কারবালার শাহাদতের শিক্ষা
- মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
- ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:০৬
নীলসিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া,
আম্মা! লাল তেরী খুন কিয়া খুনিয়া।
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সে কাঁদনে আসু আনে সীমারের ছোরাতে...
আজ ১০ মহররম। কারবালা দিবস। আজ সেই আশুরা, যে দিন রাঙ্গা খুনের ধারায় লাল হয়ে গিয়েছিল কারবালার প্রান্তর। এই দিনেই হজরত ইমাম হুসাইন রা: ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে তাঁর ৭২ জন সাথীসহ শহীদ হয়েছিলেন ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে।
ইসলামের ইতিহাসের কুচক্রী শাসক ইয়াজিদের তত্ত্বাবধানেই এই বিষাদময় ঘটনা ঘটে। কুফার লোকদের আমন্ত্রণে হজরত ইমাম হুসাইন রা: সেখানে যেতে চাইলে পথিমধ্যে ইয়াজিদের নরপশু সৈন্যরা তাঁকে অবরুদ্ধ করে এবং পানি বন্ধ করে দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। অর্থের লালসায় পড়ে মনুষ্যত্বহীন পিচাশ সীমার হজরত ইমাম হুসাইন রা:কে শহীদ করেছিল এবং তাঁর খণ্ডিত মস্তক নিয়ে হাজির হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসক ইয়াজিদের দরবারে।
সাহসী সিপাহসালার হজরত ইমাম হুসাইন রা: ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী চেতনার অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসের পাতায় হজরত ইমাম হুসাইন রা: একজন অকুতোভয়ী সাহসী বীর সেনাপতির নাম। যাঁর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছিল একাধারে বীরত্ব, সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগ, মানবতা ও অনুপম চরিত্রের। ন্যায়ের জন্য দ্বীনের জন্য সত্যের জন্য চূড়ান্ত সর্বনাশা বাতিল শক্তির মোকাবেলায় তিনি নির্ভীকচিত্তে কথা বলেছিলেন, লড়াই করেছিলেন।
দ্বীন ও মিল্লাতের স্বার্থবিরোধী সব স্বৈরাচারী স্বার্থান্বেষী অপশক্তিগুলোর মোকাবেলায় তিনি ছিলেন এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। ইসলামের অনুসারী কোনো ঈমানদার মানুষই কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করে না। ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফ শিক্ষা দেয়, তাতে পক্ষপাতিত্ব নেই। কুরআন ও হাদিস হলো মুসলিম উম্মাহর সংবিধান। কারো মনগড়া মতবাদ ইসলাম স্বীকার করে না, মুসলিম উম্মাহ মেনে নিতে পারে না। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কথাগুলো তিনি দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। সর্বদাই অন্যায় আর অসত্যের বেড়াজালগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিতেন, বলিষ্ঠভাবে। তাই তো ইয়াজিদের বশ্যতা স্বীকার না করে তিনি শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেছেন সানন্দে। তবু তিনি দ্বীন ও মিল্লাতবিরোধী চুক্তিতে আপস করেননি। মুসলমান ভাঙে, তবু মচকায় না- এর বাস্তবতা তিনি তাঁর জীবনের বিনিময়ে দেখিয়ে গেলেন। তাই এই সাহসী সিপাহসালারের আলোকিত নাম পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং লেখা থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত।
“ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
উষ্ণীষ কুরআনের, হাতে তেগ আরবীর,
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির।”
হজরত ইমাম হুসাইন রা:-এর দ্যুতিময় জীবন হতে মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা দিতে হবে যে, মুসলমানরা তাগুতি শক্তির সাথে কখনো কিছুতেই আপস করে না। মুসলমানরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো শক্তির কাছে কখনো মাথা নত করে না। সত্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকল্পে মুসলমানরা বুকের তাজা রক্ত অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারে। তারা পারে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করতে। তারা ঘোষণা করতে পারে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে-
“ঐ শোন ঐ শোন, বাজে কোথা দামামা,
শমসের হাতে নাও, বাঁধো শির আমামা।
জেগে উঠ মুসলিম হাঁকো হায়দারি হাঁক,
শহীদের খুনে সব লালে লাল হয়ে যাক।”
হিজরি ৬১ সালের যবনিকা উঠল। ইসলামী খেলাফতের বিশাল এলাকাজুড়ে অশান্তি বিরাজ করছে। ক্ষমতার জন্য ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া সংগ্রাম করছেন। আমজনতার মধ্যে চাপা ক্ষোভ। কিন্তু কেউ তার বিরুদ্ধে দাবি তুলছে না। খেলাফতের ঘনায়মান সন্ধ্যায় অদৃশ্যে শত্রুতার জাল বোনা চলছে। চারদিকে লোমহর্ষক শোরগোল। মক্কা-মদিনা থেকে শুরু করে কুফা, বসরা এবং পুরো ইসলামী খেলাফতজুড়ে নীরবে বয়ে চলছে শত্রুতার নিঃশ্বাস! খেলাফতের সোনালি সূর্য ডোবার অন্তিম আভাস!
হজরত মুয়াবিয়া রা: খেলাফতের ভার ন্যস্ত করে গিয়েছেন তার ছেলে ইয়াজিদের হাতে।
ইয়াজিদ খেলাফতের মসনদে বসেই অধ্যাদেশ জারি করল- ‘হজরত হুসাইনসহ তার সঙ্গীদের থেকে খেলাফতের বাইয়াত নেয়া হোক। প্রয়োজনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করে হলেও। অথচ হজরত মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ এখনো মদিনায় পৌঁছেনি। হজরত হোসাইন রা: তখন এখানেই অবস্থান করছিলেন। জাতির কলঙ্ক মারওয়ান হজরত হোসাইনকে হজরত মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ এবং ইয়াজিদের অধ্যাদেশ শুনিয়ে দিলো এবং গোপনে হজরত হোসাইনকে হত্যার পরিকল্পনাও সে করেছিল। হজরত মুয়াবিয়া রা:-এর মৃত্যু সংবাদ শুনে হজরত হুসাইন রা: গভীর সমবেদনা প্রকাশ করলেন এবং ইয়াজিদের বাইয়াত নিতে অস্বীকার করলেন। তিনি প্রত্যক্ষ করলেন মদিনার আবহাওয়া এখন তার অনুকূলে নয়। অবস্থা করুণ-ঘোলাটে! তাই তিনি সপরিবারে মদিনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওনা করলেন। রাসূল সা:-এর রওজা জিয়ারত করে মদিনাকে সালাম দিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে নানাজানের প্রিয় শহরকে বিদায় জানালেন। মক্কায় গিয়ে সেখানেই অবস্থান করলেন। চার পাশ থেকে শুভাকাক্সক্ষীরা এসে তাকে সালাম জানাতে লাগল। তাদের সাথে আলাপচারিতা আর ইবাদতে সময় কাটছে। কিন্তু চার পাশে কেমন যেন বিষাক্ত পরিস্থিতি। ওদিকে ইবনে আকিলের চিঠি, কুফার সংবাদ। সেখানের আমজনতা হজরত হোসাইন রা:-এর জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে প্রিয় হোসাইনের হাতে বাইয়াত হবে বলে। সেখান থেকে বারবার চিঠি আসছে বিভিন্নজনের নামে। হজরত হোসাইন মনে করলেন, পরিস্থিতি অনুকূলে তাই তিনি কুফার উদ্দেশে রওনা দিলেন সঙ্গী-শুভাকাক্সক্ষীদের শত বাধা সত্ত্বেও। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ইয়াজিদের আদেশে ইবনে আকিলকে শহীদ করা হয়েছে। সময় এখন ইয়াজিদের। ভীতসন্ত্রস্ত জনতা এখন তারই কথা বলে। দিনার-দেরহাম বোবা মুখেও বাক ফোটায়, শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করে। কিন্তু প্রিয় হোসাইন তো এরই মধ্যে পৌঁছে গেছেন ‘হাজির’ নামক স্থানে। মুহূর্তেই এ খবর পৌঁছে গেল কুলাঙ্গার ইবনে জিয়াদের কানে। সে একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা প্রেরণ করল হজরত হোসাইনকে প্রতিরোধের জন্য। হজরত হোসাইন এরই মধ্যে ‘আসাবা’য় পৌঁছে গেছেন। ‘জাবালা’য় থাকতেই তিনি ইবনে আকিল ও অন্যদের শাহাদতের খবর পেয়েছেন। ব্যথিত মন নিয়ে, ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে অলক্ষ্যে চোখে তবুও তিনি পথ চলছেন। আসু পরিস্থিতির করুণ পরিণতি জেনেও সামনে এগোচ্ছেন। অত্যাচারীর খোলা তলোয়ার সামনে- তবু ভয় নেই। যুগে যুগে যদি হোসাইন জেগে না ওঠে তবে কে রুখবে এ জালিমদের? হোসাইন তো পারতেন ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণ করে সুখে জীবন কাটাতে! কিন্তু তা করেননি। তিনি এই বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন অসত্যের সামনে মাথা নোয়াতে নেই, মৃত্যু অবধারিত জেনেও সত্যের পক্ষে লড়তে হয়।
ঠিক দুপুরের দিকে, কুয়াশায় ঝাপসা কিছু লক্ষ্য করা গেল দিগন্ত রেখায়। দেখা গেল একদল অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে খুব দ্রুত। হজরত হুসাইন রা: তার সঙ্গীদের পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। এরই মাঝে দেখা গেল এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যদল হজরত হোসাইনের মুকাবেলায় তাদের বিপরীত দিকে শিবির গাড়ছে। এ দিকে জোহরের সময় হয়ে গিয়েছে। হজরত হোসাইনের আহ্বানে প্রতিপক্ষও নামাজের জন্য একত্র হলো। হোসাইন রা: তখন সবার উদ্দেশে একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণ শেষে দুই দল জামাতের সাথে নামাজ আদায় করলেন। প্রতিপক্ষের সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ, তার অনুরোধে নামাজে ইমামতি করেছেন হজরত হোসাইন রা:। নামাজ শেষে আরেকটি ভাষণ দিলেন। এ দুই ভাষণে হোসাইন রা: তার কুফা আগমনের উদ্দেশ্য সবাইকে জানিয়ে দিলেন। তার চিঠিপত্রের কথা বললেন। কিন্তু তারা অস্বীকার করল। তবে হুর ইবনে ইয়াজিদের অন্তর ছিল নবীর পরিবারের প্রতি ভালোবাসায় ভরা। পাষণ্ড ইবনে জিয়াদ তাকে নির্দেশ দিয়েছিল হজরত হোসাইনকে যেভাবেই হোক পাকড়াও করে কুফায় তার সামনে নিয়ে যেতে, তিনি যেন মক্কায়ও ফেরত না যেতে পারেন। কিন্তু হোসাইন সাফ জানিয়ে দিলেন- ‘আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইবনে জিয়াদের সামনে যাব না।’ তখন হুর ইবনে ইয়াজিদ হোসাইনকে বললেন, ‘তাহলে আপনি মক্কা ও কুফার পথ ছেড়ে অন্য কোনো পথে অগ্রসর হন, যাতে আপনার পথ পরিবর্তনের কথা বলে আমি আপনার সাথে মোকাবেলা থেকে বাঁচতে পারি।’ তার কথা মতো হোসাইন রা: ‘আজিব’ ও ‘কাদেসিয়া’র পথকে পাশে রেখে বাম দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
ওদিকে হজরত হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আরো চার হাজার সৈন্য পাঠানো হলো। তাদের সেনাপতি ছিলেন ওমর ইবনে সা’দ। তিনিও নবী-পরিবারকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তারা আজ অসহায়। মহররমের ৭ তারিখ। ইবনে জিয়াদের নির্দেশ মতো হোসাইন রা:-এর কাফেলার জন্য পানি বন্ধ করে দেয়া হলো! কাফেলার জমানো পানি শেষ! পানির তৃষ্ণায় তপ্ত মরুভূমির মাঝে ছটফট করছে নারী ও কচি শিশুরা! হজরত হোসাইন রা: অসহায়! ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে তিনটি প্রস্তাব পেশ করলেন- ‘১. আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক। ২. অথবা আমাকে সরাসরি ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হোক। ৩. কিংবা আমাকে অন্য কোনো মুসলিম দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হোক।’ নিষ্ঠুর ইবনে জিয়াদ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।
এক পর্যায়ে হোসাইন সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড পিপাসায় ফোরাতের দিকে ছুটছেন।
সিমার বাহিনীর সাথে লড়ছেন বীরদর্পে। কেউ কাছে আসতে সাহস করছে না। আতঙ্কে এদিক-ওদিক দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় নিকৃষ্ট ‘হাসীন ইবনে নুমাইর’ তীর ছুড়ল হোসাইনকে লক্ষ্য করে। প্রিয় হোসাইনের কণ্ঠদেশে বিদ্ধ হলো। শুরু হলো রক্তক্ষরণ। হারামি সিমার এ সুযোগটাকে কাজে লাগাল। হায়েনার দলগুলো একযোগে হোসাইনের ওপর আক্রমণ করল। ক্লান্ত-শ্রান্ত হোসাইন, এখন একেবারেই নিথর। শাহাদতের সুধা পান করে চলে গেলেন নানাজানের দেশে!
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় হজরত ইমাম হুসাইন রা: ও তাঁর সাথীরা যে ত্যাগ ও কোরবানি স্বীকার করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত আগতব্য মুসলিম উম্মাহর জন্য তা প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। গর্জে উঠবে মজলুম মানুষেরা ইমাম হুসাইনের সাহসী চেতনা বুকে ধারণ করে জালিমের বিরুদ্ধে।
লেখক : কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা