০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

আর কত দেখব

আর কত দেখব - ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ায় বেশ কিছু আশ্চর্যজনক সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। যার বেশির ভাগ দেশের কিছু রাঘববোয়ালের দুর্নীতির খবর। যে অপকর্মের ফিরিস্তি ক্রমে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় আমলাদের প্রতি গণমানুষের আস্থাহীনতাও বাড়ছে; যারা মানুষকে অসহায় করে এই অবৈধ ধন-সম্পদ ও অট্টালিকার পাহাড় গড়েছেন। নষ্ট করেছেন দেশের লাখো মানুষের ন্যায্য অধিকার।

মজার বিষয়, চাকরি জীবনের অবসরে তাদের এ কুকীর্তির খবর বেরিয়ে এলো। জনমনে প্রশ্ন, তাহলে যারা এখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শীর্ষ পদে আসীন তাদের অবস্থা কী? এটি সহজে অনুমেয়, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি বড় অংশ দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে গেছে। কিছু আমলা বেপরোয়াভাবে সরকারি অফিসে অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েও যাচ্ছেন। থেমে নেই অসৎ পেশাজীবীরাও। পেশিশক্তির দাপট দেখিয়ে যে যেভাবে পারছেন কামিয়ে নিচ্ছেন। সবাই যখন অনিয়মে ব্যস্ত দুর্নীতিবাজ টেন্ডারবাজদের কি ই-বা দোষ (?)। তাই তো তারাও ঠিকাদারির নামে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছেন। জনগণের পকেট থেকে আসা লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে, মেয়াদ শেষ না হতে ওই সব রাস্তা মানুষের চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। রিপেয়ারিংয়ের কাজেও চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি।

ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউর। আলোচিত-সমালোচিত দুই জাঁদরেল অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা একজন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, অন্যজন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। সর্বশেষ চমকে দেয়ার মতো খবরটি- পিএসসির সাবেক ড্রাইভার আবেদ আলী, যিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্রের প্রধান। একা তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। ইতোমধ্যে যে অপকর্মের খবর জাতির কাছে প্রকাশিত হয়েছে এসব দুর্নীতিবাজ মানুষের কর্মকালে হয়তো তা কল্পনাও করা যেত না। এরকম হাজারো দুর্নীতিবাজ ও অশুচি স্বভাবের অধিকারী আমলা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আবেদ আলীর কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, তোমার কত টাকার প্রয়োজন? আপনি যে সম্পদ গড়েছেন তাতে আপনার পাঁচ পুরুষ খেয়েও শেষ করতে পারবে না। আপনাদের মতো আবেদরা কেন সম্পদ গড়ার এ অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন? বেশভূষায় ধার্মিক বলে মনে হলেও আপনার আসল পরিচয়টি ছিল বড়ই কদর্জপূর্ণ। আসলে আপনি একজন বকধার্মিক। আপনাকে যারা ধার্মিক বলে মনে করেন তাদেরও ধর্ম বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শিতার অভাব আছে।

আপনাকে ছোট করার চেষ্টা করছি না। আপনার কর্মকাণ্ড ঘৃণার চোখে দেখছি। প্রথম জীবনে ছিলেন মুটে, এরপর হলেন রিকশাচালক। ভুয়া তথ্য দিয়ে হয়ে গেলেন পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক। একজন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক কিভাবে এত টাকার মালিক হয়- এ সরল প্রশ্ন যাদের মাথায় আসে না, তারা তো ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচারও করেন না। আবেদ আলীর মতো মানুষের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে দান-খয়রাত তাকে দানবীর প্রমাণ করতে পারেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে মানুষের দুর্দিনের কষ্ট ও অভাব অনটনের আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে মানুষের নজর কাড়তে পারেন। কিন্তু দান-খয়রাতের যে আসল উদ্দেশ্য তা কখনো অর্জিত হতে পারে না। সবসময় আমরা কেন জানি সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে শুরুতে সমস্যাটি শেষ করে দিতে চাই। আবেদ আলীকে ধরা হলো। তার কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গর নামও জানা গেল। প্রশ্ন ফাঁসের মতো জটিল বিষয়টি কি শুধু আবেদ আলীর মতো মানুষের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে এর কুশীলব কারা? সে পরিচয়ও জাতির জানা দরকার। এটিও জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। কিভাবে একজন গাড়িচালক রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ হতে পারেন? তাদের সাথে আবেদ আলীর কী সম্পর্ক?

সামাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আবেদ আলীর মতো বহু মানুষ লুকিয়ে আছে। অফিসের সামান্য কেরানি হয়েও আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার কোনো কমতি নেই। এগুলো দিনের আলোতে আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। রাষ্ট্রযন্ত্রের কি কোনো দায় নেই, এই অসৎ মানুষদের বিকাশের পথ রোধ করার?
বাস্তবতা হলো- আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন হাজারো নেতা, উপনেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রয়েছেন যারা সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কেউ কোটিপতি বনে গেছেন। বাড়ি-গাড়ি ও অঢেল সম্পতির মালিক হয়েছেন। তাদের অপকর্মের ফিরিস্তিও মানুষের অজানা নয়। আবার সমাজে এমন কিছু রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও আমলা রয়েছেন যাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। যারা সত্যিকার অর্থে মানবসেবায় নিয়োজিত। রাজনীতি ও সেবার ব্রত নিয়ে মানুষের স্বার্থে কাজ করে চলেছেন।
সময়ের পালাবদলে যারা এভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন তাদের এ ফোলার নীতি রোধ করা না গেলে জাতি এমন একটি করুণ সময়ে গিয়ে দাঁড়াবে, চোরকে আর চোর বলা যাবে না। এটিকে তখন তারা নিজের দক্ষতার ফসল হিসেবে দাঁড় করাবে।

আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা সীমিত আয়ের হয়েও আলীশান বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের জীবনাচরণ মানুষকে প্ররোচিত করে। সৎ ও নিষ্ঠার অনুশীলন থেকে মানুষকে সরিয়ে দেয়। এদের দ্বারা সমাজে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এসব মানুষ অন্যায়ের সাথে বসবাস করেও যখন নিজেদের সচ্ছলতা জানান দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব জায়গায় নিজেদের দানবীর পরিচয় দেন, এতে সমাজের সৎ মানুষ কষ্ট পান। জনগণের সঙ্ঘবদ্ধ মানসিকতাও এদের অপকর্মকে রুখে দেয়া যায়। কিন্তু এমন দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে সাধারণত আমরা এগিয়ে যাই না বা এটিকে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করি না। রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে এর দায় আমরা কখনো এড়াতে পারি না। যদি আমরা দায়িত্বশীল হতাম, তাহলে কিছু সিলেক্টেড মানুষের হাতে সমাজ অসহায় হয়ে পড়ত না। সমাজে প্রভাব পড়ত না বেনজীর, মতিউর ও আবেদ আলীর মতো মানুষের।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement