২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অখণ্ড ভারত দর্শন

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগ্রহ

ব্রিটেনের ব্রেডফোর্ড শহরের সিটি কাউন্সিল হলে অনুষ্ঠিত কাশ্মির সেমিনারে মতামত পেশ করার পর বাইরে আসতেই এক পুরনো বন্ধুকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থ হয়ে যাই। তার বাড়ি বাংলাদেশে। সে বর্তমানে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। যখনই তার সাথে দেখা হয়, তখনই সে সবার আগে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে এ নিশ্চয়তা চেয়ে নেয়, ‘তুমি তোমার কলামে আমার নাম লিখবে না।’ আমি তাকে সবসময় প্রফেসর বলে ডাকি আর সে আমাকে ব্লাডি সিভিলিয়ান বলে তৃপ্তি পায়। সে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ক্যামব্রিজ থেকে ব্রেডফোর্ড ছুটে এসেছে। সে আমাকে লাঞ্চের দাওয়াত দিলো।

আমি বললাম, আমি তো সোজা অক্সফোর্ড যাচ্ছি। ওখান থেকে পরের দিন লন্ডন যাবো। তুমি লন্ডন চলে আসো। প্রফেসর হতাশ হলো। কিছু একটা ভেবে বলল, অক্সফোর্ডে তো ছুটি চলছে। তুমি কার কাছে যাচ্ছ? আমি বললাম, ওখানকার শিক্ষক ড. আদিল মালিকের কাছে সময় নেয়া আছে। তার সাথে সাক্ষাৎ করব। তুমিও সাথে চলো। সে বলল, অক্সফোর্ডে আমারও একটা কাজ আছে। তুমি কি কাল সকালে আমাকে মাত্র আধঘণ্টা সময় দিতে পারবে? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালে প্রফেসর অক্সফোর্ডের ব্রডস্ট্রিটে ব্ল্যাকওয়েল বুক শপের কাছে তার এক বন্ধুর কফি হাউজের ঠিকানা দিলেন। ওই দিনই সন্ধ্যায় ড. আদিল মালিকের হাতের রান্না করা চিকেন কড়াই খেয়ে আমি প্রফেসরকে ফোন করে বললাম, সকালে সাক্ষাতের পরিবর্তে আজ রাতেই বসতে পারি। সে বলল, সে অক্সফোর্ড থেকে দুই ঘণ্টার দূরের পথে রয়েছে। এ জন্য কাল সকালেই সাক্ষাৎ হবে।

পরদিন খুব সকালে আমি প্রফেসরের সামনে বসে আছি। তিনি বললেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় এসে বদলে যান। আমি মুচকি হেসে তার বিদ্রƒপ উড়িয়ে দিলাম। কফি পান শেষ করা হলে প্রফেসর আমাকে ব্রডস্ট্রিটে নিয়ে আসেন। সামনের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা এখানকার শহীদ মিনার। ১৫৫৫ সালে ব্রিটেনের রানী মেরি টিওডর পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে কিছু পাদ্রিকে এখানে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তাদের জীবিত পোড়ানো হয়েছিল। কেননা ওই প্রোটেস্ট্যান্ট পাদ্রিদের সাথে রানীর ধর্মীয় বিরোধ ছিল। ওই পাদ্রিদের স্মরণে এখানে একটি মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। এটাকে আমরা শহীদ মিনার বলি। প্রফেসর বললেন, ঢাকার শহীদ মিনার তুমি দেখেছ। ওটা বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মারক। অক্সফোর্ডের শহীদ মিনার নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য যাদের জীবিত পুড়িয়ে মারা হয়েছে তাদের স্মারক।

এ কাহিনী শুনিয়ে প্রফেসর আমাকে কফি হাউজে ফিরিয়ে আনলেন। তিনি বলতে লাগলেন, পাকিস্তানের ছয়জন প্রধানমন্ত্রী এ অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করেছেন। লিয়াকত আলী খান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফিরোজ খান নুন, জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো ও ইমরান খান। ভারতের দু’জন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও মনমোহন সিং এ বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। ভারত ও পাকিস্তানকে ব্রিটেনের রানী মেরি টিওডরের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত নয়। আর ধর্মীয় মতবিরোধের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের হত্যা করা উচিত নয়। আমি তাকে পরিষ্কার করে দিলাম, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতন করা হয়, তবে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের বিরোধী নয়।

প্রফেসর সাহেব দ্বিতীয়বার কফির অর্ডার দিয়ে বললেন, আজ আমি তোমার সাথে আমার রিসার্চ সম্পর্কে কথা বলব। রানী মেরি টিওডোরকে ‘ব্লাডি মেরি’ বলা হয়। আমি আমার রিসার্চ শেষে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ যুগের ‘ব্লাডি মোদি’। প্রফেসর বললেন, তিনি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সাথে হওয়া নির্যাতনের প্রেক্ষাপট নিয়ে রিসার্চ করেছেন। এ কারণে তার হিন্দুমহাসভা ও আরএসএস-এর চিন্তাদর্শন অনুধাবনের সুযোগ হয়। তিনি এটা জেনে মারাত্মক অস্থির হন যে, ভারতের শাসক দল মূলত হিন্দুমহাসভা ও আরএসএস-এর মতো ‘অখণ্ড ভারত’-এ বিশ্বাস করে। তারা শুধু জম্মু-কাশ্মিরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করে, তা নয়, বরং তারা আগামী দিনে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের ওপরও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। যার কারণে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

প্রফেসর তার আইপ্যাড খুলে আমাকে বললেন, ব্লাডি মোদি বেশ সতর্কতার সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ব্যবহার করছেন। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন থেকে অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছেন আর ভারতে মুসলমানদের বংশ নির্মূলের উদ্দেশ্য গণহত্যা চালাচ্ছেন। প্রফেসর বললেন, আপনাদের কাশ্মিরের পাশাপাশি আসামের মুসলমানদের দুঃখটাও অনুধাবন করতে হবে। বিজেপি বলে, শিখ, জৈন ও বৌদ্ধরা মূলত হিন্দু। এরা সবাই হিন্দু হয়ে যাবে। ইসলাম ও খ্রিষ্টান বিদেশী ধর্ম। বিজেপি শুধু পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে হিন্দুরাজ্য বানাতে চাচ্ছে, তা নয়, বরং মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক হিন্দু বানাতে চাচ্ছে।

প্রফেসর বললেন, উপমহাদেশে ইসলাম আরবদের মাধ্যমে এসেছে। কাশ্মিরে ইসলাম এসেছে মধ্য এশিয়া ও ইরানের পথ ধরে। আজ মোদি আরবদের চোখের মণি। মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সাথেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। অথচ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতি ভারত বিদ্বেষ পোষণ করে। বাংলাদেশের সুফি বুজুর্গ হজরত শাহজালাল কৌনিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং মক্কায় বেড়ে উঠেছেন। পাকিস্তানের সুফি বুজুর্গ দাতা গঞ্জবখশ এবং ভারতের বুজুর্গ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আফগানিস্তান থেকে এসেছেন। ব্লাডি মোদি আফগানিস্তানের সাথে বন্ধুত্বের দাবি করেন, অথচ পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মুসলমানদের খতম করতে চাচ্ছেন। আমি প্রফেসরের কাছে জানতে চাইলাম, তুমি কি এ রিসার্চ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবে? প্রফেসর দৃষ্টি নত করে বললেন, প্রথমে আমার পরিবারকে বাংলাদেশ থেকে বের করব, এরপর গ্রন্থ প্রকাশ করব। ব্লাডি মোদি আমার পরিবারকে ওখানে শেষ করে দেবে। তার ঠোঁট কাঁপছিল। সে কাঁপা হাতে কফির কাপ ধরে ভীত কণ্ঠে বলল, আমি ভারতের মুসলমানদের জন্য বিশাল বড় ধ্বংসযজ্ঞ আসতে দেখছি।

তাদের অপরাধ, তারা কয়েক শতাব্দী আগে আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুসলমান হয়েছিল। আজ সেই আরব ব্যবসার খাতিরে ব্লাডি মোদিকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে এবং স্থানীয় মুসলমানদের উপেক্ষা করছে। প্রফেসরের কাছে বিদায় চাইলে সে আমার হাত ধরে বলল, শুধু এটাই বলতে চেয়েছিলাম যে, শুধু পাকিস্তান নয়, বরং বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত পুরো দক্ষিণ এশিয়া বিপদে আছে। তবে আমার নাম প্রকাশ করবে না। আমার পরিবার এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। ব্লাডি মোদি আমার পরিবারকে ছাড়বে না। কেননা আমি হিন্দু। তবে সব হিন্দু মোদির মতো নয়।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement