২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দেশপ্রেমের অন্তরালে বিদ্বেষ, বিপ্লব ও সন্ত্রাস

দেশপ্রেমের অন্তরালে বিদ্বেষ, বিপ্লব ও সন্ত্রাস - ফাইল ছবি

ভারতীয় উপমহাদেশে বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-মুসলিম দু’টি জাতি একত্রে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গ্রহণের সাথে সাথে এই বিষয়টি হিন্দু-মুসলমান-ইংরেজ তিন পক্ষের একটি দ্বন্দ্বের উৎসে পরিণত হয়। যে দ্বন্দ্বের প্রভাব উপমহাদেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে এখনো পরোক্ষভাবে লক্ষ করা যায়। ব্রিটিশ সরকার যে উদ্দেশ্যেই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করুক না কেন, এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া দু’টি জাতির ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে এবং এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

বঙ্গভঙ্গের ফলে সেকালের হিন্দু সমাজে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সে সম্পর্কে জানার জন্য প্রথমে বঙ্গভঙ্গের সময় বঙ্গের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করা যাক।

তখন বঙ্গের মোট আয়তন ছিল এক লাখ ৮৯ হাজার বর্গমাইল এবং মোট জনসংখ্যা সাত কোটি ৮৫ লাখ। এই জনসখ্যার মোট ৫৩ শতাংশ ছিল মুসলিম, ৪৩ শতাংশ হিন্দু, ১ দশমিক ৮ শতাংশ উপজাতি, ০ দশমিক ৮ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং ০ দশমিক ৩১ শতাংশ ছিল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষ ছিল কৃষক। হিন্দু ও মুসলিম জমিদারদের অনুপাত যথাক্রমে ৭ : ৩ । চাষাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম অনুপাত ৫ : ৯। তাহলে এটি স্পষ্ট যে, ১৯০৫ সালের আগে হিন্দু সমাজ ছিল সব দিকে থেকেই অগ্রসর এবং প্রভাবশালী আর মুসলিম সমাজ ছিল ভূমির সাথে লেগে থাকা অধিকার সচেতনহীন।

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। ফলে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বনেদি ও ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীরা একটি প্রভাবশালী বলয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কলকাতায় তখন কংগ্রেসের প্রধান অফিস ছিল এবং ইতঃপূর্বে ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকার সচেতন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবী শ্রেণী গড়ে ওঠে। কলকাতার এই শিক্ষিত বনেদিরা ছিল মন ও মননে ব্রিটিশ, বর্ণবাদের অনুসারী ও বিদ্বেষপরায়ণ। বিপরীতে এই কলকাতাকে ঘিরে মুসলিমদের কোনো অগ্রগতি কিংবা সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

ব্রিটিশ রাজ যখন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করে (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫), তখন স্বভাবতই আধিপত্য ও প্রভাব হারানোর ভয়ে হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই সময়ে ‘ভারত সভা’ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ‘দ্য বেংগলি’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। আরেক বিখ্যাত পত্রিকা ‘সঞ্জিবনী’র সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। সুপরিচিত পত্রিকা ‘যুগান্তরের’ সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দাস এবং ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মতিলাল ঘোষ। এসব পত্র-পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গকে ‘ভারত মাতার অঙ্গচ্ছেদ’ এবং ‘জাতীয় মহাবিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করে ব্রিটিশদের সিদ্ধান্তকে বানচাল করতে শুরু করে।

হিন্দুদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও যখন বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়ন হয়, তখন হিন্দুরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এই সিদ্ধান্ত ঠেকাতে। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এর একটি শাখা ব্রিটিশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। তারা ঢাকায় গড়ে তোলে অনুশীলন সমিতি নামে সন্ত্রাসী সংগঠন এবং কলকাতায় যুগান্তর সমিতি। এর মধ্যে পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হলে ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং ঢাকার প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার ফুলার। ফুলার ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের একজন দক্ষ অফিসার ছিলেন। তার হাত ধরে ঢাকায় ব্যাপক উন্নয়নকার্যক্রম শুরু হয়।
এর মধ্যে বিপ্লবী সন্ত্রাসীরা তাদের ধর্মগ্রন্থ গীতা স্পর্শ করে দেবী কালীর নামে শপথ নিয়ে বলির পাঁঠার রক্ত বুকে ও কপালে ধারণ করে ইংরেজ অফিসার ও পুলিশ সদস্যদের হত্যা করতে শুরু করে। এসব কাজে আগুনে ঘি ঢালার মতো উৎসাহ দেয় হিন্দু সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ। দুই বাংলাকে এক শাসনে রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন, ‘মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। শুরু হয় রাখি বন্ধন, গঙ্গা স্নান ইত্যাদি। অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা লেখা ও প্রচার হতে শুরু করে।
ফলে চারদিকে বিস্ফোরণ, বোমাবাজি ও হত্যার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ঢাকার গভর্নর স্যার ফুলারকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা করে বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়লে ফাঁসি হয়।

বিপ্লবী রাসবিহারি বসুর আক্রমণে লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রাণে বেঁচে গেলেও এই রকম সন্ত্রাসী আক্রমণ বন্ধ করতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার।

পুরো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধু একক বাংলার নামে মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলার অগ্রগতি স্তব্ধ করে দেয়া। ব্রাহ্মণ সমাজের এই মরাকান্না ইংরেজদের তেমন পছন্দ হয়নি বলে ব্রিটিশ সরকারের মন গলেনি। চারদিকে ব্যাপক ধরপাকড় চালায় ইংরেজ পুলিশ। তা সত্ত্বেও বিদ্রোহীদের কার্যক্রম থেমে থাকেনি। বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলেছে।
এদিকে গভর্নর ফুলার ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ঢাকার নবাব পরিবারসহ সব স্তরের নাগরিক এতে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা প্রকাশ করে। ঢাকায় ইংরেজ প্রতিনিধির থাকার জন্য একটি বাসভবনও ছিল না এবং কোনো সরকারি অফিস আদালত তখন কিছুই ছিল না। নবাববাড়ি থেকে কিছু প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। প্রথমেই ফুলার জমি অধিগ্রহণ শুরু করেন এবং নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ঢাকার জন্য জমি দান করেন। দুই দফায় মোট এক হাজার ৫০৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে নবাব পরিবারের জমি ছিল আজকের মতিঝিল, গুলিস্তান, শাহবাগ, রমনা, আজিমপুর ও চিশতিয়া মৌজা।

জমি অধিগ্রহণের পর গভর্নর হাউজ, সেক্রেটারিয়েট অফিস ও রাষ্ট্রীয় প্রধানের বাসভবনের (ব্রিটিশ ভাইসরয়) জন্য নির্মিত হয়। রমনার উত্তর অংশে আটটি বিভাগীয় প্রধান অফিসারের জন্য নির্মাণ করা হয় অফিস ও বাসস্থান। পূর্ব বাংলার সরকারি অফিসারদের জন্য আজিমপুরে ১০১ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের জন্য বাসভবন। ফুলারের কীর্তি আজো বহন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ফুলার রোড। এভাবে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্তরণ ঘটে।
নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে পূর্ব বাংলার আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, যোগাযোগ ও শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রযাত্রা শুরু হয়। বঙ্গভঙ্গের আগে পূর্ব বাংলায় মাত্র তিনটি কলেজ ছিল (ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ)। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলায় তখনো ৩৪টি কলেজ এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় রংপুরে কারমাইকেল কলেজ, পাবনায় এডওয়ার্ড কলেজ ও ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় এবং এসব কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ফুলারের আমলে পূর্ব বাংলায় ৪৮৮টি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় এবং তিনি শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে দেন। সরকারি চাকরিতে ফুলার পূর্ব বাংলার মুসলমানদের জন্য ৩৭ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফুলারের পর গভর্নর হয়ে আসেন চার্লস বেইলি ও হেয়ার। তিনজন ইংরেজ গভর্নরের হাত ধরে ও ঢাকার নবাব ও মুসলমান জমিদারদের বদান্যতায় ঢাকায় পূর্ব বাংলার মানুষের অগ্রযাত্রার ভিত শুরু হয়।

যোগাযোগব্যবস্থায় শুরু হয় ব্যাপক গতিশীলতা। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়েকে বাড়িয়ে ২০০ মাইল রেলপথ তৈরি হয় এবং দুই হাজার মাইল সড়কপথ, ২৭টি নৌ-থানা ও চাঁদপুর-কলকাতা-বরিশাল স্টিমার চলাচলকে আরো বেগবান করা হয়। আর বন্দরনগরী হিসেবে চট্টগ্রামের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। এই বন্দর দিয়ে চা, পাট, তামাক ও বস্ত্র নিয়ে ইংরেজরা সারা বিশ্বে বাণিজ্য করেছে এবং এই বন্দর ধীরে ধীরে হুগলি বন্দরকে অতিক্রম করতে শুরু করে।

সব দিক থেকে ঢাকার উত্থান ও পূর্ব বাংলার চাষাভূষাদের অগ্রগতিকে ওপার বাংলার বনেদি হিন্দুরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। না মানার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা হয় সেগুলো হলো-
ক্স ঢাকার উত্থানে জব চার্নকের প্রতিষ্ঠিত জমকালো কলকাতা নগরীর গুরুত্ব কমে যাওয়া।

ক্স ওপার বাংলার উকিলরা মক্কেল হারানোর ভয় পায়।
ক্স সংবাদপত্রগুলো পাঠক হারাবে।
ক্স ওপার বাংলার সাহিত্য অবহেলায় দিন কাটাবে।
ক্স পূর্ব বাংলার হিন্দু জমিদাররা আধিপত্য হারাবে।
ক্স ওপার বাংলার পাটশিল্পে ধস নেমে এপার বাংলায় তা বৃদ্ধি পাবে। কারণ, পাটশিল্পের কাঁচামাল যেত পূর্ব বাংলা থেকে।
ক্স হুগলি বন্দরের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যাবে।
ক্স পূর্ব বাংলায় বস্ত্র ও পাটশিল্পকে ঘিরে অনেক শিল্প ও কলকারখানা গড়ে উঠবে।

তাই বঙ্গভঙ্গ রদ করতে চারদিকে বিপ্লবীরা ইংরেজ অফিসার ও পুলিশ হত্যায় মেতে ওঠে। পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাস্টারদা সূর্যসেন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এপার বাংলার মানুষের বোকামির ফলে এই দু’জন বাংলাদেশে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে।

তীব্র বিরোধিতা ও মারাত্মক আত্মঘাতী-সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। এর মধ্যেই স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন জোরদার হয় এবং মুসলমানরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ও রাজনৈতিক স্বার্থে ধীরে ধীরে মুসলিম লীগকে আপন করে নেয়। দুই বাংলার একত্রিত শক্তি নষ্ট করতে এবং ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতির চূড়ান্ত বাস্তবায়ন হয় কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে। অথচ বাংলা থেকে রাজধানী সুদূর দিল্লি চলে গেলেও হিন্দুত্ববাদী নেতারা খুশি হয়েছেন শুধু বঙ্গভঙ্গ রদ করায়।

উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্য ধর্মাবলম্বী তথা মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে সর্বপ্রথম সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয় হিন্দুদের হাত ধরে। অথচ তা দেশপ্রেমের আখ্যান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে নানা রূপে ও নানা পরিক্রমায়।


আরো সংবাদ



premium cement