০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

তিস্তার পানি সঙ্কট : বর্তমান পরিস্থিতি

তিস্তার পানি সঙ্কট : বর্তমান পরিস্থিতি - ফাইল ছবি

ভারতের সাথে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির চুক্তি এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তি আদৌ হবে কি না তাও অনিশ্চিত। এটি বরং ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। তিস্তার পানি কেবল একটি পানি সমস্যা নয়, এটি মানবিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেরও গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই সমস্যার সমাধান হলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা ও সম্প্রীতি বাড়বে। এবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার প্রসঙ্গ না আসায় বাংলাদেশের মানুষ হতাশ হয়েছে।

তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি কী
তিস্তার পানি বণ্টনের কোনো চুক্তি এখনো হয়নি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা ছিল। তখন শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির ৩৭.৫ শতাংশ বাংলাদেশের এবং ৪২.৫ শতাংশ ভারতের জন্য বরাদ্দ করার কথা হয়েছিল। বলা হয়, বাকি ২০ শতাংশ নদীর পরিবেশ রক্ষার জন্য রাখা হবে। সেই চুক্তির বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের জন্য কেন সমস্যা
তিস্তা নদীর প্রধান সমস্যা হলো ভারতের উজানে ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার। ভারত জলবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। তিস্তা নদী শুকিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টি ভারতের নীতির সাথে যুক্ত। এজন্য ভারতের সাথে কার্যকর আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। পানিবণ্টন চুক্তিতে প্রবেশ না করেই ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে উঠছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, তার সরকার দ্রুত চুক্তি সম্পন্ন করতে কাজ করছে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং ২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় জারি করা যৌথ বিবৃতিগুলোতে তিস্তা চুক্তির আশ্বাস ছিল।

তারই ধারাবাহিকতায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যতবারই ভারতে গিয়েছেন ততবারই তিস্তার কথা বলেছেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের সফরের সময় ২০১১ সালে প্রস্তুত করা তিস্তা চুক্তির খসড়া স্বাক্ষরের প্রসঙ্গ তোলেন। সে সময়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। পরে, গত ২২ জুন ২০২৪ দুপুরে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকে ১০ চুক্তি সই করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিস্তার পানির কোনো উল্লেখ ছিল না। তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ না থাকলেও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল চলাচল চুক্তিসহ উল্টো ১০টি চুক্তি সই করেন যা নিয়ে বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ অসন্তোষ ও প্রতিবাদ।

এসব চুক্তির পরই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষদের সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্নভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

বর্ষায় আসা পানির ঢলের ক্ষতি
বিবিসি বাংলাকে তিস্তা পাড়ের স্থানীয়রা জানান, কিছু দিন আগে তিস্তার পানি বেড়ে বন্যা হয় এবং এরপর শুরু হয় নদীভাঙন, ফলে শত শত হেক্টর ফসলি জমি, ঘরবাড়ি এবং রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে। গদাই গ্রামের মো: হাফেজ আলী বলেন, তার পরিবার তিনবার ভাঙনের শিকার হয়েছে এবং তার বাপ-দাদারাও একই দুর্ভোগে পড়েছিলেন। তিস্তার বন্যা ও ভাঙনে ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা যায়। কৃষক হাফিজ আক্ষেপ করে বলেন, ‘যে সময় আমাদের দরকার, সে সময় পানি দেয় না।’ গ্রামের এক নারী বলেন, ‘যখন ভারতে পানি আটকে রাখা হয় না, তখনই আমাদের এলাকা প্লাবিত হয় এবং আমাদের বসত-বাড়ি ও জমি সব চলে যায়।’

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ
বিশেষ করে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের রেল চলাচলের চুক্তি ‘দেশের স্বার্থবিরোধী’ উল্লেখ করে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই চুক্তিগুলো প্রত্যাখ্যান করছে। দলের মহাসচিব প্রশ্ন তোলেন, ভারতের সাথে যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের লাভ কী?

বিএনপির মহাসচিব বলেন, সরকার ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য দাবি আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে এবং পানির হিস্যার মীমাংসা না করেই তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে চাচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির মতে, ‘অবৈধ সরকার পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ভারতের চিকেনস নেক বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর তৈরি করার লাভ কী? এতে শুধুই ভারতের লাভ।’

১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ১০ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের প্রভাবাধীন রাজ্যে পরিণত করার পথে এগিয়েছেন। জোটের নেতারা এই চুক্তিগুলোকে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর এই কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়েছেন।

এবি পার্টি বলেছে, ‘সরকার বাংলাদেশের জনগণকে অন্ধকারে রেখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে গণবিরোধী চুক্তি করেছে, যার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।

গণঅধিকার পরিষদের নেতারা অভিযোগ করেন, কানেকটিভিটির নামে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিভিন্ন সমঝোতা- যেমন রেল, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, সামরিক শিক্ষা, ওষুধ, সমুদ্র গবেষণা এবং পানিসীমায় অবাধ বিচরণ, বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।

তিস্তা প্রকল্পে চীনের আগ্রহ
বাংলাদেশের নতুন সরকার গঠনের পর, জানুয়ারিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে বৈঠকের পর চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘তিস্তা নদী প্রকল্পে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রস্তাব পেলে চীন তা বিবেচনা করবে এবং সহযোগিতা দেবে।’ চীনা কোম্পানিকে কাজ দেয়ার বিষয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ জানানোর পর বেইজিং ঢাকার কাছে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের আনুষ্ঠানিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছে।

নতুন করে ভারতের আগ্রহ
তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প (TRCMRP) নিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। ২০১৯ সাল থেকে চীনের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় এই মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সম্প্রতি, ভারতও প্রকল্পটিতে গুরুত্বসহকারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, ফলে অঞ্চলে নতুন ধরনের ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা দেখা দিতে পারে। গত মাসে ঢাকা সফরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা জানান, তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে ভারতেরও আগ্রহ রয়েছে।

তিস্তা প্রকল্পে চীন এবং ভারতের টানাটানি
তিস্তার পানি বণ্টনে চীন এবং ভারতের মধ্যে টানাটানি চলছে। ভারত তিস্তা নদীর পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য একটি সর্বশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে এবং চীন ইতোমধ্যে একটি প্রকল্পের জন্য আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে। এই কারণে বেইজিং এবং নয়াদিল্লির মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে।

নয়াদিল্লি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার সাথে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য ঝুলিয়ে রেখেছে, যা দেশের উত্তর অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে।

পানি দিতে মমতার তীব্র বিরোধিতা
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানিয়েছেন, তিস্তার পানির হিস্যা বাংলাদেশকে দেয়া সম্ভব নয়। মোদিকে লেখা এক চিঠিতে মমতা উল্লেখ করেছেন, রাজ্যের মানুষকে বঞ্চিত করে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেয়া যাবে না। মমতার অবস্থান এবং এবারে দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে তিস্তা বিষয়টি না আসায় বাংলাদেশের মানুষ তীব্রভাবে নাখোশ ও হতাশ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত
উত্তরাঞ্চলে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তিস্তার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে আন্দোলন ও জনমত গঠন করছেন। তারা দ্রুত তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু এবং চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চান। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-বাংলাদেশ শীর্ষ বৈঠকে তিস্তা সমস্যা সমাধানের আলোচনা বিলম্বিত হতে পারে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ভারত একে ঝুলিয়ে দিলো, কালক্ষেপণ করল। চুক্তি অনুযায়ী কারিগরি টিম বলবে যা কিছু করতে হবে, বাংলাদেশকে করতে হবে।

ভারতের জিন্দাল ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যতই মসৃণ হোক না কেন, নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সংবেদনশীল বিষয় হয়ে থাকবে।’


বাংলাদেশের জন্য তিস্তাচুক্তি কেন প্রয়োজন
তিস্তা নদী বাংলাদেশ ও ভারতের তিন কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত। এর মধ্যে দুই কোটির বেশি লোক বাংলাদেশে এবং প্রায় ৯০ লাখ লোক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে তিস্তার অববাহিকায় বসবাস করে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা দেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার প্লাবনভূমি ২৭৫০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এবং লাখো মানুষ কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা ও পানির চাহিদার জন্য এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি তা তারা জীবনেও ভুলবে না।’ আমরা বলি, ভারত তো নিজের স্বার্থে সবই নিলো, আমরা কী পেলাম? একতরফা ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব কতকাল মেনে নেবে বাংলাদেশ?

পরিশেষে, ১৯৮৩ সালে ২৫তম যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, এককালীন ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তিস্তার ৩৬ শতাংশ পানি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনার আইনে এটি স্বীকৃত নিয়ম।

তিস্তা নদী পুনরুজ্জীবিত করতে হলে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে যা দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে। আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতির আলোকে নতুন সমঝোতা তৈরি করাই হতে পারে একটি টেকসই সমাধান। এর পাশাপাশি, উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement