২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ভারতে মুসলিম নিপীড়ন

বিজেপির নির্বাচনী বিপর্যয়েও বন্ধ হয়নি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি - ফাইল ছবি

ভারতে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর মূল হোতা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সাম্প্রতিক নির্বাচনে দুর্বল হয়ে পড়লেও মুসলমানরা নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি।

নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার দু’টি আঞ্চলিক দলের সমর্থনে সরকার গঠন করে। আশা করা হচ্ছিল, পার্লামেন্টে অপেক্ষাকৃত স্বল্পসংখ্যক এমপি বিজেপিকে কিছুটা সংশোধনের দিকে নিয়ে যাবে এবং এর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শরিকরা দলটির মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ড গাড়ির ব্রেক হিসাবে কাজ করবে।

কিন্তু সে আশাবাদ দ্রুতই ভ্রান্ত প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্যগুলোতে পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনসহ গোটা কর্তৃপক্ষ মুসলমানদের হয়রানি, অপমান ও হামলা করার নানা রকম শোভন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে শুরু করেছে। এর সব শেষ দৃষ্টান্ত তৈরি করে উত্তর প্রদেশ রাজ্য। চলতি মাসের শুরুর দিকে রাজ্য পুলিশ নির্দেশ জারি করে, রেস্তোরাঁ এমনকি হিন্দু তীর্থযাত্রীরা চলাচল করে এমন সব সড়কের পাশে রিকশাভ্যানের খাবারের দোকানগুলোতেও মালিক ও কর্মচারীদের নাম প্রকাশ্যে প্রদর্শন করতে হবে।

পুলিশ দাবি করে,‘তীর্থযাত্রীদের সহায়তার জন্যই’ এই নির্দেশ। যাতে তারা তীর্থযাত্রাকালে সেইসব প্রতিষ্ঠানের খাবার থেকে পবিত্র থাকতে পারে যেগুলো ধর্মীয়ভাবে তাদের জন্য উপযুক্ত নয়।

উত্তরাখণ্ড ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যও দ্রুত সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এবং মালিক ও কর্মচারীদের নাম প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করে। মধ্যপ্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থস্থান উজ্জয়িনী শহর কর্তৃপক্ষ এতটাই এগিয়ে গেছে যে, নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে মোটা অঙ্কের জরিমানার ঘাষণা দেয়।
নিঃসন্দেহে এটি হিন্দু তীর্থযাত্রীদেরকে নিরামিষ ভোজনে ‘সহায়তা’ করার কোনো নির্দোষ পদক্ষেপ নয়। বরং এটি মুসলমানদের দোকানগুলো চিহ্নিত করা এবং হিন্দুরা যাতে তাদের কাছ থেকে কিছু না কেনে তা নিশ্চিত করার চতুর কৌশল।

নীতিটি মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রতি বৈষম্যমূলক এ কথা কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে। তাদের দাবি, এই নির্দেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী এই নির্দেশনার লক্ষ নয়। কিন্তু একটি রেস্তোরাঁর মালিক এবং কর্মচারীদের নাম জানলেই হিন্দু ভক্তরা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে, রেস্তোরাঁটি তাদের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ খাবার পরিবেশন করে কি না? কর্তৃপক্ষ সেই ব্যাখ্যা দেয়ার দরকার মনে করে না।

কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, আগে রেস্তোরাঁর মালিকদের ‘পরিচয় গোপন করা’র ফলে হিন্দু ভক্তদের মনে ‘বিভ্রান্তির’ সৃষ্টি হয়, যার ফলে অনেক সময় ‘আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা’ দেখা দেয়। এই উদাহরণ দিয়ে পুলিশ যা বোঝাতে চায় তা হলো, কিছু মুসলিম ব্যবসায়ী তাদের খাবারের এমন নাম দেয় যা হিন্দুদের খাবারের মতো মনে হয়। পরে কিছু তীর্থযাত্রী যখন জানতে পারেন ওই দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা আসলে মুসলিম তখন তারা সহিংস হয়ে ওঠেন। পুলিশ বলছে, প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্মচারীদের নাম প্রদর্শিত হলে তা বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা রোধ করবে।
এ এক অদ্ভুত যুক্তি। একটি দোকানের মালিক ও কর্মচারীর পরিচয়ের কারণে হিন্দুরা যদি সহিংস হয় তাহলে তা রোধের জন্য মুসলমানদের কেন আগ বেড়ে ব্যবস্থা নিতে হবে? আর মালিক ও কর্মচারীর নাম প্রকাশ কিভাবে কোনো একটি খাবারের ব্যাপারে হিন্দুদের মনের সন্দেহ দূর করবে?

উদাহরণস্বরূপ, ম্যাকডোনাল্ডস ভারতজুড়ে শাখা থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য খাবার বিক্রি করে। প্রতিটি শাখায় ঠিক একই খাবারের পদ বিক্রি করা হয়। সেখানে কোনো শাখার মালিক যদি হন শ্রী রাম অথবা কোনো শাখার মালিক যদি হন আবদুর রহিম তাহলে কি কোনো পার্থক্য ঘটে?

কোনো একটি শাখার মালিক ও পরিবেশকদের পরিচয় কি কোনোভাবে খাবারের উপকরণ বা তাদের পরিষেবায় কোনো প্রভাব রাখে?

নতুন বিধি নিঃসন্দেহে হিন্দুদেরকে সংশয়যুক্ত খাবার এড়াতে সাহায্য করার জন্য বলবৎ করা হয়নি। বরং এটি করা হয়েছে তাদেরকে মুসলিম প্রতিষ্ঠানে না যেতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে।
নতুন নিয়মের পক্ষে তাদের যুক্তি শানিত করতে কেউ কেউ জোর দিয়ে সেই পুরনো নোংরা প্রচারণা চালাচ্ছেন যে, মুসলমানরা ‘খাবারের ওপর থুতু ছিটিয়ে তারপর সেগুলো বিক্রি করে এবং তারা ‘হিন্দুদের অপবিত্র করার কুমতলবে ইচ্ছাকৃতভাবে খাবারে অশুচি জিনিস মেশায়।’ পুলিশের নির্দেশের যথার্থতা প্রতিপন্ন করার জন্য তারা এমনও বলার চেষ্টা করে যে, মুসলমানরা স্বাস্থ্যগতভাবে মানসম্মত খাবার বানাতে পারে এটা তো বিশ্বাসই করা যায় না। সুতরাং কোনো খাবারের দোকানের মালিক মুসলমান হলে তা জানার অধিকার হিন্দুদের আছে।

রেস্তোরাঁ ও ফুড কোর্টের মালিকদের পরিচয় প্রকাশ করার এই বিধি মূলত হিন্দুদেরকে মুসলমানের দোকান এমনকি মুসলিম কর্মচারী নিয়োগ করেছে এমন হিন্দু মালিকের দোকানও বর্জন করতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্ররোচনা ছাড়া আর কিছু নয়।

বোধগম্য কারণেই এ নির্দেশ নিয়ে প্রতিবাদ হয়। কিন্তু রাজ্য সরকার আরো জোরের সাথে বলেছে, তারা কেবল তীর্থস্থানমুখী সড়কের প্রতিষ্ঠানই নয়, রাজ্যজুড়ে সব প্রতিষ্ঠানের ওপর এই বিধি বলবৎ করবে। উপরে উল্লিখিত অন্য রাজ্যগুলোও আদেশের আওতা বাড়ায়।
এরপর বিষয়টি দ্রুতই সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ পুলিশের নির্দেশের বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেন। বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, কর্তৃপক্ষ তীর্থস্থানমুখী রাস্তার দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত গম বা ধান যারা ফলিয়েছেন সেইসব কৃষকের পরিচয়ও চানতে চায় কি না! কারণ হিন্দু ব্যবসায়ী রামশরণ তার দোকানে মুসলমান চাষি রহমত আলীর ফলানো সবজি বিক্রি করতে পারেন।

খাবারের পবিত্রতা নিশ্চিত করতে একজন মানুষ কত দূর যেতে পারে? বিচারকদের একজন এ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি খাবারের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার জন্য হিন্দুর দোকান বাদ দিয়ে একজন মুসলমানের দোকান বেছে নেন।

শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পুলিশের বিতর্কিত নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে রুল ইস্যু করেন যে, রেস্তোরাঁর ওপর মালিকের নাম প্রদর্শনে জবরদস্তি করা যাবে না। বিচারকরা বলেন, কোনো রেস্তোরাঁয় ভেজিটেরিয়ান খাবারসহ কী ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় সেটি জানতে চাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাদেরকে মালিক ও কর্মচারীদের নাম প্রদর্শনে ‘কোনোভাবেই বল প্রয়োগ করা যাবে না’।

পুলিশ অর্ডারটি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হলেও এটি ভারতের মুসলমানদের জন্য এক পরিষ্কার বার্তা : সেটি হলো, শুধু তোমার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই এ দেশের কর্তৃপক্ষ তোমার ওপর নিপীড়নের সামান্যতম সুযোগও হাতছাড়া করবে না।

বাস্তবে, অব্যাহত মুসলিম নিপীড়নের সাথেই বাঁধা আছে বিজেপির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। তারা যদি মুসলমানদের বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে নাও পারে, তবুও তারা মুসলমানদের জীবিকার ওপর হামলা চালিয়ে তাদের নিঃস্ব করে দেবে। এসবই তারা করবে হিন্দু সমর্থকদের এটা দেখাতে যে, তারা সমাজে হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করতে লড়াই করছে।

ঠিক এ কারণেই কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য করার পাশাপাশি কোনো খাবার হালাল বলে সনদ দেয়াও নিষিদ্ধ করেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জানতে হয়, প্রাণিজ উপাদান ব্যবহার করা হয় এমন পণ্য- যেমন প্রসাধনী- হালাল কি না। ধর্মানুসারী মুসলিমের জন্য এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা যেসব ওষুধ ও প্রসাধনী ব্যবহার করেন সেগুলোতে অ্যালকোহল বা নিষিদ্ধ প্রাণীর কোনো উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে কি না।

কোনো পণ্য হালাল বলে ঘোষণা করার মধ্যে আপত্তির কী আছে? এটি তো অমুসলিমদের ধর্মীয় বিষয়ে নাক গলাচ্ছে না। এটি হিন্দুদের জীবনে কোনোভাবেই প্রভাব ফেলছে না। তাহলে কি হালাল সনদ দেখলেই বিজেপি সমর্থকদের শরীর অশুচি হয়?

মুসলমানদের জীবন আরো দুর্বিষহ করে তোলা ছাড়া হালাল সনদ নিষিদ্ধ কিংবা মুসলিম দোকান মালিকদের পরিচয় প্রকাশে জবরদস্তির কী কারণ থাকতে পারে?

ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিপীড়নের এই নতুন ধারা অনেক বিশ্লেষককে হতবুদ্ধি করেছে। তারা ভেবেছিলেন, পার্লামেন্টে শক্তি কমে যাওয়ার ফলে বিজেপি আয়নায় নিজের চেহারা দেখবে এবং শৃঙ্খলায় ফিরবে। কিন্তু দলটি আরো নির্লজ্জ এবং হিংস্র্র হয়ে উঠেছে।
মনে করা হচ্ছে, এটি হলো বিজেপির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের ফল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী পরাজয়ের দায়ভার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মতো রাজ্যের নেতাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। আর যোগী আদিত্যনাথ তার রাজ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন যে, তিনি মোদির চেয়েও মুসলমানদের প্রতি বেশি নিষ্ঠুর এবং এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; তাই নিজের পদে থাকার যোগ্যতা তার আছে। এই যুক্তির ক্ষেত্রে সম্ভবত কিছু সত্য আছে। শুধু উত্তরপ্রদেশেই নয়, বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সব রাজ্যেই দেখা যাচ্ছে, কর্তৃপক্ষ নিজেদের আরো বেশি করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে প্রমাণ করতে মুসলমানদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। দুঃখজনক হলেও, বিজেপি, এমনকি নির্বাচনে বড় বিপর্যয় ও অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের মতো ঘটনায় সুচিন্তিত শাসনের পরিবর্তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরো সহিংসতা শুরু করে।

বর্তমান ভারতে মুসলমানদের ওপর নতুন করে আক্রমণ হচ্ছে, কারণ বিজেপির আদর্শই মূলত মুসলিম ও খ্রিষ্টানবিরোধী। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা না চালিয়ে এই আদর্শ টিকতে পারে না। ভারতে মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুরা অব্যাহত আক্রমণের মুখেই থাকবে যত দিন পর্যন্ত বিজেপি একা অথবা শরিকদের নিয়ে ক্ষমতায় থাকবে।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপির ক্রমাগত সহিংসতার প্ররোচনার বাইরেও বর্তমানে আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, এই আদর্শিক প্রেরণা থেকে আক্রমণ চালানোর জন্য পুলিশ এবং বেসামরিক প্রশাসনের মতো সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই নতুন করে উদ্দীপ্ত। এসব প্রতিষ্ঠান এখন সক্রিয়ভাবে মুসলমানদের হয়রানি ও নিপীড়ন করছে। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের বাধ্য না করলেও তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। এর অর্থ হলো, ভারতে মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনে আরো তাৎক্ষণিক এবং গুরুতর হুমকির মুখোমুখি হবে।

লেখক : দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক
আলজাজিরায় গত ২৬ জুলাই প্রকাশিত নিবন্ধ। তরজমা: মুজতাহিদ ফারুকী


আরো সংবাদ



premium cement