২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

উদ্বাস্তু জীবন মানবতার পরাজয়

উদ্বাস্তু জীবন মানবতার পরাজয় - ফাইল ছবি

বর্তমানে বিশ্বে ১২ কোটির বেশি মানুষ শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত। ২০২৩-এর শেষে এ সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৭৩ লাখ, যা ২০২৪-এর এপ্রিল শেষে আরো বেড়ে প্রায় ১২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছেই। এটি জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশনার ফর রিফিউজির (ইউএনএইচসিআর) গত ১৩ জুন প্রকাশিত রিপোর্টের তথ্য।

সংস্থার উদ্যোগে শরণার্থীদের অধিকার রক্ষায় প্রতি বছর ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়। এবারো হয়েছে। সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু হয়েছে সিরিয়ার লোকজন। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সিরিয়ার এক কোটি ৩৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। এর মধ্যে ৬০ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে দেশ ছেড়েছে। আর ৭৮ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে দেশের ভেতরেই বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। আফগানিস্তানে উদ্বাস্তু হয়েছে ২৫ লাখ মানুষ। দক্ষিণ সুদানে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১৪ লাখ। আর ৬০ লাখ ফিলিস্তিনি বর্তমানে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন। এসব উদ্বাস্তু বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

সুদানে ২০২৩ সালে শুরু হওয়া দুই জেনারেলের দ্বন্দ্বে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তার মধ্যে ছয় লাখ প্রতিবেশী দেশ চাদে আশ্রয় নিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ৩৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কঙ্গো এবং মিয়ানমারে নতুন করে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধে কয়েক লাখ মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দানকারী শীর্ষ ১০টি দেশ হচ্ছে তুরস্ক, জর্দান, কলম্বিয়া, লেবানন, উগান্ডা, জার্মানি, পাকিস্তান, ইরান, সুদান ও বাংলাদেশ। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু রয়েছে তুরস্কের আশ্রয়ে। মোট উদ্বাস্তুর মধ্যে তুরস্কে ৩০ লাখ, জর্দানে ২৩ লাখ, কলম্বিয়ায় ১৭ লাখ, লেবাননে ১৫ লাখ, উগান্ডায় ১৪ লাখ, জার্মানিতে ১২ লাখ, পাকিস্তানে ১৪ লাখ, ইরানে ১০ লাখ, সুদানে ১০ লাখ এবং বাংলাদেশে ১২ লাখ বসবাস করছে। বর্তমান বিশে^ প্রতি ৬৭ জন মানুষের একজন আজ এই পরিস্থিতির শিকার। যুদ্ধ সঙ্ঘাতই এসব মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। উদ্বাস্তুরা আজ গোটা মানবজাতির জন্য লজ্জা ছাড়া কিছু নয়। উদ্বাস্তু জীবন মানবতারই পরাজয়।

নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে, নিজ দেশ ছেড়ে অনেক মানুষ আজ ভিনদেশের আশ্রয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। ভিনদেশে প্রবেশের জন্য এসব মানুষ কখনো পাড়ি দিয়েছে সাগরের উত্তাল জলরাশি, কখনো পাড়ি দিয়েছে পাহাড়ি জঙ্গলের কণ্টকাকীর্ণ পথ আবার কখনো পাড়ি দিয়েছে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। আর যারা দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত ওরাও এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে পাড়ি দিয়েছে কষ্টকর এক পরিক্রমা। তারা রোদে পুড়ছেন, বৃষ্টিতে ভিজছেন আর রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছেন। ভয়ঙ্কর এবং বিপদসঙ্কুুল এই যাত্রাপথে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ। বাঁচার তাগিদে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়ে সাগর তীরে পড়ে থাকা সিরিয়ার শিশু আয়লানের লাশ তার জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। যাদের এক সময় অর্থ-বিত্ত-আভিজাত্য সবই ছিল, তাদের আজ বেঁচে থাকার মৌলিক কোনো উপাদানই নেই। তারা আজ তাঁবুর ঘরে বাস করছে। কেউ বা সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নিচে। এদের জীবনে অন্ন বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কিছুই নেই। এদের জীবনে আজ সুখ, আনন্দ আর শান্তি বলতে কিছু নেই। জীবনে কোনো স্বপ্ন এবং সুন্দর ভবিষ্যতের আলো নেই। শুধু প্রাণ আছে বলেই ওরা বেঁচে আছে। যুদ্ধ ও সংঘাত আজ কোটি মানুষের জীবন শেষ করে দিয়েছে। এসব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে আজ সবাই ব্যর্থ। জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি, আরব লিগ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আসিয়ান, সার্ক, আফ্রিকান ইউনিয়ন, জি-সেভেনসহ সবাই ব্যর্থ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীনও ব্যর্থ। ব্যর্থ পুরো মানবজাতি এবং ব্যর্থ মানবাধিকারের প্রবক্তারা। এই ব্যর্থতা পুরো মানবজাতি এবং মানবতার।

বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থহীন ও আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে উদ্বাস্তুরা আজ শুধু বাঁচার তাগিদে আপন ঘরবাড়ি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ, প্রিয়জন এবং প্রিয় দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছে। আবার অনেকেই নিজ দেশের উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছেন। তারা আজ উদ্বাস্তু এবং তাদের পরিচয় আজ শরণার্থী। ওদের আজ কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, উপার্জন নেই, ঘরবাড়ি নেই, সহায়-সম্পদ নেই। অন্যের দেয়া ত্রাণে ওরা শরণার্থী শিবিরে আজ কোনো রকমে বেঁচে আছে। তাদের জীবনে আজ এই বিপর্যয়, গোটা মানবজাতিরই বিপর্যয়। তাদের জীবনের এই সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা এবং লাঞ্ছনার জন্য আমরা সবাই দায়ী। দায়ী বৃহৎ শক্তিবর্গ যারা এই পৃথিবীর হর্তাকর্তা, যারা এই পৃথিবী শাসন করছে।

প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছে। অর্ধ কোটিরও বেশি ফিলিস্তিনি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছেন। অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরেই জন্মগ্রহণ করেছেন, শরণার্থী শিবিরেই বড় হয়েছেন এবং শরণার্থী শিবিরেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু বিশ^ নেতারা এই সমস্যার সমাধান করেনি।

আফগানিস্তানে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে। কয়েক লাখ আফগান দীর্ঘদিন থেকেই শরণার্থী। তারাও শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছেন। তাদের সমস্যা সমাধানেও বিশ^নেতারা এগিয়ে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের ইরাকে হামলা, প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে হত্যা করা এবং পরবর্তীতে সেখানে বিভিন্ন গ্রুপের দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতে অনেক ইরাকি বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে আছে রাশিয়া, চীন, ইরান, হিজবুল্লাহসহ পশ্চিমাবিরোধী শক্তি। আর আসাদবিরোধী পক্ষকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সৌদি আরব, তুরস্ক, কুয়েত, কাতারসহ পশ্চিমা শক্তি। আর এই দুই জোটের স্বার্থ হাসিলের দ্বন্দ্বে পিষ্ট হয়েছে সিরিয়ার নিরাপরাধ মানুষ। এ পর্যন্ত এ যুদ্ধে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে আর ৬০ লাখ সিরিয়ান বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হয়েছে। আর নিজ দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করছে ৭৮ লাখ মানুষ।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধুর স্বপ্ন দেখিয়ে লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে মোহাম্মদ গাদ্দাফিকে উৎখাতে পশ্চিমারা বিমান হামলা করে। ছয় মাস ধরে অবিরাম বিমান হামলা করে পশ্চিমারা লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে গাদ্দাফিকে উৎখাত এবং হত্যা করে। কিন্তু লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি; বরং গৃহযুদ্ধে লিবিয়া আজ কয়েক খণ্ডে বিভক্ত। লিবিয়া আজ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ। বাঁচার তাগিদে লিবিয়ার মানুষ আজ নৌকায় সাগর পাড়ি দিচ্ছে আর অন্য দেশে গিয়ে উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করছে। ইয়েমেনেও দীর্ঘদিন ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে। সে দেশেও হাজারো মানুষ আজ বাঁচার তাগিদে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে এবং অনেক মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারাও শরণার্থী হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে বহু রোহিঙ্গা মুসলমান বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছে। বর্তমানে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে এবং হচ্ছে।

মানবজাতির এই যে দুর্দশার চিত্র, তা সবই শিক্ষিত এবং সভ্য লোকদের কারণেই সৃষ্ট। তাদের সৃষ্ট যুদ্ধেই মানবজাতির ক্ষতি হচ্ছে।

অস্ত্র ব্যবসায়ীরা যুদ্ধরত দুই পক্ষকেই অস্ত্র দেয়। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না করে, যুদ্ধরত দুই পক্ষকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। আর যুদ্ধরত দেশগুলো হয়ে উঠেছে অন্যদের দাবা খেলার স্থান। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা তো মানবজাতির জন্য কিছুই হতে পারে না।

বিশ্বে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে। আত্মঘাতী এবং অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে মানবতাকে বাঁচাতে হবে। উদ্বাস্তুদের নিজ দেশে, নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই বাঁচবে মানবতা, বাঁচবে গোটা বিশ্ব।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement