২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সর্প দংশন প্রতিরোধ ও প্রতিকার

সর্প দংশন প্রতিরোধ ও প্রতিকার - ফাইল ছবি

ইদানীং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, রাসেলস ভাইপারের যত্রতত্র বিচরণ ও মানুষকে দংশনের। এটি অমূলক নয়, কারণ বর্ষা মৌসুমে যেহেতু দেশ প্রায় ডুবে যায় সাপ তার নিজের আস্তানা ছেড়ে তুলনামূলক মনুষ্য বসতির দিকে অর্থাৎ কিছুটা উঁচু ভূমির দিকে চলে আসে। আবার গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরু থেকে বর্ষার শেষ সবটা ধরেই সাপের প্রজনন মৌসুম। সাপের সংখ্যা বেড়ে যায়। তদুপরি বছরের এ সময় যখন আমাদের দেশ পানির নিচে তলিয়ে যায় অনেকটাই আমাদের প্রতিবেশী দেশের বাঁধের প্রায় সব স্লুইসগেট এক সাথে খুলে দেয়াতে। উজানের দেশ শুকনো মৌসুমে যেমন পানি আটকে রাখে তাদের প্রয়োজনে, ঠিক বর্ষা মৌসুমে নিজেদের রক্ষার জন্য এটি করে থাকে।

আমাদের জনগণের মধ্যে কখনো কখনো অজ্ঞতার কারণে বিপর্যয় নেমে আসে। যেমন, সাপ নিজের বিষ নিজে শুষে নেয়, তন্ত্রমন্ত্রে বিষ নামানো, ওঝার মুখের কথায় সাপের বিষ নামে, সাপ প্রতিশোধপরায়ণ প্রভৃতি। এগুলো সবই অমূলক, ভ্রান্ত ধারণা। সুতরাং সাপে দংশন করলে ওঝা বৈদ্যের কাছে যাওয়া মোটেই সঠিক নয়; বরং সাপের দংশনের থেকে মুক্ত থাকার জন্য যেমন অবশ্যই কিছু সাবধানতার প্রয়োজন ঠিক তেমনি কোনো কারণে যদি সাপ কোনো মানুষকে দংশন করেই ফেলে তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দংশিত ব্যক্তিকে নিয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া। এদিক থেকে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ প্রশংসনীয় যে, প্রতিটি স্বাস্থকেন্দ্রে তিনি এন্টিভেনমের ব্যবস্থা রেখেছেন, যা আগে ছিল না।

কিছু সাবধানতার কথা এখানে উল্লেখ করা হলো : ১. বাড়ির গোলাঘরে যাতে ইঁদুর ঢুকতে না পারে সে ব্যবস্থা করা; ২. সন্ধ্যার আগেই সব কাজ সেরে ঘরে থাকা, কেননা সাপ এ সময় খাদ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়ে; ৩. দিনে সময় বুঝেসুঝে ঝোপঝাড়ে কিংবা কৃষিক্ষেতের আশপাশে কাজ করা, অবশ্যই মোজাসহ কেডস পরা বাঞ্ছনীয় এবং হাতে গ্লাভস পরতে হবে; ৪. গোলাঘর বা তার পাশে পাশে না ঘুমানো; ৫. ওঝার উপরে বিশ্বাস না রাখা, কেননা সর্প দংশনে ওঝার কোনো কিছুই করার নেই; ৬. রাতে দেশবাসীকে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে।

ওঝারা সাধারণত ভোজভাজি করে থাকে, ততক্ষণে রোগী শেষ। ওঝারা যে সাপ ধরতে পারঙ্গম তার কারণ হলো- বংশপরম্পরায় ওরা এটি রপ্ত করতে করতে পারদর্শী হয়ে গেছে। আবার ওঝার তন্ত্রমন্ত্রে গর্তের সাপ বেরিয়ে আসে বলে মানুষের যে ধারণা সেখানেও মানুষের ভুল ধারণা কাজ করে। ওঝা নয়, আপনি নিজে সাপের আবাসের আশপাশে মাটিতে আঘাত করুন ক্ষিপ্রতার সাথে, মাটিতে ভাইব্রেশন বা কম্পনের ফলে সাপ বেরিয়ে আসবে। তবে ওঝারা সাপ বেরিয়ে আসার সাথে সাথে যেমন ক্ষিপ্রতার সাথে, দক্ষতার সাথে, সাপের গলার দিকটা চেপে ধরে তা আপনি পারবেন না। ওরা পারে এ জন্য যে, ওরা বংশপরম্পরায় এটি তাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে রপ্ত করে থাকে।

ওঝারা বলে থাকে, সাপ ও বেজির লড়াইয়ে বেজি জিতে যায় এ জন্য যে, বেজি এক প্রকার পাতা চেনে যা সাপের আক্রমণের স্থানে শরীরের সেই জায়গায় লাগায় আর সাপের আক্রমণে ক্ষতস্থান বিষমুক্ত হয়ে যায়। এসব বলে তারা কিছু পাতাও দেখায় এবং দংশিত স্থানে পাতা লাগিয়ে ঝাড়ফুঁক করতে থাকে। সবই ওদের দুষ্টামি। এগুলো করার কারণ হলো ওরা যেন মানুষের কাছ থেকে বিশ্বাস অর্জন করতে পারে। সাপ ও বেজির লড়াইয়ে অবশ্যই বেজি জিতে যায় এ জন্য যে, সাপ লড়াইয়ের সময় হঠাৎ করে ঝোপে ঢুকে সামান্য সময়ের জন্য, একটু দম নেয় যাতে এ সময় সাপ তার মাথা নামিয়ে ফেলে, বেজির জন্য সুবিধা সে সময় চট করে সাপের মাথা কামড়ে ধরে। সাপ বেজির কাছে হেরে যায় এ জন্য যে, বেজির ক্ষিপ্রতা এবং যেহেতু বেজি তার লোম দিয়ে আবৃত, সাপ যত চেষ্টাই করুক বেজির শরীরে বিষ ঢুকাতে পারে না, বেজির লোমের ওপর দিয়ে চলে যায়। এদের যুদ্ধের সময় বেজির লোম খাড়া থাকে।

ওঝারা এটিও বলে থাকে যে, সাপে দংশন করার পর সাপ ওই ব্যক্তিকে খুঁজে থাকে, আসলে তা ঠিক নয়। সাপ তার শিকার প্রাণীটিকে খোঁজে খাওয়ার জন্য। বিশ্বাসের ফাঁকফোকরের মধ্যে ওরা বড় রকমের চিকিৎসাব্যবস্থার সাথে জড়িয়ে থাকে, জড়িয়ে আছে ও পাচারকারীতে জড়িত থাকে। এদিকটিও না দেখলে চলবে না। কেননা, সাপের অবৈধ খামারও গড়ে উঠেছে এদের সহায়তায়। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এগুলো অনেক সময় যেন দেখেও না দেখার ভান করে। এভাবে দেশ থেকে সাপ নানাভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি। আগে সাপের খেলা দেখানোর উছিলায় হলেও কর্তৃপক্ষের কৃপাদৃষ্টি থাকত ওঝাদের ওপর, এখন তেমন তা নেই। তবে অবৈধ ব্যবসার বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না।

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া শুধুই ইঁদুর খায়। ইঁদুর নিধনে তার জুরি নেই। যেহেতু এদের আবাস বন্যার কারণে পানির নিচে এ জন্য এরা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। কেউ কেউ এটিও বলছেন যে, স্লুইসগেটগুলো সব একসাথে খোলাতে পানির যে তোড় হয়তো উজানের কিছু আবাস থেকে কিছু সংখ্যক সাপ এসেও থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে সঠিক অনুসন্ধান প্রয়োজন অবশ্যই।

সাপ মেরে ফেলার জন্য আকর্ষণীয় পুরস্কারের প্রচারের ফলে যে বিপুল সংখ্যক নানা প্রজাতির সাপ মারা হলো তা আত্মঘাতী। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণকারী প্রাণীগুলোর মধ্যে সাপ উল্লেখযোগ্য। সাপ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী যথা- বেজি, গুইসাপ, শিয়াল, ঈগল, পেঁচা প্রভৃতি প্রাণীও প্রচুর ইঁদুর খায় যা অভাবনীয়। এসব প্রাণীর খাদ্যাভ্যাসের ওপরে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এরা ইঁদুর নিধন করে বছরে লাখ কোটি টাকার ফসল রক্ষা করে থাকে। বেজি তো শুধু ইঁদুর খায়-ই না; বরং যতক্ষণ ইঁদুর পায় মারতেই থাকে। এক গবেষণায় দেখা যায়, ছোট-বড় মিলে ১৩টি পর্যন্ত এক দিনেই মেরে ফেলার পর সে ক্লান্ত হয়। বেজি সাপ নিয়ন্ত্রণের জন্যও অত্যন্ত পারদর্শী, বেজি সাপ মারে সাপ খায়। এসব প্রাণীর অস্তিত্বের দিকেও নজর দিতে হবে। দেশ থেকে বন্যপ্রাণী নীরবে নিভৃতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

সাপ তথা ইঁদুরখেকো প্রাণীগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিলে হয়তো দেখা যাবে ইঁদুরের আধিক্যহেতু ফসল ঘরে উঠবে না। দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ।

লেখক : বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান,
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement