২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কোটা সাংবিধানিক না রাজনৈতিক

কোটা সাংবিধানিক না রাজনৈতিক - ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯(৩) (ক) ধারায় বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই, নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেরূপ যে কোনো শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না। রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগদানের জন্য এই দু’টি বিধান বা কোটা প্রচলন আছে। এখানে দেশের অনগ্রসর শ্রেণী, অঞ্চল, ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত শ্রেণী অথবা কর্মে নারী-পুরুষের প্রকৃতি ভেদে মোট চারটি কোটা প্রণয়ন করা যাবে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করতে পারবে না। এই অংশগুলো হলো কোটার বিধান। এর বাইরে অন্য যে কোনো কোটা আমাদের সংবিধানের লঙ্ঘন।

অন্য দিকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ২৬(১)-এ বলা হয়েছে, এই বিধানাবলীর সাথে অসামঞ্জস্য সব প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হতে সে সব আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে, (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সাথে অসমঞ্জস কোন আইন তৈরি করতে পারবে না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা এই ভাগের বিধানের সাথে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারবে না, (২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হবে না কিংবা সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্নভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে বিতর্কিত কোটা তৈরি করছে। সংবিধানে বর্ণিত কোটার যে বিধান তাতে কোটার পরিমাণ কোনোভাবেই ১০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রের সব নিয়োগই মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। কিন্তু সরকার যে কোটা করেছে তাতে মেধাবীরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। এটিকে কেবল স্পর্শকাতর ইস্যু তৈরির কৌশলে পরিণত করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা বা নারীরা আমাদের সমাজের কোনো অনগ্রসর শ্রেণী নয়। তারা সমাজের সব স্তরে বিরাজ করছে। মুক্তিযোদ্ধা বা নারীর জন্য কোটা প্রণয়নের বিধান আমাদের সংবিধানে নেই। এখানে সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’ সংক্রান্ত ২৯ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত কোথাও মুক্তিযোদ্ধা বা নারীদের কোনো কোটার বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু সরকারগুলো গায়ের জোরে ১৪২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে এই অপকর্মগুলো দেদারছে করে যাচ্ছে।

মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত কোনো বিধান অন্য অধ্যায়ের বিধান দ্বারা রহিত করা যায় না। তা ছাড়া এই বিধান প্রণয়নকালে ৭০ অনুচ্ছেদ চালু থাকা অবস্থায় কোনো এমপি বিপক্ষে ভোট দিতে পারে না। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে সহজেই বিল পাস করা যায়। ক্ষমতাসীন মহলের সব এমপি যে এই মত সমর্থন করেন তা কিন্তু নয়।

এ ধরনের কুপ্রথার কারণে মেধাবী ছাত্ররা আজ বৈষম্যের শিকার। তারা আজ রাস্তায় নেমেছে। একইভাবে ২০১৮ সালে তারা রাস্তায় নেমে দাবি আদায় করেছে। মানুষের যখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন তারা শেষ পদক্ষেপ হিসাবে রাস্তায় নামে। এর মধ্যে কিছু কিছু স্পর্শকাতর বিষয় আছে যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা ও নারী হলো এমনই ইস্যু। এই সুযোগে সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করছে। এতে করে দেশের অবস্থা এখন নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কথায় কথায় যদি রোগীকে স্টেরয়েড বা এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় তা হলে রোগীর বারটা বাজে। দেশের অবস্থাও তাই। অনুচ্ছেদ ২৬(২) অনুসারে রাষ্ট্র মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো আইন বা বিধান তৈরি করতে পারবে না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বিভিন্ন নামে-বেনামে ৫৬ শতাংশ কোটার প্রথা চালু করেছে সরকার।

মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এখন ফুলে ফেঁপে বিস্তার লাভ করেছে। এক সময় মুক্তিযোদ্ধা, পরে সন্তান-সন্তুতি, আরো পরে পোষ্য এভাবেই তাদের ডালপালা বিস্তার করছে। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র এখন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। যার ফল এখন জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সরকার ও সরকারি দল চায় সবার আগে নিজের স্বার্থ ধরে রাখতে, তাতে দেশ যেখানেই যাক। নারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের তারা রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ব্যবহার করছে।

দেশের অনেক দলের দাবি আছে যাতে নারীদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রে এককভাবে নারীদেরই নিয়োগ দেয়া হোক। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমায় নারীদের শাখা খোলা, নারীদের জন্য কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শাখা খোলা, স্বাস্থ্যসেবায় নারীদের নিয়োগের বিধান হোক।

এর বাইরে বিদ্যমান কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবি মেনে নিয়ে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক।

(লেখাটি ২০ জুলাই, ২০২৪ তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে)


আরো সংবাদ



premium cement