২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসরাইল এই গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে গত ৭৬ বছর ধরেই...

ইসরাইল এই গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে গত ৭৬ বছর ধরেই... - ছবি : সংগৃহীত

ফিলিস্তিনের আজকের নরমেধযজ্ঞ এবং ধ্বংসলীলা বিশ্বজুড়ে নবীন প্রজন্মকে নাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্র্রেলিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পৃথিবীর দিকে দিকে ছাত্র যুবকরা তাদের ক্যাম্পাস ত্যাগ করে খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা, ধ্বংসকাণ্ড এবং মানবিক ত্রাণকার্যক্রমের পথ রোধ করার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই নবীন প্রজন্ম জানে না যে, ইহুদিবাদের এই হিংস্র্র দানবীয় রূপ আজকের নতুন নয়। গত ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য ইসরাইল এভাবেই নিষ্ঠুর অত্যাচার ও গণহত্যা চালিয়ে আসছে।

ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে শাসিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তুর্কি ওসমানিয়া (অটোম্যান) সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশকে ভেঙে ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, ট্রান্স-জর্দানকেও সেই একইভাবে ভেঙে ফিলিস্তিনিদের হাজার হাজার বছরের নিজস্ব আবাসভূমির অধিকার কেড়ে নিয়ে সারা পৃথিবী থেকে টুকিয়ে আনা ইহুদিদের রাষ্ট্র ইসরাইলকে চাপিয়ে দেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই অপকর্ম অর্থাৎ সেই কুখ্যাত ‘বেলফোর ঘোষণাটি’ দিয়েছিলেন। সবচেয়ে পরিহাসের ব্যাপার হলো, যাদের জমি কেড়ে নিয়ে ব্রিটেন ইহুদিদের স্থায়ী সার্বভৌমত্ব দিলো, এ ব্যাপারে তাদের সাথে কোনো রকম পরামর্শ করার বা অনুমোদনের তোয়াক্কাই করা হয়নি। সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অপব্যবহার করেই সেদিন ব্রিটেন স্বাধীন আরব জমিনে এহেন অনাচার সাধন করেছিল। সেই কুখ্যাত ‘বেলফোর’ ঘোষণা মতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঘোষণা দেয় বিশ্ব ইহুদি চক্রের নেতা ডেভিড বেনগুরিয়ন।

নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত ও কোণঠাসা ফিলিস্তিনিদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সেই সময় থেকেই শুরু। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য সামরিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে যা কিছুই করেছে, সবই ন্যায্য বা ন্যায়সঙ্গত জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। যে অবিচার ও নিষ্ঠুরতা তাদের প্রতি করা হয়েছে সেই তুলনায় ফিলিস্তিনি আরবরা কিছুই করেনি। যা কিছু করেছে তাদের ওপর ঐতিহাসিক অবিচার এবং জুলুমের প্রতিবাদ বৈ আর কিছুই নয়। হামাস বা তার আগে পিএলওর সংগ্রামকে যদি অন্যায় বলা হয় তাহলে পৃথিবীর সব জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও অবৈধ এবং অন্যায্য।

১৯৪৮ সালেই ফিলিস্তিনের ১০ লাখ আরব রাতারাতি স্বাধীন নাগরিক থেকে ভিটেছাড়া শরণার্থীতে পরিণত হয়। ইহুদিদের জন্য যা ছিল নাৎসি ‘হলোকাস্ট’ ফিলিস্তিনিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও তেমনিভাবে ছিল ‘মহা বিপর্যয়’ যাকে তারা বলে ‘নাকবা’। জগদ্বাসীর চোখের সামনে ফিলিস্তিনের নাম মুছে ফেলা হয়, ছিঁড়ে কেটে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় তাদের মানচিত্র। ফিলিস্তিনিদের ওপর এই সাম্রাজ্যবাদী অবিচার এবং তথাকথিত ইসরাইল প্রকল্পের বিরুদ্ধে সেদিন ফুঁসে উঠেছিল আরব বিশ্ব। তথাকথিত জুলুমবাজ ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় প্রথম আরব-ইসরাইল সাম্রাজ্যবাদের অসীম বলে বলীয়ান ইসরাইল সে যাত্রায় টিকে যায় (যেমন- আজ পর্যন্ত টিকে আছে পশ্চিমা সাম্র্রাজ্যবাদী প্রভুদের মদদে)। এক দিনের জন্যও যদি আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স তথা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ইসরাইলের প্রতি তাদের সমর্থন তুলে নেয়, তবে সেই দিনটিই হবে ইসরাইলের অস্তিত্বের শেষ দিন।

পশ্চিমাদের সৃষ্ট এই ইহুদিবাদী ইসরাইল যখন ফিলিস্তিনকে ধ্বংসের নেশায় উন্মত্ত, দেশে দেশে গিয়ে তাদের বোমারু বিমান যখন বোমা নিক্ষেপ করে, অন্য দেশের মানুষকে খুন করে আসে তখন কোথায় থাকে বিশ্ব মানবাধিকারের অবতাররা? জাতিসঙ্ঘের গাজা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে আজ ভেটো দিলো যে দেশগুলো, তারাই তো মানবাধিকার ও মানবতাবাদের দুর্গ বলে গর্ব করে। এ কেমনতর শঠতা এবং ছেনালি? দারোগা নিজেই যদি ডাকাত দলের হোতা হয় কেমন হবে তাহলে ব্যাপারটা? ইসরাইলের যারা মদদদাতা এবং জোগানদার, সহযোগী এবং সমর্থক কোন মুখে তারা হিটলারের নাৎসিবাদের প্রতি ঘৃণা ছড়ায়? ইহুদিদের আজকের এই বেপরোয়া গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা দেখেও কি তারা বোঝে না, কেন জার্মানরা তাদের ভূপৃষ্ঠ থেকে নির্মূল করতে চেয়েছিল? ইহুদিরা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রতারণা করে ঐশী লানতপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা আল্লাহর নবী-পয়গম্বরদের হত্যা করেছে। আর আজ তাদেরই অধস্তন পুরুষ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার হাজার হাজার বেসামরিক নারী-পুরুষ-শিশুদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করছে। গোটা জগৎ মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। নির্লজ্জের মতো জাতিসঙ্ঘের যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাবে ভেটো দিচ্ছে। শুধু পশ্চিমারা একা কেন, কী করছে আজ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী তথাকথিত মুসলিম আরব দেশগুলো? আজারবাইজান-তাজিকিস্তান-তুর্কমেনিস্তান ইসরাইলের সেই ট্যাঙ্কের তেল জোগান দিচ্ছে, যে ট্যাঙ্ক গাজা, রাফা, পশ্চিমতীর ও জেরুসালেম উপকণ্ঠে জীবন্ত নর-নারীকে চাপা দিয়ে গণকবর রচনা করছে।

ইসরাইলের নতুন ‘বন্ধু’ কুয়েত, আরব আমিরাত, জর্দানের কি লজ্জা পায় না যখন তারা দেখছে একটি খ্রিষ্টান দেশ হয়েও দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের দেশ থেকে ইসরাইলের কূটনীতিকদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে তেলআবিব থেকে তাদের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করেছে। শুধু তাই নয়, এই দক্ষিণ আফ্রিকাই বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত জাতিসঙ্ঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা ঠোকে। তার সাথে সম্প্রতি যোগ দিয়েছে আরেক খ্রিষ্টান দেশ কিউবা। এ দেখেও কি ইসরাইলের আরব বন্ধু দেশগুলোর সামান্যতম শরম বোধ জাগে না?

আরব ধনকুবেরদের দেশগুলোর কি লজ্জা হয় না, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতা শেখ মুজিবের ইসরাইল নীতি থেকে? বাংলাদেশ যখন মাত্র স্বাধীন হলো, আন্তর্জাতিক ত্রাণসহায়তা এবং স্বীকৃতি দুটোই যখন তার অত্যন্ত প্রয়োজন, তখন ইসরাইল থেকে একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে জানিয়েছিল, তাদের দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। শুনে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে চমকে দিয়ে বলেছিলেন, কে চাচ্ছে তোমাদের স্বীকৃতি? আমরা তো তোমাদেরকেই স্বীকার করি না এবং কখনো করব না। এটিই ছিল ইসরাইলি মিশনের প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর যাকে বলে পত্রপাঠ বিদায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যখন অসীম দারিদ্র্যে নিপতিত সেই ১৯৭৩ সালেই দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে তিনি এক প্লেনবোঝাই চা-পাতা পাঠান রণাঙ্গনে মিসর বা জর্দানি সেনাদের জন্য। সেদিন আরব বিশ্ব চমকে উঠেছিল আরবদের প্রতি দরিদ্র বাংলাদেশের হৃদয়ের টান দেখে।
এই সংহতি ও মহানুভবতার পথ ধরেই ওআইসিসহ বৃহত্তর ইসলামী উম্মাহর সাথে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ঐতিহাসিক পথ রচিত হয়েছিল। বড় বড় কাগজে ছবি ছাপা হয়েছিল হুয়ারে বুমেদিন, বাশার আল আসাদ, আনোয়ার আল সাদাত ও ইয়াসির আরাফাতের সাথে বঙ্গবন্ধুর হাস্যরত ছবি।

ভারতের একটি কাগজে অবশ্য এই ছবির ক্যাপশনে কতকটা ব্যঙ্গ করেই লিখেছিল, ‘শেখেরা আবার এক জোট হয়েছে!’ শুধু তাই নয়, বাংলাদেশই ছিল পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশের নাগরিকদের পাসপোর্টে সিল মারা থাকত- এই পাসপোর্ট ইসরাইল ছাড়া পৃথিবীর সব দেশের জন্য প্রযোজ্য। এখন নাকি ই-পাসপোর্টের যুগে এসে ওই দৃপ্ত ঘোষণাটি দেয়ার প্রবিধান উঠে গেছে। এ নিয়ে কাগজে অনেক লেখালেখিও হতে দেখেছি। বিষয়টি কি নীতিগত, না কারিগরি, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে যদি নীতি-প্রস্থান হয় বিষয়টি নিতান্তই নিন্দনীয় ও প্রতিকারযোগ্য।


আরো সংবাদ



premium cement