নদীভাঙন, আতঙ্কে উপকূলবাসী
- ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
- ১৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৩
নদীভাঙন উপকূলীয় বাসিন্দাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। শব্দটি শুনলেই চোখের কোণে ভেসে ওঠে সব হারানো কিছু অসহায় মানুষের ছবি। প্রতি বছরই উপকূলীয় এলাকায় মাইলের পর মাইল জমি নদীতে চলে যায়। এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। চলতি বছর বর্ষার শুরুতেই বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
বছরের এ সময়টা নদীতীরের ভাঙন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন এটা দেশবাসীর ভাগ্যের লিখন।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই প্রধান তিনটি নদ-নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। প্রধান তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছাড়াও নদীবিধৌত বাংলাদেশের ছোট-বড় নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৪১০টি। এসব নদ-নদীর তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার তটরেখা নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। প্রায় দেড় কোটি মানুষ নদীভাঙনে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ ছাড়া প্রতি বছর নদীভাঙনে নিঃশেষ হয়ে যায় প্রায় ৮,৭০০ হেক্টর জমি।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জমির মালিকরা। কারণ তারা কখনোই আর সে জমি পুনরুদ্ধার করতে পারে না। আর এ দেশের নদীভাঙন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। পুরো বর্ষাকালেই চলতে থাকে ভাঙনের তাণ্ডবলীলা। বর্ষা শেষে ভাঙনের প্রকোপ কিছুটা কমলেও বছরজুড়ে তা কমবেশি মাত্রায় চলতে থাকে। এবারো নদীভাঙনের শিকার মানুষেরা সেই আগের কথার প্রতিধ্বনিই করেছেন ‘আমরা ত্রাণ চাই না, নদীভাঙন ঠেকান’। আসলে নদীভাঙন প্রতিরোধ এবং নদীভাঙা মানুষের পুনর্বাসন এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে সরকারেরও তেমন আলাদা বরাদ্দ নেই।
নদীভাঙনের প্রাকৃতিক কারণ
বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ হওয়ায় এখানকার জমি পলিমাটি দিয়ে গড়া। মাটির গঠন অনেকটা দুর্বল। এই দুর্বল মাটি নদীর পানির ¯্রােত সবসময় সইতে পারে না। এতে করে সামান্য শক্তিশালী স্রোত এলেই নদীভাঙন সৃষ্টি হয়।
বন্যা: নদীভাঙনের অন্যতম কারণ বন্যা। সাধারণত বর্ষাকালে আমাদের দেশে বন্যার প্রকোপ বাড়ে। এ সময় নদীর তীরের পানির গতি বেশি থাকে এবং তা নদীতীরে ভাঙন সৃষ্টি করে।
নদীর তলদেশে পলি জমা: প্রকৃতির নানা বিচ্যুতির কারণে নদীর তলদেশে পলি জমে থাকে। এতে করে নদীর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে তীরে চাপ সৃষ্টি করে এবং নদীর তীর ভেঙে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ঘটায়। এভাবে নদীভাঙন ত্বরান্বিত হয়।
নদীর প্রশস্ততা: নদীর প্রশস্ততা নদীভাঙনের সাথে সম্পর্কিত। নদী বেশি প্রশস্ত হলে ভাঙনের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
নদীতে নতুন চর তৈরি হওয়া: নদীতে পলি জমে চর তৈরি হয়। অনেক সময় নদীর মাঝখানে নতুন চর তৈরি হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। এতে নদীর একপাড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়।
নদীভাঙনের মানবসৃষ্ট কারণ
বন উজাড়: গাছের শিকড় মাটির গভীরে গিয়ে মাটির গঠন শক্তিশালী করে। এতে নদীর তীরবর্তী মাটির ভিত্তি শক্তিশালী হয়। দিনে দিনে মানুষ নিজের প্রয়োজনে বন কেটে উজাড় করার কারণে নদীর তীরের মাটি দুর্বল হয়ে যায়। এতে নদীর তীব্র ¯্রােতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটি ভেঙে পড়ে।
নদীর পাড়ে বসতবাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণ: মানুষ নদীর তীরবর্তী স্থানে বাড়িঘর ও নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে মাটি ধারণক্ষমতা কমে যায় এবং দ্রুত ভেঙে পড়ে। তাই নদীতীরবর্তী স্থাপনাও নদীভাঙনের একটি কারণ।
বালু উত্তোলন: আমরা প্রায়ই নদী হতে বালু উত্তোলন করতে দেখি। এই বালু উত্তোলনের ফলে নদীর ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং নদীভাঙন শুরু হয়। তাই নদী থেকে বালু উত্তোলনও নদী ভাঙনের জন্য দায়ী।
নদীতে বাঁধ দেয়া: অনেক সময় আমরা নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। তৈরি করি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সেচ প্রকল্প। এতে আমরা সাময়িকভাবে কিছুটা উপকৃত হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। নদীতে সৃষ্ট বাঁধ নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত করে এবং এতে নদীভাঙন সৃষ্টি হয়।
শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি: যুগ যুগ ধরে নদীর তীর ঘেঁষে তৈরি হয়েছে নানা জনপদ। নদীর তীর অনেক সময় নদীর একতীরে অবস্থিত শহর রক্ষা করতে গিয়ে মানুষ শহর রক্ষা বাঁধ দিয়ে থাকে। এতে করে নদীর একপাড়ের ভাঙন রোধ হলেও অন্য পাড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়।
অপরিকল্পিত ড্রেজিং: নদীর নাব্যতা রক্ষায় প্রায়ই ড্রেজিং করা হয়। সব সময় ড্রেজিং উপকারে আসে না। অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করার ফলে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততার মধ্যে ভারসাম্য থাকে না। এতে নদীভাঙন সৃষ্টি হয়ে থাকে।
জেলা বা উপজেলাগুলোতে সরকারের যে ডিজাস্টার ফান্ড রয়েছে সেখান থেকে নামকাওয়াস্তে কিছু খয়রাতি সাহায্য সহযোগিতা করা হলেও ফান্ড অপ্রতুলতার কারণে সেটা খুব বেশি ফলদায়ক কিছু হয় না। নদীভাঙা মানুষের যে নিয়ত দুর্ভোগ তা থেকে তাদেরকে মুক্তি দিতে হলে সরকারের কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। আর নদীভাঙা মানুষের পুনর্বাসনে জেলা-উপজেলাগুলোয় সরকারের সুনির্দিষ্ট ফান্ড থাকা প্রয়োজন। যেখান থেকে ভাঙনকবলিত মানুষগুলোকে দ্রুত সাহায্য সহযোগিতা করার সুযোগ থাকবে। একইভাবে নদীভাঙন এলাকাতে যেসব উন্নয়ন সংগঠন কাজ করে তাদের একটি সমন্বিত ফান্ডের ব্যবস্থা থাকবে, যা থেকে তারা দ্রুতই দুর্গত এলাকায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে। বন্যা, নদীভাঙন আমাদের নদী পরিবেষ্টিত এই দেশে মোটেও নতুন নয়। কিন্তু নদীভাঙন রোধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনো আমরা সেভাবে সক্ষমতা দেখাতে পারিনি। ফলে প্রতি বছরই আমাদের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
একইভাবে নদীভাঙনের কারণে স্বল্প আয়ের চরবাসীকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, চরাঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় এক কোটি মানুষের রক্ষায় আমাদের সঠিক কর্মকৌশল নিতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এমনিতেই বাংলাদেশে প্রতি বছরই আবাদি জমি কমছে। বাড়ছে মানুষ। নদীভাঙা উদ্বাস্তু মানুষের চাপ পড়ছে বড় শহরগুলোতে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ কী? প্রকৃতির এত বড় বিপর্যয় মানুষের পক্ষে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। তারপরও এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে হবে নদীভাঙন কমিয়ে আনতে। এ জন্য শুধু জাতীয় নয়, নিতে হবে আন্তর্জাতিক সহায়তা, পরামর্শ ও পরিকল্পনা।
লেখক : কলাম লেখক, হোমিও চিকিৎসক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা