বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসে করণীয়
- অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ
- ২৮ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৮
আজ বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসঙ্ঘ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস হিসাবে ঘোষণা প্রদান করে। বৈশ্বিক পরিবেশগত গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রকৃতির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য ২৮ জুলাই বিশ্বব্যাপী দিনটি উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য, ওই দিনটি বিশ্ব ঐতিহ্য সম্মেলনের ১০ম বার্ষিকী হওয়ায় ‘প্রাকৃতিক বিস্ময়’গুলো (Natural Wonders) ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে সংরক্ষণযোগ্য হওয়ার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর, সুন্দরবন সংরক্ষণের বিষয় উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই দিবসের পালনীয়, করণীয়, শিক্ষণীয় বিষয়গুলো বৈশ্বিক প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ব্যক্তি, সামষ্টিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সামাজিক, পরিবেশীয়, জীববৈচিত্র্য এবং অর্থনীতির জন্যও প্রয়োজন।
প্রকৃতি আমাদের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রকৃতি আমাদের বাতাস, পানি, খাদ্য এবং ওষুধের উৎস। প্রকৃতির স্থানীয় পরিবর্তনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, নিবাস ধ্বংস, দূষণ বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্য বিলীন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যা সমষ্টিগতভাবে বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্কটকে ত্বরান্বিত করে।
মানুষ কী করতে পারে? যদিও মোটা দাগে দেখলে আমরা বলতে পারি মানুষই পারে প্রকৃতির যত্ন নিতে, প্রকৃতিকে রক্ষা করতে। জীব ও জড়ের সমন্বয়ে বাস্তুতন্ত্র গঠিত। মানুষ বাস্তুতন্ত্রেও একটি জীবীয় উপাদান। মাটি, বায়ু, পানি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য অবশ্য করণীয় দায়িত্ব্। বাংলাদেশ নদীমাতৃক ও কৃষিনির্ভর দেশ বলে পরিচিত। বাংলাদেশের নদী, জলাভূমি, প্লাবন ভূমিসহ সব জলাশয় ক্রম বিলুপ্তির দিকে ধাবমান। শুধু সংখ্যা নয় গুণগতভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের সব জলাশয়। প্লাস্টিক দূষণ আমাদের জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে প্রতিনিয়ত। মাছে ভাতে বাঙালি, মাছ গ্রহণের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত মাইক্রো প্লাস্টিক গ্রহণ করছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেশের স্বাদু পানির ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। মানবদেহে এই প্লাস্টিক স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে কী ক্ষতি করছে তা এখনো বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। তবে এর ফলাফল যে কখনোই ভালো কিছু নয়, তা আমরা সাধারণ জ্ঞানেই বুঝতে পারি। মাটিতে যত্রতত্র যথেচ্ছভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার ফলে জমিতে উৎপাদিত শস্য শাকসবজি ও ফলেও সঞ্চিত হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এগুলো গ্রহণের ফলে আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মাটিতে বসবাস করে বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবগোষ্ঠী। যেমন : কেঁচো। যাদের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা সংরক্ষিত ও পুনরুদ্ধার হয় আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। মাটিতে প্লাস্টিক দূষণ ছাড়াও যথেচ্ছভাবে কীটনাশক, রাসায়নিক সার, আগাছা নাশক, সাবান পানি এবং বাথরুম বা বাড়ি পরিষ্কারের রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ, শিল্পবর্জ্য মাটিতে ফেলার কারণে মাটির উর্বরতার ধ্বংস পাশাপাশি এই জীবগোষ্ঠী আমাদের দৃষ্টির অগোচরে নীরবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে।
আইকিউএয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বায়ুদূষণের মাত্রা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ, শিল্প-কলকারখানা, ইট-পোড়ানো এবং বন উজাড়ের পাশাপাশি নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দরুন বায়ুস্বাস্থ্যের মান এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর ফলে মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, ফুসফুসজনিত রোগ অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধসহ যে কোনো বয়সের মানুষ এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নবায়ন ও অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, অবিবেচক মানসিকতাপ্রসূত জীবনযাপন, যুদ্ধ, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড স্থানিক ও বৈশ্বিকভাবে আমাদের প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করে চলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষের নানা ধরনের অসুখ সৃষ্টিতেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখে থাকে। সর্বোপরি যে কোনো শ্রেণীর মানুষের অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত হওয়া তাকে বা তার পরিবারকে বাড়তি আর্থিক খরচের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে পারিবারিক আয় সীমিতকরণ ও ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিকভাবে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়।
সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমে ভূমিকা রাখা ও আলোচনার পাশাপাশি শিশু, কিশোর, কিশোরী, নবীন-প্রবীণদের নিয়ে পাঠচক্র আয়োজনের পাশাপাশি প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে আমরা আটটি কাজ করতে পারি।
ভূমিক্ষয় নিবারণে গাছ লাগানো বা বনায়ন; গণ যানবাহন ব্যবহার বৃদ্ধি; যে কোনো জায়গা ত্যাগের সময় বিদ্যুৎচালিত অপ্রয়োজনীয় সংযোগ বন্ধ করা; বিনা প্রয়োজনে কাগজের ব্যবহার কমিয়ে আনা; ব্যক্তি পর্যায়ে জৈব সার উৎপাদন; প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর পরিষ্কারক দ্রব্যাদি ব্যবহার সীমিতকরণ; স্বেচ্ছাসেবার অংশ হিসেবে প্রকৃতি পরিচ্ছন্নতা অভিযান ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রকৃতির প্রতি প্রতিনিয়ত আমরা যে অন্যায় অবিচার করি, মাত্রাহীন অত্যাচারে প্রাত্যহিক জীবনযাপন করি আজ প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসে প্রকৃতির প্রতি একটু হলেও যত্নশীল হই যাতে করে আগামী প্রজন্ম প্রকৃতির দান থেকে বঞ্চিত না হয়।
লেখক : পরিচালক, পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেল : drsabrina_naz@ru.ac.bd
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা