ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করাও দুর্নীতি।

কিন্তু শুধু দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে দেশ দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে আগে আমাদের সবাইকে সৎ হতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সৎ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াস। সৎ মানুষ ছাড়া দুর্নীতি নির্মূল কখনোই সম্ভব নয়।

দুর্নীতি, অসততা ও অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। আইনের প্রয়োগ যিনি করবেন, তিন যদি সৎ না হন আইন যথাযথ কার্যকরী হয় না। একটি গাড়ি যতই ভালো হোক, ড্রাইভার ভালো না হলে ওই গাড়ি যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না; বরং দুর্ঘটনায় মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। সুতরাং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সৎ মানুষ অপরিহার্য। এ জন্য সৎ মানুষ তৈরি করতে হবে। এর বিকল্পই নেই।

সৎ মানুষ তৈরির দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সবার। প্রথমত, এ কাজটি শুরু করতে হবে সমাজের একেবারে প্রাথমিক স্তর- পরিবার থেকেই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা যাতে নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে ওঠে, সে জন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সৎ ও আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে করে সংগঠনের কর্মীরা সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করে এবং সে হিসেবে গড়ে ওঠে। দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ওপর রাজনৈতিক, সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোর সরাসরি প্রভাব থাকে এবং এসব সংগঠনের নেতাদের চরিত্র ও কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা প্রভাবিত হয়। সুতরাং রাজনৈতিক, সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোতে সততা এবং নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। চতুর্থত, দেশের সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে নৈতিকতার আলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে। নাটক সিনেমা হচ্ছে সমাজের দর্পণ, সমাজকে পরিবর্তনের উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এমন নাটক ও সিনেমা তৈরি করতে হবে যাতে এসব নাটক ও সিনেমা দেখে মানুষের মধ্যে সততা এবং নৈতিকতা জেগে ওঠে।

আমরা যদি নিজেরা সৎ না হই এবং সৎ মানুষ তৈরি না করি, তাহলে শুধু আইন করে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। এটি দুর্নীতিকে সাময়িকভাবে কমাবে মাত্র। প্রবাদ আছে, চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব. অর্থাৎ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সমাজটাকে যদি দুর্নীতিমুক্ত করতে চাই তাহলে সমাজে দুর্নীতির জীবাণু যাতে সংক্রমিত হতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তার পরও যদি কোনো মানুষ দুর্নীতি করে তাহলে তাকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে।

মহানবী সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে চারিত্রিক গুণাবলির দিক দিয়ে উত্তম।’ অতএব, আসুন আমরা সবাই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে উত্তম চরিত্রের মানুষ তৈরির জন্য কাজ শুরু করি।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement