২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘গণিমতের মাল ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা’

‘গণিমতের মাল ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ - ফাইল ছবি

(লেখাটি ২০ জুলাই, ২০২৪ তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে)
ধর্মযুদ্ধ বা হক-বাতিলের লড়াইয়ে বিজয় লাভের পর বিজয়ী ঈমানদাররা বিজিতদের থেকে যে সম্পদ লাভ করে মূলত সেটিই ‘মালে গণিমত’ বা গণিমতের মাল হিসেবে পরিচিত। অন্য কথায় রণক্ষেত্রে বিজয়ী হওয়ার পর যুদ্ধের ময়দানে পরিত্যক্ত সম্পদ মুসলিম সম্প্রদায়ের হস্তগত হলে তাকে গণিমত বলে। যুদ্ধাস্ত্র, খাদ্যসামগ্রী, যানবাহন, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সবই গণিমতের মালের অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র যুদ্ধের ময়দানেই তাৎক্ষণিকভাবে গণিমতের মাল বণ্টন করে দেয়া হতো এবং এই বিলি-বণ্টন ছিল শুধু একবারের জন্য। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে এর প্রাপ্য অংশ সন্তান-সন্ততি কিংবা নাতি-পুতি বা পরবর্তী ওয়ারিশদের জন্য সংরক্ষিত হতো না। অন্য দিকে উত্তরাধিকারের সম্পত্তি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়, যা পবিত্র কুরআনে সূরা আন-নিসায় বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে।

জিহাদে বিজয়ীদের রাষ্ট্র পরিচালনায় দেয়া হতো না কোনো প্রকারের অগ্রাধিকার বা প্রাধান্য। যদি স্বীয় মেধা ও যোগ্যতায় কেউ কোনো পদ-পদবি বা দায়িত্ব পেয়ে যেতেন সেটি ছিল ভিন্ন প্রসঙ্গ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও প্রশাসনিক পদগুলো বণ্টিত হতো সম্পূর্ণরূপে মেধা, কর্মদক্ষতা ও সততার ওপর ভিত্তি করে। সব ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেত ব্যক্তির ঈমানদারি ও ন্যায়পরায়ণতা, ছিল না কোনো প্রকারের স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ইসলামের ইতিহাসে হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: সবচেয়ে বেশিসংখ্যক যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং সব যুদ্ধেই জয়লাভ করে বীরদর্পে মুসলিম শিবিরে ফেরত আসেন। বদৌলতে পেয়েছিলেন তার রণকৌশল ও বীরত্বের প্রতি সম্মাননা এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। তারা যুদ্ধ করতেন ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, মহান আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি আনুগত্য থেকে। ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া তাদের মোহাচ্ছন্ন করতে পারত না। তাদের পরিবার বা ওয়ারিশরা ভবিষ্যতে কী পাবে, আর কী হারাবে সেটি তাদের ভাবনায়ও থাকত না। তা না হলে হানযালা রা: বাসর রাতে নববধূকে বাড়িতে রেখে জিহাদের ময়দানে গিয়ে শহীদ হতেন না।

পক্ষান্তরে বর্তমান জমানায় জিহাদের ছদ্মাবরণে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনে কর্মসূচি ঘোষণার আগেই অঙ্গীকার করতে হয়, আন্দোলন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এলে বিরোধী জোটের নেতা-নেত্রীরা কে কোন মন্ত্রণালয় পাবে। এমনকি ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েও কোয়ালিশন সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে দ্বিধাবোধ করে না জোটের কোনো নেতা বা দল। এ ধরনের মুভমেন্ট বা কার্যকলাপ কখনোই জিহাদ হতে পারে না। খোলাফায়ে রাশেদিনরা কখনো এমনটি করেননি।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা:, হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব রা:, হজরত ওসমান ইবনে আফফান রা: ও হজরত আলী ইবনে আব্বাস রা:-দের ইসলামী খিলাফত দেয়া হয়েছিল তাদের সত্যবাদিতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা, বিনয় ও বীরত্বে গাঁথা মালা দেখে। সর্বোপরি মেধা ও কর্মদক্ষতা তো ছিলই। বস্তুত তাদের এসব গুণের কারণেই ইসলামের অতি সূচনালগ্নে তাদের খিলাফতকাল পেয়েছিল ইসলামের স্বর্ণযুগের খ্যাতি। মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসই ছিল কর্মক্ষেত্রে তাদের মূল চালিকাশক্তি। রাসূল সা:-এর দিকনির্দেশনাই ছিল তাদের পাথেয়। পবিত্র রমজান মাসের ১৭ তারিখে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ বিজয়ী হয়েছিলেন বিপুল সমরাস্ত্রসজ্জিত ১০ হাজার কাফের-মুশরিকের বিরুদ্ধে। এ সাফল্যের নেপথ্যে ছিল তাদের ঈমানি দৃঢ়তা এবং মহান আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। পক্ষান্তরে, বর্তমান যুগে আমরা ইসলামের চিরচেনা শত্রুদের দ্বারস্থ হই কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়া কিংবা কুক্ষিগত রাখার উদ্দেশ্যে। ইসলামের স্বর্ণযুগে যেসব সাহাবা রা: যুদ্ধে জয়ী হতেন তাদের গণিমতের সুবিধা দেয়া হলেও দেয়া হতো না রাষ্ট্রীয় অন্য কোনো বিশেষ ভাতা বা সুবিধা; যদিও এগুলো খারাপ কিছু নয়। সময়ের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতেই পারে যদি না সেটি ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়।

পবিত্র কুরআনে ‘আনফাল’ নামে একটি সূরা আছে যার অর্থ গণিমত। সূরাটির মূল বিষয়বস্তু ছিল বদর যুদ্ধ এবং যুদ্ধে বিজয় লাভের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও তার বিলিবণ্টন সম্পর্কিত। সূরাটিতে আরো বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে বদরের যুদ্ধ চলাকালে ওই সব কাফির-মুশরিক ও আহলে কিতাবধারীর অশুভ পরিণতি, তাদের পরাজয় ও অকৃতকার্যতা এবং তাদের মোকাবেলায় মুসলমানদের কৃতকার্যতা সম্পর্কে। মূলত এটি ছিল ঈমানদার মুসলমানদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত করুণাবিশেষ। পক্ষান্তরে, অবিশ্বাসীদের জন্য ছিল আজাব ও প্রতিশোধস্বরূপ। সূরা আনফালের ৪১ নং আয়াতে গণিমতের মাল বণ্টন সম্পর্কে মহান আল্লাহর সতর্কবাণী এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর জেনে রেখো! যুদ্ধে যা কিছু তোমরা (গণিমত হিসেবে) লাভ করো, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তাঁর রাসূলের, রাসূলের নিকটাত্মীয়, পিতৃহীন এতিম, দরিদ্র এবং পথচারীদের জন্য। যদি তোমরা আল্লাহ ও সেই জিনিসে (ঐশী বাণী) বিশ্বাসী হও, যা ফয়সালার দিন (বদর প্রান্তরে) আমি আমার বান্দার প্রতি নাজিল করেছিলাম; যে দিন দুই দল (মুসলিম ও কাফের-মুশরিক) পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। আর আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।’ অতএব, গণিমতের মাল বণ্টনের ফয়সালা ইসলামের সূচনালগ্নেই হয়ে গেছে। উপরন্তু, আসমানি প্রত্যাদেশ আগমনের ধারাটিও শেষ। ফলে কুরআনের কোনো সূরা বা আয়াতের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জনের সুযোগও শেষ। পরিশেষে, ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবনব্যবস্থা এবং মহান আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন (সূরা মায়িদা, আয়াত-২ অনুসারে)। সুতরাং, গণিমত নিয়ে নতুন কোনো ফতোয়া টানা মানেই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা, যা মহান আল্লাহর প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শামিল।

অন্য দিকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা এমন কোনো আসমানি প্রত্যাদেশ নয় যে, এর যুগোপযোগী সংস্কার সাধনে আল্লাহর আদেশকে অগ্রাহ্য করা হবে, যেটা হতো মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে উপেক্ষা করে গণিমতের মাল বণ্টন সংক্রান্ত মানব রচিত কোনো আইন নতুন করে প্রণয়ন করলে অথবা রাষ্ট্রীয় সংবিধানে সেটি সংযোজন করলে। বিভিন্ন চাকরিতে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা মূলত আমাদের মহান সংবিধানসিদ্ধ ও স্বীকৃত একটি পদ্ধতিগত সুবিধা যা স্বাধীনতার পর থেকে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমাদের দেশসহ বর্তমানে বিশ্বের সব দেশের সংবিধানসমূহ মানব রচিত, যদিও মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও কোথাও মদিনা সনদের দোহাই দেয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধান আজ পর্যন্ত মোট ১৫ বার সংশোধিত হয়েছে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত ফয়সালাটি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রহিত করা হয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীটিও বাতিল করা হয়েছিল মুন সিনেমা হল মালিকের দায়ের করা এক রিট পিটিশনকে কেন্দ্র করে। কাজেই জাতীয় স্বার্থে নেসেসিটি অব ডকট্রিন অনুসরণে অনেক কিছুই সম্ভব।

চাকরিপ্রত্যাশী ছাত্র-ছাত্রীরা ২০১৮ সালে সংবিধানে রক্ষিত ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চায়নি। তারা চেয়েছিল কোটা পদ্ধতির যুগোপযোগী সংস্কার সাধন যা মূলত সময়ের দাবি। তাই সরকারি উদ্যোগে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা, আইন বিশারদরা, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর চৌকস উপদেষ্টারা খোলা মনে এক জায়গায় বসলে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো না কোনো সমাধান বের হয়ে আসবে। দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা সংবিধানের আওতায় সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে সরকার ও জনগণকে এক দর্শনে নিয়ে আসতে পারেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তিনটি অঙ্গ- ১. আইন বিভাগ (জাতীয় সংসদ); ২. নির্বাহী বিভাগ (সরকার ও প্রশাসন) ও ৩. বিচার বিভাগ (কোর্ট-কাচারি) সমন্বিতভাবে কাজ করলে বিষয়টির সমাধান অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। জাতীয় স্বার্থে এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে পরাশক্তিসহ আঞ্চলিক সুপার পাওয়ারগুলোও সরকারকে সমীহ করে চলে। অটুট থাকে জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। জনগণের চাওয়া-পাওয়াগুলোর হয় যথাযথ বাস্তবায়ন। আর স্থিতিশীল রাজনীতির ময়দানে এগিয়ে চলে দেশীয় উন্নয়ন।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement