২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আহমদ ছফা এক সত্যভাষী বুদ্ধিজীবী

আহমদ ছফা এক সত্যভাষী বুদ্ধিজীবী - ছবি : সংগৃহীত

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র এঁকেছেন। বইটিতে বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদী রূপ উন্মোচন করেন। বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক সতর্ক করতে তাদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।

ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। আদর্শনিষ্ঠ একজন সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী। তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ছিল ইতিহাসের পরিচ্ছন্নতা। ছিল গণমানুষের প্রতি অঙ্গীকার। ছিল সাহস। এই সাহস এসেছিল ইতিহাসবোধ থেকে। তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে, যে জগতে যে কোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারেন।

গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে আহমদ ছফা সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে যে উথালপাথাল ধাক্কা দিয়ে গেছেন তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া না করে অগ্রসর হওয়া বেশ কঠিন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা আমরা মেলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।

ছফার উপন্যাস ব্যক্তির মধ্যে ইতিহাসকে ও ইতিহাসে বর্তমান ব্যক্তিটিকে নিবিড় করে অনুভব করার তাগিদে পাঠক আহমদ ছফার অনুসন্ধানী অভিযানে শরিক হবেন। তার অনেক গল্প, উপন্যাস মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।

ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাস ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনীকথনের পারঙ্গম অসামান্য।

জীবিতকালে আহমদ ছফা তার প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেন।
আহমদ ছফা ৩০ জুন ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম হেদায়েত আলী। মা মরহুম আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ; একই বছরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। তবে বাংলায় তিনি পড়ালেখা শেষ করেননি। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০-এ এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগে বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন। তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামে মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭০ সালে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসাবে ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিলে কলকাতা যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে ‘দাবানল’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যাটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ‘ফাউস্ট’ অনুবাদে সহায়তা করেছিল।

আহমদ ছফা গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement