বৈষম্যের বিরুদ্ধে আর কত যুদ্ধ
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০৭:০৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের কিছু মৌলিক কারণ ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। বাংলাদেশের মানুষের এই চাহিদার পেছনে বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস ছিল। প্রথমত, এই উপমহাদেশের মানুষ ব্রিটিশরাজ দ্বারা শোষিত বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, বহু রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেই স্বাধীনতার ফল ছিল ব্রিটিশ-ভারত ভাগ হয়ে ভারত-পাকিস্তান নামের দু’টি আলাদা রাষ্ট্র গঠন। আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার দূরের তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নিদারুণভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়। পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক সরকারের নিষ্ঠুরতা এবং শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে আরেকটি স্বাধীনতাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যার ফল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীনতাযুদ্ধ কোনো একক গোষ্ঠীর বীরত্বের কারণে বিজয় অর্জন করেনি। এটি ছিল সর্বশ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণে একটি জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কারো অবদানকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সবার সম্মিলিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশের ভূখণ্ড আজ বৈষম্য আর স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত। অধিকার চাইতে গেলে, সাম্যের কথা বলতে গেলে গলা চেপে ধরে এমনকি জীবন পর্যন্ত কেড়ে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে দুর্নীতির মাধ্যমে একশ্রেণীর লোক রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে। তারা থাকছে আইন আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মুষ্টিমেয় এই জাতের লোকের অত্যাচারে নির্যাতনে গোটা দেশের মানুষ আতঙ্কিত। চেতনাধারীরা চেতনা বিক্রি করে রাষ্ট্রের সব সুবিধা কুক্ষিগত করে বিরাট শ্রেণীকে বঞ্চিত করে চলেছে বছরের পর বছর। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা বিদ্যমান ছিল। মেধা কোটার নামে ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ থাকলেও রাজনীতি ও দুর্নীতি কোটায় তার ৪০ শতাংশ বিক্রি হয়ে যেত। কেবলমাত্র ৪ শতাংশ মেধাবী বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ পেত। দলীয় আর দুর্নীতি কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা বেনজীর, আজিজ, মতিউর-এর মতো সর্বগ্রাসী রূপে আবির্ভূত হয়। রাষ্ট্রের সব সম্পদ লুটেপুটে নিচ্ছে তারা। প্রধানমন্ত্রীর পানি টানার পিয়নও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। একজন পিয়নের যখন এই অবস্থা তখন এর চেয়ে উপর লেভেলের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়। দুর্নীতির এই মহা অধিপতিরা নিরাপদেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। যতসব সমস্যা অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলোর অধিকার চাওয়াতে।
কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে গোটা রাষ্ট্রশক্তি ছাত্রসমাজের ওপর যেভাবে হামলে পড়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এত নির্মমতা বাংলাদেশের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতা চালিয়ে যেভাবে মানুষ হত্যা করছে, ঠিক একইভাবে ১৮ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বশক্তি নিয়োগ করে মানুষ হত্যার মিশন শুরু করেছিল সরকার। রাষ্ট্রশক্তির এই বেআইনি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে গোটা দেশের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। নিরীহ, নিরস্ত্র, অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছাত্রদের ওপর রাষ্ট্রের এই নিষ্ঠুরতা দেশের জনগণ নীরবে মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদের ঝাণ্ডা হাতে সরকারের নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়ে বহু তাজা প্রাণ ঝরে গেছে মুহূর্তের মধ্যেই। রংপুর বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ নিরস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় হৃদয়হীন পুলিশের নির্মম বুলেটের আঘাতে প্রথমেই শহীদ হন। ১৯৭১-এর হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার সাথে আবু সাইদকে হত্যাকারী পুলিশের নিষ্ঠুরতার মধ্যে কোনো তফাত ছিল না। বরং এই প্রজন্মের যারা স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ দেখে নাই, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছর পরে এসে স্বাধীন দেশের মানুষ স্বাধীন দেশের পুলিশ দ্বারা হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্রের সাক্ষী হলো।
কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। হয়ত কোনো দিন বলা সম্ভবও হবে না। রাষ্ট্রের সব যন্ত্র ব্যবহার করে দেশের জনগণের সাথে সরকারের এই যুদ্ধে সরকারই পরাজিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, সরকারের শক্তি জনগণ নয়; সরকারের শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্র। লাখো প্রাণ কেড়ে হলেও ক্ষমতা ধরে রাখাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। জনগণের সমর্থনবিহীন সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যে তিক্ততার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসা খুব সহজ হবে না। সমাজের মানুষের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তা ঐক্যের জায়গায় আদৌ কোনোদিন ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। আজকে যে সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে তা হলো, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি রাষ্ট্রের বৃহৎ জনগণের চাহিদাকে প্রাধান্য দেয় না। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করাই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মূল লক্ষ্য। শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতে গিয়েই ছাত্রসমাজে যে প্রতিবাদ উঠেছিল নিষ্ঠুর পন্থায় তা দমন করতে গিয়ে অগণিত মানুষের জীবন কেড়ে নিতে সরকারের একটুও দ্বিধা হয়নি।
রাষ্ট্রের বহু সম্পদ নষ্ট হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে। এ দায় কার? সরকার কি এই দায় এড়াতে পারে? কেন তারা ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য ছাত্রলীগ এবং পুলিশ লেলিয়ে দিলো? কেন সরকারের একজন মন্ত্রী বললেন, এদের দমন করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট? কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের এই আন্দোলন কিভাবে সরকার ও আওয়ামী লীগের অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে?
এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব সহজ। বিগত আঠারোটি বছর সরকারকে জনগণের সমর্থন নিতে হয়নি। এই সময়ের মধ্যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে পারেনি। কারণ, সরকার-রাষ্ট্রযন্ত্র এবং আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে। অত্যাচারের এমন কোনো দিক নেই যা বিরোধী রাজনীতি শক্তির ওপর প্রয়োগ করা হয়নি। সরকার ও আওয়ামী লীগের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রতিবাদকেই আঘাত হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারবে না এটাই ছিল তাদের ধারণা। প্রতিটি অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী সরকারই একটি পেটুয়া বাহিনী তৈরি করে যাদের কাজ প্রতিবাদী কণ্ঠকে নিষ্ঠুরতার সাথে দমন করা। আওয়ামী লীগও ছাত্রলীগকে সেই বাহিনীতে পরিণত করেছে বলেই ছাত্র আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগের ওপর তাদের এত নির্ভরতা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার গর্জনের কাছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব অস্ত্রের সাথে ছাত্রলীগের অস্ত্রও ভোঁতা হয়ে গেছে। সরকার টের পেয়েছে জনশক্তির ওপর কোনো শক্তি নেই।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তি এই উপাধি দিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে রাষ্ট্রের জনগণকে এইভাবে বিভক্ত করা কোনোভাবেই উচিত নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ভালো মতো পড়লেই জানা যাবে ওই সময় কার কী ভূমিকা ছিল । কথায় কথায় সবাইকে ‘রাজাকার’ তকমা দেয়া শোভন নয়। বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে বাকি জনগণকে ধিক্কার দেয়া একটি রোগে পরিণত হয়েছে। এই ধিক্কার হজম করতে না পারার প্রতিবাদ কিন্তু একটি নতুন সে্লাগানের জন্ম দিয়েছে। এই যে একটি সে্লাগানের জন্ম হলো। এখানে সরকারের বলার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। কারণ, স্বৈরাচার কাকে কী নামে ডাকলো তাতে কিছুই যায় আসে না। এটা দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের একটি অপকৌশল মাত্র। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এখানে জাতিকে বিভক্ত করার সুযোগ নেই। যদিও কিছু লোক রাজাকার, আলবদর, আল সামস ছিল এটা সত্য।
আজকের যে স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান এর একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। এটি অতীতের ইতিহাস যেমন সামনে টেনে আনছে অন্যদিকে এর একটা নিজস্ব চেহারাও আছে। ছাত্রদের এই অভ্যুত্থানে সর্বশ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে তারা কতটা বিষবাষ্প নিয়ে বেঁচে আছেন। এখন তাদের মুক্তির প্রয়োজন। তারা জীবন দিতেও প্রস্তুত। অন্য দিকে সরকার মসনদ টিকিয়ে রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রের সব বাহিনীকে নিপীড়কের ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করছে। পরিশেষে শুধু এইটুকুই বলতে চাই, অভ্যুত্থানের যে ব্যঞ্জনা শুরু হয়েছে এর তাল-লয়-সুর বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা